মানুষের বয়স যত সামনের দিকে এগুতে থাকে, বুঝি তার চাইতেও দ্রুত গতিতে এই মন পিছু হাটে। বুঝি এটিই নিয়ম। ফেলে আসা দিনগুলি তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। সুখ-দুঃখ-আনন্দ-ভালোবাসা-বিরহ-বেদনার দিনগুলি মনে করে পুরানো দিনে ফিরে যায়। যা হারিয়েছে সে কথা ভেবে, যে চলে গেছে চিরতরে, কষ্ট পেলেও সে কথা ভেবে, তার কথা ভেবে এক ধরনের অজানা ভালোলাগায় পেয়ে বসে। সেটি জেনে, কিংবা না জেনেই বুঝি আমরা ফেলে আসা দিনগুলির কথা রোমন্থন করি। আজ সকাল থেকে বৃষ্টি পড়ছে। প্রকৃতির সাথে মানুষের মনের যে একটি যোগসূত্র আছে সে নতুন করে টের পাই। অথচ বৃষ্টি পড়ার কথা ছিলনা। অনেক কিছু যা হবার নয়, তা হয়, যা ঘটার নয়, তা ঘটে। মানুষের মধ্যে যেমন, প্রকৃতির মাঝেও। কেন জানিনে সকাল থেকে বাবাকে মনে পড়ছে। তাকে হারিয়েছি আজ থেকে ৩৭ বছর আগে। অথচ এখনো মনে হয়, ওই তো বাবা, খাটে হেলান দিয়ে আঁধশোয়া অবস্থায় আছেন। আমাদের প্রায় সবার জীবনে, জীবন গঠনে, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, বাবাদের প্রভাব বোধকরি সবচাইতে বেশি। বাবা হচ্ছেন সন্তানের দৃষ্টিতে ‘হিরো’।
আমার জীবনে বাবার প্রভাব অনেকখানি জুড়ে। আজকের এই যে আমি, আমার যে সামান্যটুকু প্রাপ্তি, তার সবটুকু তার কারণে। বাবা যদি আমায় প্রতিনিয়ত পেছন থেকে না ঠেলতেন, তাহলে আমার অবস্থান আজ যে কোথা হতো জানিনে। আমাকে নিয়ে ছিল বাবার গর্ব। বাবার বিশ্বাস কিংবা ধারণা আমার মেধা আছে, যেটি নেই তা হলো মেধার সদ্ব্যবহারে মেধার অধিকারীর কোন প্রচেষ্টা। আর সে কারণে প্রতিনিয়ত আমার জন্য বরাদ্দ ছিল চার শব্দের একটি ছোট বাক্য, ‘ও কোনোদিন মানুষ হবে না’। বাবার কাছ থেকে বকাঝকা যা খেয়েছি তা কেবল পড়াশুনা না করার কারণে। বাবার মত এমন বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তি দ্বিতীয়টি দেখিনি। তার কাছে লেখাপড়া ছাড়া আর কোন বিষয় ছিলনা। ছোটবেলা থেকে লক্ষ্য করেছি পরিচিত-অপরিচিত বা আত্মীয়-স্বজনদের যে সমস্ত ছেলেমেয়ে লেখাপড়ায় ভালো, তিনি তাদের বাড়তি স্নেহ করতেন। কাছে বসিয়ে আলাপচারিতায় মেতে উঠতেন। কলেজ-বিশ্ববিদ্যলয়ে পড়া সময়ে মোগলটুলি থেকে প্রায়শ বিকেলে আসতে দেখতাম দিবাকরদাকে। সুদর্শন দিবাকরদা যাকে আমরা বসুদা বলে ডাকতাম, তখন চট্টগ্রাম কলেজে ইংরেজীতে অনার্স পড়ছেন। বিশিষ্ট লেখক সাংবাদিক আবুল মোমেনের সাথে ছিল তার সখ্য, খুব সম্ভবত তারা একই ‘বেচমেট’। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করে সেখানেই লেকচারার হিসাবে যোগ দেন। পরবর্তী সময়ে আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিভাগে অনার্সে ভর্তি হই, তাকে এক বছরের জন্যে পেয়েছিলাম শিক্ষক হিসাবে। এর কিছুদিন পর তিনি চলে যান আমেরিকা। মার্কিন রমণীকে বিয়ে করে সেখানেই থিতু হয়েছেন। শিক্ষকতা করছেন। অনেক দিন কোন যোগাযোগ নেই। এখনো করছেন কিনা জানা নেই।
