সম্মেলনের শুরু থেকেই এক ধরনের মানসিক অস্থিরতায় ছিলাম। ফলে স্বীকার করতে হয় যে সম্মেলনের প্রতি আমার ঠিকমত ‘জাষ্টিজ‘ করা হয়নি। সম্মেলনে যে পরিমাণ মনোযোগ দেবার ও সম্পৃক্ত থাকার কথা ছিল তেমনটি হয়নি। ফলে মনের ভেতর এক ধরণের অপরাধবোধ কাজ করছিল। কলম্বিয়া যাত্রার শুরু থেকে মাথার মধ্যে কেবল একটি কথাই ঘুরপাক খাচ্ছিল কী করে ফিরবো। কিন্তু এ ছিল আমার অনিচ্ছাকৃত। এমন পরিস্থিতির জন্যে আমি দায়ী ছিলাম না। উদ্ভূত পরিস্থিতে আমার এই দশা। ৩১ আগষ্ট, প্লেইন উড়াল দেবে মিনিট বিশেক পর। নিজ আসনে বসে আছি। দীর্ঘ আকাশ পথ, কম করে হলেও একটানা নয়, সাড়ে ন‘ ঘন্টা। বাসা থেকে শিফল এয়ারপোর্টের দূরত্ব প্রায় ৪০ কিলোমিটার। আত্মজ অতীশ সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ আমাকে শিফল এয়ারপোর্ট নামিয়ে দিয়ে ফিরে যায় তার দিদিমার বাসায়। সেখানে আছে তার মা। তার দিদিমা যাই যাই করছেন। ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছেন আর কোন আশা নেই। বয়সও হয়েছে, নব্বই পেরিয়েছেন। ইতিমধ্যে তার শরীরে মরফিন পুশ করা হয়েছে। যাতে শেষ বিদায়ের সময় যতটা সম্ভব ব্যথা কম পেয়ে বিদায় নিতে পারেন। কলম্বিয়া যাত্রার আগের দিন রাতে তাকে দেখে এসেছিলাম। তখন তিনি অচেতন। দু–চোখ বন্ধ। কোন সেন্স নেই। মরফিন চলছে। পাশে মনিটর। বেডের দুপাশে তার দুই মেয়ে –সুমনা ও পূরবী এবং ছোট পুত্রবধূ জয়া। ভেবেছিলাম, কলম্বিয়া থেকে ফিরে এসে তাকে পাবো। ‘মনে হয় তার আগেই উনি চলে যাবেন‘, কান্নাজড়িত কণ্ঠে সুমনার উত্তর। ফিরে আসা তো দূরের কথা, পরদিন খুব ভোরে, সোয়া ছ‘টায় তিনি সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন, চিরদিনের তরে। এই দুঃসংবাদটি পাই তার মৃত্যুর ঘন্টা তিনেক পর, যখন আমার ফ্লাইট ছাড়ার আর মাত্র মিনিট বিশেক বাকি। ওই মুহূর্তে আমার মনের দশা কী তা বলে কয়ে বুঝানো যাবেনা। প্লেন উড়াল দিলো। দীর্ঘ এই পথ যাত্রায় অনেকটা সময় জুড়ে ছিলেন আমার শাশুড়ি।
কলম্বিয়া পৌঁছে সংবাদটি তখনও আয়োজকদের কাউকে দেইনি। এসেই ওদের কীভাবে বলি আমাকে আগে ফিরে যেতে হবে। ওরা সবাই আমার ভালো পরিচিত। অনেক বছর ধরে এক সাথে অভিবাসন ইস্যু নিয়ে কাজ করছি। রাতে সবাই দল বেঁধে ডিনার শেষে হোটেলে ফিরে তাদের কয়েকজনকে এই দুঃসংবাদটি খুদে বার্তা পাঠিয়ে জানালাম। পরদিন সম্মেলন স্থলে পৌঁছে ওদের দেখা মিললে সবাই সমবেদনা জানায়। সম্মেলন সেক্রেটারিয়েটের স্টাফ, আফ্রিকীয় তরুণী অমু ও তার সহকর্মী এলেনাকে বলি, ‘আমার বোধকরি পুরো সম্মেলনে থাকা সম্ভব হবেনা। আমাকে আগে ফিরে যেতে হবে, কেননা ৫ সেপ্টেম্বর আমার শাশুড়িকে হেগ শহরে একটি অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে শেষ বিদায় জানানো হবে, তারপর তার মরদেহ যাবে দেশে। সম্ভবত আমাকেও দেশে যেতে হতে পারে।