আমেরিকার নির্বাচন : গাধা আর হাতির লড়াই, দেখা যাক কে জিতে
গাধা আর হাতির লড়াই বেশ জমে উঠেছে। লড়াইয়ে শেষ তক কে জয়ী হয়, কার দখলে যায় হোয়াইট হাউস সেটি দেখার জন্যে এখন অধীর আগ্রহ আর টানটান উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করছে যুক্তরাষ্ট্র সহ গোটা বিশ্ব। ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রার্থী প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ‘গাধা’ নির্বাচনী-প্রতীক নিয়ে মরিয়া হয়ে লড়ছেন, ‘হাতি’ প্রতীক নিয়ে তার প্রতিদ্বন্দ্বী যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিপাবলিকান দলীয় প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে। নানা দিক থেকে ২০২০ নির্বাচন ভিন্ন এবং উল্লেখযোগ্য। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি, প্রতিপক্ষকে গালিগালাজ, অত্যন্ত অশোভন, সমস্ত শিষ্টাচারের বাইরে গিয়ে আক্রমণ করা, ভয়ভীতি প্রদর্শন করা, জনগণের মাঝে বিভাজন সৃষ্টি করা- এমনটি আগে আর কখনো দেখা যায়নি। বলা বাহুল্য, এই ধরনের আক্রমণাত্মক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে ট্রাম্প শিবির থেকে। খোদ দেশের প্রেসিডেন্ট তার শাসনামলে নিজ দেশে অনুষ্ঠিতব্য ভোটে ঢালাওভাবে কারচুপি হচ্ছে, হবে- এমনতর আশংকা পৃথিবীর আর কোন দেশে কোন ‘সিটিং’ প্রেসিডেন্ট করেছেন বলে জানা নেই। কিন্তু এমন আশংকা বারবার প্রকাশ করে অভিযোগের আঙুল তুলছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ডেমোক্র্যাট দলের বিরুদ্ধে। নির্বাচনী প্রচারাভিযানে তিনি বলে চলেছেন, তিনি নির্বাচনে জয়ী হবেন, ‘তবে যদি আমি পরাজিত হই, সেটি হবে ভোট কারচুপির মাধ্যমে এবং সেটি করে চলেছে ডেমোক্র্যাক্ট পার্টি’। উল্লেখ্য, বেশ কিছুদিন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যে আগাম ভোট দেয়া শুরু হয়েছে এবং এই বছর যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সব চাইতে বেশি আগাম ভোট পড়েছে। পাশাপাশি ডাকযোগে ব্যালট পাঠিয়ে ভোট দেয়া চলছে। ইতিমধ্যে প্রায় সাত কোটি ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। অন্যদিকে ডাকযোগে ভোট যাতে সময়মত না পৌঁছে তার জন্যে ট্রাম্প ও তার প্রশাসন প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে, বিশেষ করে সেই সমস্ত রাজ্যে যেখানে রিপাবলিকান দলীয় প্রশাসন ও এটর্নী জেনারেল ক্ষমতায়। নিয়ম হলো ডাকযোগে প্রেরিত ভোট ভোটের দিনের পরও একটা সময় পর্যন্ত গণনা করা হয়ে থাকে। রিপাবলিকান দল এর বিপক্ষে। ইতিমধ্যে উইসকনসিন রাজ্যে সুপ্রিম কোর্ট এই বলে রায় দিয়েছে যে ভোটের দিনের পর যে সমস্ত ভোট ডাকযোগে আসবে তা গ্রহণ করা হবে না। এর আগে ডেমোক্র্যাট দলের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ‘লোয়ার কোর্ট’ ৩ নভেম্বরের পর আরো ৬ দিন বাড়িয়ে গণনা করা যাবে মর্মে রায় দিয়েছিল।