বাবার খুব স্নেহভাজন ছিলেন বসুদা। মনে আছে, কলেজিয়েট স্কুল থেকে মেট্রিক পাস দিয়ে ভর্তি হবার জন্যে চট্টগ্রাম কলেজে এডমিশন-টেস্ট দেই। কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র। আর কোন কলেজে ভর্তির আবেদন করিনি। দেখা গেলো উত্তীর্ণের তালিকায় আমার নাম নেই। আমার চাইতে বাবার টেনশন গেল বেড়ে। বাবা আমাকে চট্টগ্রাম কলেজের বাইরে চিন্তাও করতে পারেননা। বাবা নিজেও সে কলেজে পড়েছেন। চট্টগ্রাম কলেজ ছিল নগরীর সেরা কলেজ, সবদিকে। দিবাকরদা তখন চট্টগ্রাম কলেজে অনার্স ফাইনালে। ভালো ছাত্র বিধায় শিক্ষকদের প্রিয়ভাজন। কেবল ভালো ছাত্র নয়, বলা চলে তিনি ছিলেন সর্বগুণে গুণান্নিত। ভদ্র, বিনয়ী, লম্বা, দেখতে চমৎকার, নায়কোচিত, মাথাভর্তি কোঁকড়ানো চুল। বাবা তাকে খবর দিয়ে বাসায় ডেকে বললেন আমার কথা। দিবাকরদা বললেন, ঠিক আছে, আমি স্যারদের সাথে কথা বলে দেখি। তখন কলেজের ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল ছিলেন খুব সম্ভবত অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু সুফিয়ান। কলেজের জনৈক শিক্ষক বললেন, ‘আমরা সাধারণত কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্রদের বাদ দেইনা। যদিও দুষ্টু হিসাবে তাদের নাম আছে, তবে পড়াশুনায় তারা ভালো।’ ঠিক হলো, আমার আবার ইন্টারভিউ নেয়া হবে, প্রিন্সিপাল সাহেবের কামরায়। ইতিহাস বিভাগের এক শিক্ষক (এত বছরের ব্যবধানে নামটা মনে করতে পারছিনা) নানা প্রশ্ন করলেন। সবকটি প্রশ্নের উত্তর ভালোভাবেই দিলাম। বললেন, ‘ঠিক তো আছে, তবে আগে এমন কেন হলো?’ টিকে গেলাম। বাবা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। আমার কলেজ জীবন শুরু হলো। লেখাপড়া সেই আগের মত। পাঠ্য বইয়ের চাইতে লুকিয়ে, কোন সময় পাঠ্য বইয়ের নিচে গল্প-উপন্যাস রেখে পড়া। আর পরীক্ষার দিন-কয়েক আগে রাত জেগে পড়া এবং পাশ দেয়া।
বাবার বড়-সাইজের সরকারি বাসায় ঢুকতে বা-দিকে ছোট্ট কামরা। সেটি মেজদার পর আমার দখলে। পাশেই বারান্দার মত, অতিথি এলে সেখানেই বসতেন। সন্ধ্যের সময় বাবা বসতেন সেখানে, সোফায়। বাবার কারণে শব্দ করে পড়তে হতো। বাংলা ছিল আমার প্রিয় সাবজেক্ট। লেখালেখি করি তখন টুকটাক এদিক-ওদিক, লিটল ম্যাগাজিনে। বাংলা পড়তে শুনলেই বাবা ধমক দিয়ে বলে উঠতেন, ‘কেবল বাংলা, ইংরেজী পড়।’ ইংরেজি কোন শব্দ-উচ্চারণে ভুল করলে বারান্দা থেকে বাবা ঠিক করে দিতেন। পরীক্ষা হল থেকে বেরিয়ে বই ঘেঁটে সব প্রশ্নের উত্তর দেখে নিতাম। বাসায় ফিরে প্রথমেই যেতে হতো বাবার কাছে। বাবা প্রশ্ন হাতে একটার পর একটা জিজ্ঞেস করছেন, আর আমি অতি ভালো ছাত্রের মত সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। বাবা খুশী, আমিও বাঁচি আপাতত। ফলাফল সে তো কয়েক মাস বাদে। মেট্রিক পরীক্ষার সময় আমাদের সেন্টার ছিল মুসলিম হাই স্কুল। দু-বেলা পরীক্ষা। মাঝে ব্রেক। বাবা হাতে ডাব নিয়ে স্কুল গেইটে রৌদ্রে অপেক্ষা করতেন। তখন বুঝতে পারিনি, ছায়াবিহীন রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে বাবার কী কষ্ট হতো। বাবারা বুঝি এমনই। বাবার কাছে তিনটি বিষয় ছিল মুখ্য। এক. লেখাপড়া, দুই. লেখাপড়া, তিন, লেখাপড়া। এর বাইরে আর কিছু না। আমরা যে এলাকায় থাকতাম, তা ছিল সে সময় চট্টগ্রামের অন্যতম চমৎকার পরিবেশের একটি সরকারি পাড়া, নাম বয়লিউ এভিনিউ, নামে একটা কেমন আভিজাত্য আছে। মুখোমুখি প্রায় ১৮টি বাংলো-প্যাটার্নের বাসা। মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে কংক্রিটের রাস্তা। তাতে বাইরের কোন গাড়ি চলে না। প্রতিটি বাসার সামনে বড় আকারের মাঠ। যার যার সীমানা তারের-বেড়া দিয়ে ঘেরা। প্রতিটি বাসার গেইটের কাছাকাছি ল্যাম্পোস্ট। সন্ধ্যে হলেই তাতে বাতি জ্বলে উঠতো। ওই বাতি জ্বলে উঠার আগেই আমাদের পড়ার টেবিলে বসা চাই, বাবার নির্দেশ। তার কথা, ‘সন্ধ্যের পর ভদ্রলোকের ছেলেরা বাড়ির বাইরে থাকে না।’ মেয়েদের তো প্রশ্নই আসেনা। সকালে ঘুম থেকে উঠা, আর হিমালয়ে উঠা- আমার কাছে ছিল এক। বছরে একদিন কেবল ভোরের সূর্য দেখেছি, যদ্দিন বাবা সুস্থ ছিলেন। ‘মহালয়া’ উপলক্ষে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের ‘চন্ডীপাঠ’ শোনার জন্যে তিনি আমাদের ঘুম থেকে ডেকে তুলতেন। বছরের আর কোনদিন ‘সুবেহ-সাদেকের’ দেখা পেতাম না। বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে যখন সাংবাদিকতা করছি, তখনও তার ব্যত্যয় ঘটতো না। তখনও বাবার সেই বাক্য ‘ও কোনোদিন মানুষ হবে না’। ঘুম থেকে দেরিতে উঠার জন্য।
বাবা ছিলেন সংগীত-প্রিয়। অপর্ণাচরণ গার্লস স্কুলে পড়ার সময় দিদিকে চট্টগ্রামের সে সময়কার সেরা গানের শিক্ষক অনিল চৌধুরীকে রেখে গান শিখিয়েছিলেন। সুদর্শন এই শিক্ষক সব সময় পরিপাটি হয়ে আমাদের বাসায় আসতেন, পরনে ধুতি, পাঞ্জাবি। মা খুব যত্ন করে তার জন্য চা-খাবার তৈরি করতেন। অনিল চৌধুরী রেলওয়েতে চাকরি করতেন। ভোরে উঠে পেছনের কামরায় দিদি গলা ছেড়ে গানের চর্চা করতো আমার ঘুমের বারোটা বাজিয়ে। কিন্তু অবাক ব্যাপক খুব একটা বিরক্ত বোধ করিনি তখন। এক সময় ছোটবোন, মেজদা- ওরাও গানের চর্চা শুরু করে, হারমোনিয়াম নিয়ে। হারমোনিয়ামে কী করে গান তোলে সেইটা ভেবেই ওই দিকে পা বাড়াইনি, সাহস পাইনি। হারমোনিয়ামে আমার বিদ্যা সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি তক। তবে স্কুলের এক বার্ষিকী-অনুষ্ঠানে মঞ্চে উঠে গান গেয়েছিলাম। এর পেছনে বাবার উৎসাহ ছিল। অনুষ্ঠানের দিন কয়েক আগে রিহের্সাল দেবার জন্যে স্কুল থেকে আমাকে পাঠানো হলো অনিল বাবুর মেয়ে সবিতা চৌধুরীর কাছে। রেলওয়ে হাসপাতাল কলোনিতে তার বাসা। সবিতাদি ছিলেন স্কুলে আমার কয়েক ক্লাস সিনিয়র। তখন আমি সেভেনে। গেয়েছিলাম, আবদুল আলীমের গাওয়া ‘ঢেউ উঠেছে সাগরে, কেমনে পাড়ি ধরিরে, দিবানিশি কান্দি মরি….। এর কিছুদিন পর কোন এক বিয়েতে আমরা সবাই গ্রামে গেলাম। তখনকার দিনে মাইক লাগানো হতো গাছের ডগায়, যাতে গোটা গ্রাম, এমন কী পাশের গ্রাম থেকেও শোনা যায়। আমি মাইকওয়ালার পাশে গিয়ে বসতাম। লং-প্লেয়ারগুলি দেখতাম। ভালো লাগতো। বাবা ডেকে বললেন, ‘যা, স্কুলে যে গানটি করেছিলি সেটি মাইকে গিয়ে কর।’ দ্বিগুন উৎসাহে আবারো গাইলাম। সেই আমার শেষ গাওয়া গান। তবে সংগীতে যে নেশা, ভালো লাগা, তা বোধকরি বাবার কাছ থেকে পাওয়া। বাবার কারণেই ছোট বয়স থেকে পঙ্কজ কুমার মল্লিক, সাগর সেন, কণিকা বন্দোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এদের গাওয়া রবীন্দ্র সংগীতের সাথে পরিচিত হয়েছিলাম। শুরুতে খুব একটা ভালো না লাগলেও ধীরে ধীরে তা আমার ভেতরে সংক্রমিত হতে লাগলো। শান্তিনিকেতন থেকে ফিরে এসে বাবা বললেন, ‘জীবনে একবার হলেও ঘুরে আসবি।’ বাবা গিয়েছিলেন মাকে নিয়ে। ঠিক করে রেখেছিলাম একদিন যাবোই। কাছে অর্থাৎ দেশে যখন ছিলাম তখন যাওয়া হয়নি। গেলাম বাবা মারা যাবার ৩৫ বছর পর, ২০০২ সালে। শান্তিনিকেতনে কাটানো দিনগুলির, মুহূর্তগুলির অনুভূতি লিখে প্রকাশ করা যাবেনা। তারপরেও পত্রিকার এই পাতায় ১০টি সংখ্যা লিখেছি। লিখেছিলাম, মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদা আছে- অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা। শান্তিনিকেতন ঘুরে এসে নূতনভাবে উপলদ্ধি হলো। মনে হলো, বাঙালির আর একটি মৌলিক চাহিদা থাকা খুব প্রয়োজন, সে হলো, রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথকে না জেনে কিছুতেই পূর্ণাঙ্গ বাঙালি হওয়া যায় না। আমার যে রবীন্দ্র সংগীত প্রীতি, রবীন্দ্রনাথের প্রতি ভালোবাসা তা বাবার কারণে। যখন থেকে রবীন্দ্রসংগীত শোনা তখন ‘কথা’ খুব একটা বুঝতাম না কিংবা মনোযোগ দিয়ে শুনতাম না। পরে জেনেছি কথা ও সুর নিয়েই রবীন্দ্র সংগীত। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের জন্যে, ভালোলাগা, ভালোবাসা, দুঃখ, বিরহ, প্রিয়জনের বিয়োগ, প্রকৃতি, দেশ, কী না নিয়ে রবি ঠাকুর লেখেননি, গান রচনা করেননি। কিছু একটা বলতে চাইছি, কথা খুঁজে পাচ্ছিনে। তখন একমাত্র আশ্রয়স্থল রবীন্দ্রনাথ।
লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট