হল্যান্ড থেকে

চমকে ভরা ডাচ জাতীয় নির্বাচন ফলাফল: কট্টর ডান নেতার আশাভঙ্গ

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ৮ নভেম্বর, ২০২৫ at ৫:১৬ পূর্বাহ্ণ

চমকে ভরা ছিল গেল ২৯ অক্টোবর অনুষ্ঠিত ডাচ পার্লামেন্ট নির্বাচন। চমক দেখা গেছে নির্বাচনী ফলাফলে। চমক দেখা গেছে নির্বাচনে প্রথম বিজয়ী দল হতে না পারার ব্যর্থতার দায় নিজ কাঁধে নিয়ে লেবার পার্টি নেতা ফ্রান্স টিমারমানের দলীয় নেতৃত্ব ত্যাগের ঘোষণার মধ্যে। আরো চমক হলো ডাচ রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রথমবারের মত প্রধান মন্ত্রী হতে যাচ্ছেন নিজেকে সমকামী হিসাবে প্রকাশ্যে ঘোষণা দেয়া ৩৮ বছরের রব ইয়েটে। চমক ছিল ইসলাম ও অভিবাসন বিরোধী কট্টর ডান নেতা, খিয়ের্ট বিল্ডার্সের দল ফ্রিডম পার্টির আশাভঙ্গ। বিল্ডার্সের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল এবারের নির্বাচনে তার দল গতবারের চাইতে বেশি আসন জয় করে সরকার গঠন করবে এবং তিনি হবেন আগামী পাঁচ বছরের জন্যে হল্যান্ডের প্রধান মন্ত্রী। কিন্তু সে আশা গুঁড়েবালি। নির্বাচনের সরকারি ফলাফল এখনো প্রকাশ করা হয়নি। দিন কয়েকের মধ্যে প্রবাসীদের দেয়া ভোটের ফলাফল দেশে এসে পৌঁছালে সরকারি ফলাফল ঘোষণা করা হবে। কিন্তু ইতিমধ্যে বেসরকারিভাবে মধ্যপন্থী ও সোশ্যাল ডেমোক্র্যাক্টস হিসাবে পরিচিত দল, ডি৬৬কে ১৫০ আসনের পার্লামেন্টে ২৬টি আসন লাভ করায় বেসরকারিভাবে নির্বাচিত ঘোষণা দেয়া হয়েছে, যদিও বা কট্টর ইসলাম ও অভিবাসীবিরোধী দল হিসাবে পরিচিত পার্টি ফর ফ্রিডম বা পেই ফেই ফেই সমান সংখ্যক (২৬) আসন লাভ করেছে। প্রশ্ন জাগতে পারে, দুটি দলই যখন সমান সংখ্যক আসন লাভ করলো সেক্ষেত্রে একটি দলকে কীভাবে বিজয়ী ঘোষণা করা সম্ভব। উত্তরে বলতে হয়দুই দল সমান সংখ্যক আসন পেলে, প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা অনুযায়ী এই ঘোষণা দেয়া হয়। এখনো পর্যন্ত যে ভোট গণনা হয়েছে তাতে ডি৬৬ প্রায় ১৫ হাজার বেশি ভোট পেয়ে এগিয়ে রয়েছে। প্রবাসে যে ভোট পড়েছে সে সংখ্যা প্রায় দেড় লক্ষ। তাতে পর্যবেক্ষকদের মতে ডি৬৬ এর পাল্লা ভারী হবার সম্ভাবনা বেশি। প্রথা অনুযায়ী যে দল বিজয়ী হয় সেদলকে প্রথমে সরকার গঠনে পদক্ষেপ নেবার জন্যে বলা হয়। সরকারি ফলাফল ঘোষণার আগেই এমন উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিলেন খিয়ের্ট বিল্ডার্স। তবে মজার ব্যাপার হলো, তার দল যদিওবা চূড়ান্ত ফলাফলে প্রথম স্থান অধিকার করে, তাহলেও তিনি সরকার প্রধান হতে পারতেন না। প্রথমত: এবারের নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দল এককভাবে সরকার গঠন করার মত আসন লাভ করেনি। হল্যান্ডের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই পর্যন্ত কোন দল এককভাবে সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়নি। ফলে এবারও গঠন হবে কোয়ালিশন সরকার। দ্বিতীয়ত: ইতিমধ্যে নির্বাচনে বিজয়ী অন্যান্য দলগুলির নেতারা জানিয়ে দিয়েছেন তারা খিয়ের্ট বিল্ডার্সের নেতৃত্বে কোয়ালিশনে যাবেন না। এর কারণ হিসাবে তারা বলেন, ‘বিগত ২০ বছর ধরে বিল্ডার্স আমাদের দেশে কেবল জনগণের মধ্যে বিভাজন ও ঘৃণা ছড়িয়েছে। ইসলাম, অভিবাসন ইস্যু নিয়ে তিনি বিভিন্ন গোষ্ঠীকে কলংকিত করতে চেয়েছেন,’ যা তারা বলেন, ‘ডাচ কৃষ্টি ও নর্মের সাথে যায়না।’ ঠিক একই কারণে বছর দুই আগে যে নির্বাচন হয়েছিল তাতে বিল্ডার্সের দল শীর্ষে অবস্থান করলেও তিনি সরকার প্রধান হতে পারেননি। তখন অন্যান্য দলগুলি বেঁকে বসে এই বলে, বিল্ডার্স প্রধান মন্ত্রী হলে তারা তার দলের সাথে কোয়ালিশন সরকারে যাবেনা। ফলে তিনি তার পছন্দের এক অরাজনৈতিক ব্যক্তিকে (গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান) প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ দিয়ে সরকারের বাইরে থেকে মূল কলকাঠি নাড়তে থাকেন। মাইগ্রেশন ও শরণার্থী ইস্যুতে ইউরোপীয় নীতিমালার বিরুদ্ধে গিয়ে তার প্রস্তাবিত পদক্ষেপ মেনে নিতে বিগত কোয়ালিশন সরকারে থাকা অন্যান্য দলগুলি গররাজি হলে, বিল্ডার্স সরকার থেকে তার দলের সমর্থন প্রত্যাহার করে নেন। ফলে অসময়ে সরকারের পতন হয়। জরুরি হয়ে পড়ে আগাম নির্বাচন। আর সেই সূত্র ধরে গত ২৯ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হলো জাতীয় নির্বাচন।

খিয়ের্ট বিল্ডার্স আশা করেছিলেন আগামনির্বাচন হলে তার দল আরো বেশি আসন লাভ করবে এবং এককভাবে সরকার গঠন করে তার ইচ্ছে মাফিক নীতিমালা বিশেষ করে মাইগ্রেশন বা শরণার্থী বন্ধ রোধে কঠোর পদক্ষেপ নেবেন। একথা সত্যি বৃহৎ ডাচ জনগোষ্ঠী অবৈধপথে আসা শরণার্থীদের জন্যে হল্যান্ডের দরোজা বন্ধ করে দেয়ার পক্ষে। কেবল তাই নয়, বিদেশিদের বিরুদ্ধে তাদের মনোভাবও বিরূপ হয়ে উঠছে দিনদিন। আর এই বিরুদ্ধমনোভাব কাজে লাগিয়ে, এটিকে নির্বাচনী ইস্যু করে বিল্ডার্স ধরে নিয়েছিলেন এবারের নির্বাচনে ভালোভাবে উৎরে যাবেন। তেমন সম্ভাবনাও ছিল। ছিল বলেই বাম ও মধ্যপন্থী দলগুলি এককাট্টা হয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় তার বিরুদ্ধে মেতে উঠেছিল। তারা বিগত সরকারের আগাম পতনের কারণ হিসাবে বিল্ডার্সকেই দায়ী করেন এবং এই কথাটি স্পষ্ট করেন যে, বিল্ডার্স নির্বাচনে জয়ী হলেও তারা তার সাথে নেই। তখন ভোটারদের অনেকেই এই ভেবে তার দিক থেকে সরে আসেন যে, বিল্ডার্স যদি এবারও জয়ী হন তাহলে যে কোয়ালিশনসরকার হবে তার ভাগ্যও কদিনের মাথায় বিগত সরকারের মতো হবে, শক্ত কোন সরকার হবেনা। ফলে দেশের উন্নয়ন ব্যাহত হবে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা এই কারণেও অনেকে বিল্ডার্স থেকে মুখ সরিয়ে নিয়েছেন।

) অনেকে ধরে নিয়েছিলেন লেবার পার্টি ও গ্রিন পার্টির সমন্বয়ে গঠিত মোর্চা বৃহত্তম বিজয়ী দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করবে। এই দুই দলের গঠিত মোর্চার নেতৃত্বে ছিলেন ইউরোপীয় রাজনীতিবিদ লেবার পার্টি নেতা, ৬১ বছরের ফ্রান্স টিমারমান। ডাচ রাজনীতিতে বর্তমানে যারা সক্রিয় আছেন তাদের মধ্যে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় বলা যায় ফ্রান্স টিমারমান সবার অগ্রে। তিনি ২০১৪ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ইউরোপীয় কমিশনার এবং ইউরোপীয় কমিশনের প্রথম সহসভাপতি হিসেবে দায়ত্িব পালন করেন। ইউরোপীয় কমিশনার হওয়ার আগে তিনি ১৯৯৮ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত লেবার পাটির্র হয়ে ডাচ রাজনীতিতেও সক্রিয় ছিলেন। ছিলেন ডাচ সংসদ সদস্য, ইউরোপীয় বিষয়ক স্টেট সেক্রেটারি এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী। চমৎকার বলেন, ভালো ইংরেজি বলেন। প্রাকনির্বাচনী সময়ে জাতীয় পর্যায়ে যে কটি বিতর্কের আয়োজন করা হয়েছিল তাতে তিনি চমৎকারিত্ব দেখিয়েছিলেন। তবুও জনগণ শেষ মুহূর্তে তার দিক থেকে মুখ সরিয়ে নিয়ে মধ্যপন্থী ও সোশ্যাল ডেমোক্র্যাক্টস নেতা ৩৮ বছরের রব ইয়েটেকে ভোট দেন। অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন ফ্রান্স টিমারমানের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার ঝুলি যেহেতু অন্য নেতাদের চাইতে ভারী তিনি নির্বাচনী দৌড়ে প্রথম হবেন। কিন্তু হননি। ফলে অনেকটা হতাশ হয়ে নির্বাচনী দিনের শেষে দলের নেতাকর্মীসমর্থকদের এক সমাবেশে দলের নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। এই ঘোষণা ছিল অপ্রত্যাশিত। আশানুরূপ ফলাফল অর্জনের এই ব্যর্থতাকে নিজের কাঁধে নিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন প্রয়োজন দলের নেতৃত্ব পরবর্তী জেনারেশনের হাতে তুলে দেয়া।কী চমৎকার ও শিক্ষণীয় ত্যাগ। তার বয়স মাত্র ৬১ বছর। তার দল (লেবার পার্টি ও গ্রিন পার্টির সমন্বয়ে গঠিত মোর্চা) পেয়েছে ২০টি আসন। গতবারের চাইতে ৫টি কম। ইতিমধ্যে গ্রিন পার্টি প্রধান জেসি ক্লাভার ফ্রান্স টিমারমানের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন এবং মোর্চার হাল ধরেছেন। মোর্চার আরো দুই মহিলা নেত্রী এসমাহ লাহলাহ ও মারিওলেইন মুরমান নতুন দলীয় প্রধান হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন শোনা গেলেও পরবর্তীতে তারা নিজ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন এই বলে, জেসি ক্লাভার অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ এবং তিনি মোর্চাকে নেতৃত্ব দেবার যোগ্যতা রাখেন। সুদর্শন ক্লাভারও রব ইয়েটের মত তরুণ। বয়স ৩৯, জন্ম ১৯৮৬ সালের ১ মে। তরুণ হলেও তিনি ২০১০ সাল থেকে ডাচ পার্লামেন্টের নির্বাচিত সদস্য। ২০১৫ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত তিনি পার্লামেন্টে দলীয় প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এখন দেখা যাক আগামী দিনগুলিতে তিনি দলকে তথা মোর্চাকে কীভাবে জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে সক্ষম হন।

নির্বাচন তো হলো। চুড়ান্ত সরকারি ফলাফল ঘোষণার এখনো বাকি। তবে শেষ পর্যন্ত খিয়ের্ট বিল্ডার্স সহ পার্লামেন্টে নির্বাচিত ১৫টি দলের নেতারা সময় ক্ষেপণ না করে দেশের স্বার্থে কোয়ালিশন সরকার গঠনের লক্ষ্যে ডি৬৬ নেতা রব ইয়েটের নেতৃত্বে আলোচনা শুরু করতে সম্মত হয়েছেন। আর এই আলোচনা সমন্বয় করতে নিয়োগ দেয়া হয়েছে ডি৬৬ এর প্রাক্তন সমাজ উন্নয়ন মন্ত্রী, বর্তমানে নেদারল্যান্ড রেলওয়ে (এন এস) প্রধান, বাউতার কুলমেইসকে। আনুষ্ঠানিক আলোচনা ও দেনদরবার দুএকদিনের মধ্যে শুরু হবে এবং বাউতার কুলমেইস ১১ নভেম্বর তার রিপোর্ট পেশ করবেন। পরদিন অর্থাৎ ১২ নভেম্বর নুতন পার্লামেন্ট বসবে। অনুমান করা যাচ্ছে ডি৬৬, ক্রিস্টিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টি (সিডিএ), ফেই ফেই ডে এবং গ্রিন পার্টি ও লেবার পার্টির সমন্বয়ে গঠিত মোর্চাকে নিয়ে নুতন কোয়ালিশন সরকার গঠন করা হবে। তেমনটি হলে আগামী সরকার স্থিতিশীল হবে বলে আশা করছেন স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। দেখা যাক কেমনটি হয়। (১১২০২৫)

লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমাদের সামাজিক পরিবেশ ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন
পরবর্তী নিবন্ধসুস্থ সূচনা, আশাব্যঞ্জক ভবিষ্যৎ: বাংলাদেশের জন্য এক হেলথ দৃষ্টিভঙ্গি