‘ তারা সবাই একবাক্যে বলে, ‘নো প্রবলেম। তোমার এই দুঃসময়ে কিছু করার প্রয়োজন হলে জানাবে।‘ কিছুটা স্বস্তি পেলাম। কেননা সম্মেলন আয়োজনে যে স্টিয়ারিং কমিটি আছে তার অন্যতম সদস্য আমি। এই সম্মেলন আয়োজনকে ঘিরে গত এক বছর ধরে প্রায় ১২টি ঝুম মিটিংয়ে অংশ নিয়েছিলাম। আমার যা–দেবার সে মোতাবেক পরামর্শ দিয়েছিলাম। সম্মেলনে যাওয়া, হোটেল সব খরচ আয়োজকের। তাই সংকোচ কিছুটা কাজ করছিল আমার মধ্যে। কিন্তু মূল আয়োজকদের সবার সহমর্মিতা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। সম্মেলনে প্লেনের টিকেট থেকে শুরু করে হোটেল এবং আনুষঙ্গিক লজিস্টিক সাপোর্টের জন্যে এনগেইজড ছিল ভারতীয় বংশোদ্ভূত এক তরুণী, নাম অমি ভাট। তাকে মেসেজ দিয়ে বিষয়টি জানাই। তাৎক্ষণিক উত্তরে সমবেদনা জানিয়ে অমি লিখে, ‘কোন সমস্যা নেই, তুমি জানিয়ো কী করতে হবে।‘ কিন্তু বললেই তো আর হলো না। ট্রাভেল এজেন্সির অফিস জেনেভায় আর আমরা তখন দক্ষিণ আমেরিকার দেশ কলম্বিয়ায়। দুদেশের মধ্যে দীর্ঘ সময়ের ব্যবধান। অমিকে সম্মেলনের কাজে ভীষণ ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। তার পেছনে লেগে থাকি। সে বলে, ‘ডোন্ট ওরি। টিকেট চেঞ্জ করা যাবে।‘ ইতিমধ্যে দুদিন হয়ে গেল। ট্রাভেল এজেন্সি অমিকে মেইল করে জানায়, এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছেনা। নিরুপায় হয়ে অমিকে বলি, ‘তুমি এজেন্সিকে বলো টিকেট চেঞ্জ করতে; না পারলে নতুন করে ফেরার টিকেট করতে, সেই টাকা আমি দেব। কেননা আমাকে ৫ তারিখে হল্যান্ড পৌঁছুতেই হবে। অমিকে এও বলি, রিওহাচা থেকে কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোতার টিকেট যেন আপগ্রেড করা হয়। সেই বাড়তি টাকাও আমি দেব। অত্যন্ত কোঅপারেটিভ মেয়ে অমি। শত ব্যস্ততায় সে তড়িঘড়ি করে কাংঙ্ক্ষিত টিকেট জোগাড় করে। টিকেট বিজনেস ক্লাসে আপগ্রেড করে। তার জন্যে আমাকে কোন বাড়তি টাকা দিতে হয়নি। বোধকরি তাকেও দিতে হয়নি। কেননা সম্মেলনের জন্যে প্রায় ৬০/৭০টি টিকেট কিনতে হয়েছে। সে কারণে ট্রাভেল এজেন্সি, অনুমান করি বাড়তি কোন টাকা দাবি করেনি। হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। তাকে ধন্যবাদ জানালে সে বলে, এটি আমার দায়িত্ব।
কলম্বিয়ায় আয়োজিত এই বছরের সম্মেলন ছিল ১৫তম। আকারে ও আয়োজনে এবারের সম্মেলন আগেরগুলির তুলনায় বেশ ছোট ছিল। তার পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে। ২০০৭ সালে যখন এই সম্মেলনের শুরু তখন মাইগ্রেশন, মাইগ্রেন্টদের অধিকার রক্ষার দাবিতে আমেরিকা–ইউরোপের সরকারগুলি বেশ সংবেদনশীল ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে জার্মানি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, স্পেনে বাঁধভাঙা স্রোতের মত শরণার্থী আসতে থাকে সিরিয়া, আফগানিস্তান, লিবিয়া সহ বিভিন্ন আফ্রিকীয় ও অনুন্নত দেশ থেকে। এক পর্যায়ে এদের অনেকে নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। ফলে আমেরিকা সহ ইউরোপের প্রায় সকল দেশে সাধারণ জনগণের মধ্যে শরণার্থীদের প্রতি বিরূপ মনোভাব গড়ে ওঠে। আর সাধারণ জনগণের এই মনোভাবকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলিতে উগ্র ডান রাজনৈতিক দলগুলির উত্থান ঘটে এবং ইতিমধ্যে বেশ কিছু দেশে তারা সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়। আমেরিকা সহ ইউরোপের সরকারগুলির অভিবাসন ইস্যুতে আগে তাদের যে সংবেদনশীল–মনোভাব ছিল, সেখান থেকে তারা সরে আসে। যুক্তরাষ্ট্র চরম কড়াকড়ি আরোপ করে, বর্ডার সীল করে দেয়, এমন কী ২০/৩০ বছর বসবাস করা অনেক বিদেশি নাগরিককে শক্তি প্রয়োগ করে স্বদেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। অমানবিকভাবে তাদের অনেককে হাতকড়া পরিয়ে জোর করে প্লেনে উঠিয়ে দেয়া হয়। অভিবাসনের প্রতি নেতিবাচক মনোভাবের কারণে কলম্বিয়ায় আয়োজিত এই শীর্ষ সম্মেলনে দুই একটি সরকার ছাড়া আর কেউ অর্থ সাহায্য দিতে এগিয়ে আসেনি। আর্থিক সংকট এমন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে সম্মেলন অনুষ্ঠান অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। সেই কারণে বিগত সম্মেলনগুলিতে যেখানে শতাধিক সিভিল সোসাইটি প্রতিনিধি নির্বাচিত হতো, এবার সেখানে মাত্র ৭০ প্রতিনিধি যোগ দিতে পেরেছেন। ট্রাম্প সরকার এমন বিরূপ আচরণ শুরু করলো যে অনেক প্রতিনিধি যাদের আমেরিকা হয়ে আসার কথা তাদের কেউ কেউ ট্রানজিট ভিসা পেলেন না। ফলে তাদের কলম্বিয়া আসা সম্ভব হয়নি। কেবল তাই নয়, শরণার্থী ও অভিবাসী নিয়ে যে সমস্ত সংগঠন কাজ করছে কিংবা শরণার্থীদের কোন ধরনের সহযোগিতা করছে তাদের কালো তালিকাভুক্ত করে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসার হুমকি দিলো ট্রাম্প সরকার। এমন বৈরী পরিস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবারের এই কলম্বিয়া শীর্ষ সম্মেলন। যাই হোক –
দ্বিতীয় দিন ছিল সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন। প্রধান অতিথি কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো। নির্দিষ্ট সময়ের কয়েক ঘন্টা পরে তিনি তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে উপস্থিত হন সম্মেলন স্থলে। চারিদিকে তুমুল করতালি ও শ্লোগান। চারিদিকে কড়া পাহারা। আমাদের টেক্সিকে সম্মেলন হলের বাইরে বেশ একটু দূরে থামিয়ে দিলে নিরাপত্তা কর্মীরা। চারিদিকে পুলিশ, সেনাবাহিনীর সদস্য, হাতে অস্ত্র, রাস্তার পাশে ট্যাংক। দেখেই টের পাই প্রেসিডেন্ট পেত্রোর নিরাপত্তার জন্যেই এই আয়োজন। ২০২২ সালে কলম্বিয়ার ১৭ তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত পেত্রো দেশের প্রথম বামপন্থী রাষ্ট্রপ্রধান। ছিলেন এক সময় গেরিলা যোদ্ধা। অনুষ্ঠানে স্পেনিশ ভাষায় দেয়া তার বক্তৃতা ছিল যাকে বলা যায় ‘জ্বালাময়ী‘। ভাষণের ইংরেজি, ফরাসি ও আরো কয়েকটি ভাষায় অনুবাদের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তার দীর্ঘ (প্রায় দেড় ঘন্টা) বক্তব্যের সিংহভাগ ছিল স্পেনিশ শাসন থেকে কলম্বিয়ার বেরিয়ে আসা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বৈরিতার কাহিনী। পশ্চিম ইউরোপ কীভাবে কলম্বিয়াকে শাসন শোষণ করেছে সেই ইতিহাসও তুলে ধরেন দেশ–বিদেশের (বেলজিয়াম) বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি ও মানবাধিকার নিয়ে উচ্চতর পড়াশোনা করা সুদর্শন এই রাজনীতিবিদ। দীর্ঘ ভাষণ কিছুটা বিরক্তিকর হলেও তার উপস্থাপনা, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, ক্যারিশমার কারণে ব্যক্তিগতভাবে আমার বেশ ভালো লেগেছে। দেখে মনে হয় এই রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রপ্রধান বেশ সাহসী। মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি ‘মুভমেন্ট ১৯ এপ্রিল‘ নামক এক গেরিলা দলে যোগ দেন। পরবর্তীতে এই দল ‘এম–১৯‘ হিসাবে একটি রাজনৈতিক দলে রূপ নেয়। পেত্রোকে ১৯৮৫ সালে কলম্বিয়ার সেনাবাহিনী অবৈধ অস্ত্র রাখার দায়ে গ্রেপ্তার করে। দীর্ঘ আঠার মাস কারাদন্ড ভোগ করেন গুস্তাভো পেত্রো। কারাবাসের সময় তিনি তার আদর্শে আমূল পরিবর্তন আনেন এবং জনসমর্থন অর্জনের জন্যে সশস্ত্র প্রতিরোধ আর ‘কার্যকর কৌশল‘ নয় মনে করে ১৯৮৭ সালে কলম্বিয়া সরকারের সাথে শান্তি আলোচনা শুরু করেন। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কলম্বিয়ার সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছে। ক্যারিবীয় অঞ্চলে সামপ্রতিক সময়ে মার্কিন হামলা সম্পর্কে জবাব চাওয়ার একদিন পর পেত্রো ট্রাম্পকে ‘অভদ্র এবং কলম্বিয়া সম্পর্কে অজ্ঞ‘ বলে অভিহিত করেন। এর আগে ট্রাম্প পেত্রোকে ‘অবৈধ মাদক ডিলার‘ অভিহিত করে এই বলে হুমকি দেন যে, যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ আমেরিকার দেশটিকে (কলম্বিয়া) তহবিল কমিয়ে দেবে। তবে অতি ক্ষমতাধর যুক্তরাষ্ট্রের দোরগোড়ায় অবস্থান করেও কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্কিন প্রেসিডেন্টের হুমকি–ধামকিকে খুব একটা তোয়াক্কা করছেন বলে মনে হয়না। এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র চাইছে দক্ষিণ আমেরিকাকে সিরিয়া কিংবা ইরাক বানাতে এবং কলম্বিয়ার গণতন্ত্র ধ্বংস করতে। (চলবে) ২০–১১–২০২৫।
লেখক : সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কলামিস্ট।