এদিকে সুপ্রিম কোর্টে রিপাবলিকান দলের ক্ষমতা আরো পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে নির্বাচনের মাত্র এক সপ্তাহ আগে তড়িঘড়ি করে শূন্য আসনে নতুন বিচারপতি হিসাবে মনোনয়ন দেয়া হলো ৪৮ বছরের এটর্নী, অ্যামি কোনি ব্যারেটকে। রিপাবলিকান সিনেটরদের সমর্থনে ৫২-৪৮ ভোটে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পেলেন অ্যামি ব্যারেট। কেবল একজন রিপাবলিকান সিনেটর, সুজান কলিন্স প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মনোনীত এই প্রার্থীর বিরুদ্ধে ভোট দেন। অ্যামি কোনি ব্যারেট প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচিত তৃতীয় বিচারপতি। সুপ্রিম কোর্টের মোট ৯ বিচারপতির মধ্যে এখন ৬ জন কনজারভেটিভ বা প্রো-রিপাবলিকান এবং ৩ জন প্রো-লিবারেল বা প্রো-ডেমোক্র্যাট। প্রো-লিবারেল বিচারপতি ৮৭ বছরের রুথ গিন্সবার্গ গত ১৮ সেপ্টেম্বর মারা গেলে সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতির একটি আসন শূন্য হয়। সাধারণত নির্বাচনের বছর এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে অর্থাৎ কোন বিচারপতি যদি মারা যান বা অবসরে যান, তাহলে নির্বাচনের পর নতুন বিচারপতির নিয়োগ দেয়া হয়। এর আগে বিল ক্লিনটন তার প্রেসিডেন্সির সময় সৃষ্টি হওয়া শূন্য আসনে নতুন বিচারপতি নিয়োগ দিতে চাইলে সে সময়কার বিরোধী দল, রিপাবলিকান পার্টির বিরোধের মুখে পড়েন এবং নিয়োগ দিতে ব্যর্থ হন। যে সময় এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল, সেটি নির্বাচনের বছর হলেও তখন নির্বাচনের আরো বেশ কয়েক মাস বাকি ছিল। অথচ সমস্ত প্রথা ভেঙে রিপাবলিকান দল সিনেটে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে নির্বাচনের আর মাত্র সাত দিন আগে অনেকটা গায়ের জোরে অ্যামি কোনি ব্যারেটকে নিয়োগ দিল। অ্যামির নিয়োগের মধ্যে দিয়ে সুপ্রিম কোর্টে কোন ‘ব্যালেন্স’ আর রইলো না এবং এখন বিচারকরা কতটুকু ‘নন-পার্টিজান’ হয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করেন সেটিই দেখার বিষয়। তবে কাগজে-কলমে যাই লেখা থাকুক না কেন, অনুমান করা হচ্ছে রিপাবলিকান দলের স্বার্থ রক্ষায় যা যা করার সুপ্রিম কোর্ট আগামী দিনগুলোতে তাই করবে। যুক্তরাষ্ট্রের উদারনৈতিকেরা মনে করেন, অ্যামি ব্যারেটের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ নিশ্চিত হওয়ায় নাগরিক অধিকারের বিষয়গুলো নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের ব্যাখ্যায় আগামী দিনে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা দিতে পারে। ডেমোক্র্যাটদের পক্ষ থেকে বলা হয়, অ্যামির অন্তর্ভুক্তিতে ‘ওবামা-কেয়ার’ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে নিজেদের অনুকূলে আনতে চায় রিপাবলিকান পার্টি। উল্লেখ করা যেতে পারে, যুক্তরাষ্ট্রের ভোটারদের কাছে স্বাস্থ্যসেবা একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। অ্যামি ব্যারেট বিচারব্যবস্থা ও নাগরিক অধিকার নিয়ে রক্ষণশীল ধারণার। রিপাবলিকান দল অনেক দিন ধরেই ‘ওবামা কেয়ার’ নামে যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আছে তা বাতিল করতে চেয়েছিল। এতদিন সেটি সম্ভব হয়নি কেননা তখন সুপ্রিম কোর্টে আজ যেটি ৬-৩ হলো, সেটি ছিল ৫-৪ অর্থাৎ পাঁচজন রিপাবলিকান ঘেঁষা এবং ৪ জন ডেমোক্র্যাট ঘেঁষা বিচারপতি।
এই নির্বাচনকে ঘিরে ইতিমধ্যে যে সমস্ত ঘটনা ঘটে গেছে তা সভ্য দেশ হিসাবে দাবিদার আমেরিকায় মোটেও মানায় না। ডোনাল্ড ট্রাম্প তার অদ্ভুদ, ‘আন-প্রেসিডেনশিয়াল’ আচরণের কারণে বিশ্বে আমেরিকার মান-সম্মান, ইমেজ যে মাটিতে লুটিয়ে দিয়েছেন তা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। অবাক লাগে, ২০২০ সালে আমেরিকার মত দেশে, যারা নিজেদের বিশ্ব-গণতন্ত্র রক্ষার একমাত্র পাহাড়াদার দাবি করেন এবং মোড়লগিরি করে বেড়ান, তাদের দেশে আজ গণতন্ত্রের কী বেহাল দশা। যেটি অবাক করার মতো ব্যাপার তা হলো, যে ব্যক্তিটি এই সমস্ত অপকর্মের জন্যে এককভাবে দায়ী, বিশাল একটি জনগোষ্ঠী তাকে অন্ধের মত অনুসরণ করছে এবং তার পক্ষে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়া ছাড়াও, সাধারণ জনগণকে, বিশেষ করে ডেমোক্র্যাট দলীয় সমর্থকদের, শেতাঙ্গদের ভয় ভীতি দেখিয়ে চলেছে। এই দৃশ্য আমাদের অঞ্চলে অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে যারা আমেরিকাকে বিশ্বের কাছে ‘হাস্যকর’ পর্যায়ে নিয়ে যাবার পেছনে কেবল ট্রাম্পকে দোষারোপ করেন, তাদের সাথে আমি একমত নই। ট্রাম্প কখনো রিপাবলিকান দলের সাথে সক্রিয়ভাবে ছিলেন না। তিনি উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন এবং একটা পর্যায়ে গোটা দলটাকে তিনি তার পকেটে পুরেছেন, যেমনি পকেটে পুরেছেন দলের এতদিনকার বাঘাবাঘা নেতা, পার্লামেন্টারিয়ান এবং সিনেট সদস্যদের। তারা কেন তার এই সমস্ত ‘ক্লাউন-সম’ ও ‘হাস্যকর’ কার্যকলাপ এবং গণতন্ত্রের জন্যে ক্ষতিকর পদক্ষেপের বিরোধিতা করছেন না।
নির্বাচনের যে পূর্বাভাস তাতে বলা যায়, এইভাবে চললে, হয়তো ডোনাল্ড ট্রাম্প হেলিকপ্টারে চড়ে বিদায় নেবেন। কিন্তু ব্যাপার হলো, নির্বাচনে পরাজিত হলেও তিনি সহজে যে ছাড় দেবেন না তা অনেকটা হলফ করে বলা যায়। তিনি চাইবেন বিষয়টিকে সুপ্রিম কোর্টে টেনে নিয়ে যেতে। জর্জ বুশ-আল গোর নির্বাচনও সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছিল। দুজনের ব্যবধান ছিল খুব সামান্য। কিন্তু আল গোর একজন আগাগোড়া ভদ্রলোক। তার মাশুল তিনি দিলেন বুশ দ্বিতীয়ের কাছে পুনরায় ভোট গণনা শেষ হবার আগেই পরাজয় স্বীকার করে। ট্রাম্প কোন মাপকাঠিতে একজন ভদ্র লোকের পর্যায়ে পড়েন না। কোন ভাগ্যগুণে কিংবা উপরওয়ালার কোন এক খামখেয়ালিপনায় ট্রাম্প পৌঁছে গিয়েছিলেন আমেরিকার মত একটি বিশাল ক্ষমতাধর দেশের প্রেসিডেন্টের আসনে। ভাবতে অবাক লাগে। তাই নির্বাচনকে ঘিরে পুরো নাটক শেষ না হওয়া তক কিছুতেই বলা যাচ্ছে না, ক্লাইম্যাক্সে কী অপেক্ষা করছে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট