গেল সংখ্যায় এসে থেমেছিলাম বলিউড নায়িকা কারিনা কাপুর অভিনীত, প্রযোজিত ইংরেজি ও হিন্দি–ভাষায় নির্মিত ছায়াছবি ‘The Buckingham Murders’ শেষ করার মধ্যে দিয়ে। টিভি স্ক্রিনে দেখি তখনও কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোতা পৌঁছানোর আরো ঘন্টা সাড়ে তিনেক বাকি। মনে হচ্ছে সময় এগুচ্ছে না, যেন থমকে আছে। যে–সময় ফেলে এসেছি সে আজ ‘অতীত‘। কাল যা হবে তা ‘ভবিষ্যৎ‘। আর ‘আজ‘ ইংরেজিতে যা Present, তার বাংলা অর্থ হলো ‘উপহার‘। এর নিগূঢ় অর্থ, আজকের সময়টাকে উপহার হিসাবে গ্রহণ করে উপভোগ করো। থাক তত্ত্ব কথা। ঘুম আসছে না। কিছু না করে চুপচাপ বসে থাকাও কষ্টকর। স্ক্রিনে স্ক্রল করে খুঁজে পেলাম ডাচ ভাষায় নির্মিত বিখ্যাত ছায়াছবি ‘Zwarteboek’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উপর ভিত্তি করে বেশ কয়েক বছর আগে নির্মিত এই ছবিটি দেখেছিলাম। হিটলার–বাহিনী যখন হল্যান্ড দখল করেছিল তখন বেশ কিছু দেশপ্রেমী ডাচ নাগরিক যে দুঃসাহসী–প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল তার কাহিনী এবং অবশেষে হল্যান্ড মুক্ত হবার মধ্যে দিয়ে ছবিটির কাহিনী শেষ হয়। এই ছবিটি ২০০৮ সালে হল্যান্ড ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সর্বকালের সেরা ডাচ চলুমুত্র হিসাবে নির্বাচিত হয়েছিল। এছাড়াও ইউরোপের বেশ কটি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ছবিটি পুরস্কৃত হয়েছিল। দেড় ঘন্টার ছবি শেষ করার পরও দেখি বোগোতা পৌঁছার আরো সোয়া দুই ঘন্টা বাকি। তখন আমাদের বিশাল উড়োজাহাজটি অতলান্তিক মহাসাগরের উপর দিয়ে এগিয়ে চলেছে। টিভি স্ক্রিনে দেখতে পাচ্ছি বিশাল জলরাশির মধ্যে কয়েকটি ছোট ছোট দ্বীপ। চৌত্রিশ হাজার ফুট উঁচু থেকে পর্দায় দেখে (খালি চোখে কিছু দেখা যায়না) মনে হয় কিছু কচুরিপানা স্থির দাঁড়িয়ে আছে। ছোট এই দ্বীপগুলি হলো ব্রিজটোন, ফোর্ট দি ফ্রান্স, সেইন্ট জোন্স। বোগোতা পৌঁছার ঠিক এক ঘন্টা দশ মিনিট আগে পর্দায় ভেসে এলো ভূমি। দেখতে পাচ্ছি বোগোতা, সান কার্লোস। একুয়াডোরও।
বোগোতা থেকে আমাকে ধরতে হবে কানেকটিং ফ্লাইট। তারপর আরো এক ঘন্টা ৪৫ মিনিট উড়াল দিতে হবে। সমস্যা হলো বোগোতা এয়ারপোর্ট আকারে বেশ বড় এবং ট্রানজিটে আমার হাতে সময় মাত্র দেড় ঘন্টা। এই প্রথমবার আমার কলম্বিয়া আসা। এত কম সময়ে এতো বড় এয়ারপোর্টে (এল ডোরাডো ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট) কানেকটিং ফ্লাইট মিস করার সমূহ সম্ভাবনা। মনের মধ্যে ভয় ছিল। আরো সমস্যা দেখা দিল যখন দেখলাম, গোটা এয়ারপোর্টে ইংরেজিতে লেখা কোন বোর্ড নেই। চারিদিকে স্পেনিশ ভাষায় লেখা। কিছুদূর গিয়ে স্পেনিশ ভাষায় ‘ট্রান্সফার‘ বোর্ড দেখতে পাই। অনুমান করি এটিই হবে। এয়ারপোর্টের এক কর্মীকে জিজ্ঞেস করলে সে উত্তরে কী বললো কিছুই বুঝলাম না। আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টে কাজ করে অথচ এক অক্ষর ইংরেজি জানেনা দেখে হতাশ হওয়া ও মনে মনে গালি দেয়া ছাড়া আমার করার আর কিছু ছিলনা। কানেকটিং–এ লম্বা লাইন। ভদ্রতা দেখিয়ে লাইনে দাঁড়ালে এখানেই আমার ঘন্টা খানেক লেগে যাবে। ‘সরি‘ বলে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের পাশ কেটে এগিয়ে যাই সামনের দিকে। ওদের বলি, ‘এক ঘন্টা পর আমার কানেক্টিং ফ্লাইট‘। কোন আপত্তি বা বিরক্তি নেই কারো মুখে। জায়গা ছেড়ে দেয়। সারিবদ্ধ অনেকগুলি কাউন্টার। পাসপোর্ট এগিয়ে দেই। ভিসা ছিল না। ইউরোপীয় পাসপোটের্র জন্যে ভিসার প্রয়োজন নেই। জানতে চাইলো কী কারণে কলম্বিয়া আসা, ক‘দিনের জন্যে এবং হোটেলের নাম। ‘হোটেল রিবাই‘ বলতেই পাসপোর্টে স্ট্যাম্প লাগিয়ে ফিরিয়ে দেয়। যেহেতু ভাষাগত সমস্যা, ইংরেজিতে কোন দিক নির্দেশনা নেই, বাধ্য হয়ে এক ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করে জানতে চাইলাম, রিওচা (জরড়যধপযধ) যাবার জন্যে কোনদিকে যেতে হবে। ভদ্রলোক কিছু বুঝলেন বলে মনে হলোনা। রিওচা পৌঁছে টের পেলাম উনি আমার প্রশ্ন কেন বুঝলেন না। ‘জরড়যধপযধ‘ আমার উচ্চারণে দাঁড়িয়েছিল ‘রিওহাচা‘। পরে জানলাম সেটির সঠিক উচ্চারণ হলো ‘রিওচা‘। কী করে জানবো উচ্চারণে ইংরেজি বানানের দুটি বর্ণ উহ্য থাকবে। আমার বাপের জন্মেও এই নাম যে শুনিনি। সে কি আমার দোষ? কারো ঘাড়ে দোষ না চাপিয়ে খুঁজতে থাকি, যাকে দেখে মনে হতে পারে কিছুটা হলেও ইংরেজি বলতে কিংবা বুঝতে পারে। পেয়ে গেলাম এক যাত্রীকে। তার কাঁধেও আমার মত ব্যাগ। তিনি বললেন, আপনাকে প্রথমে বের হতে হবে এখান থেকে, তারপর যেতে হবে ‘ডোমেস্টিকে‘। আমার সাথে চলুন, আমিও ঐদিকটায় যাচ্ছি।‘ যখন নির্দিষ্ট গেইটে পৌঁছি তখন বোর্ডিং শুরু হয়ে গেছে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। আভিয়ানকা এয়ারলাইন্সের নিজস্ব বাহন। মাঝারি আকারের প্লেন। আভিয়ানকা এয়ারলাইন্স বিশ্বের প্রাচীনতম বিদ্যমান বিমান সংস্থাগুলির মধ্যে অন্যতম। এর প্রতিষ্ঠাকাল ১৯১৯ সাল। এর ঠিক একশত বছর আগে অর্থাৎ ১৮১৯ সালে কলম্বিয়া স্পেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীনতার তিন বছরের মাথায় ১৮২২ সালে স্বীকৃতি দেয় এবং ১৮২৩ সালে কলোম্বিয়ায় মার্কিন কূটনৈতিক মিশন খোলা হয়। কলম্বিয়ার সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক অম্লমধুর। কলম্বিয়ার স্বাধীনতার পর থেকে দুই শতাব্দী ধরে ওয়াশিংটন এবং বোগোটার মধ্যে সম্পর্ক একটি ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা অংশীদারিত্বে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু সময়ে সময়ে মার্কিন–হস্তক্ষেপ, ভূরাজনৈতিক শীতল–যুদ্ধ এবং মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কারণে এই দুই দেশের সম্পর্ক টানাপোড়ানোর শিকার হয়।
দু–দেশের মধ্যে বর্তমান সম্পর্ক এমন নিম্নমুখী যে সমপ্রতি নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ অধিবেশন চলাকালীন কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো মার্কিন সৈন্যদের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশ অমান্য করার আহবান জানান। পেত্রো নিউ ইয়র্কের রাস্তায় ফিলিস্তিনিদের পক্ষে আয়োজিত বিক্ষোভে এই আহবান জানান। এতে স্বাভাবিকভাবে ক্ষেপেছে আমেরিকা। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্টের এই মন্তব্যকে ‘বেপরোয়া জ্বালাময়ী‘ বলে বর্ণনা করে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের জন্য কলম্বিয়ার এই নেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন। সমপ্রতি ক্যারিবীয় অঞ্চলে মাদক পাচারকারী নৌকাগুলিতে ট্রাম্প প্রশাসনের বিমান হামলার তদন্তের আহবান জানান প্রেসিডেন্ট পেত্রো। আমেরিকা জানিয়েছে তারা কলম্বিয়ার রাষ্ট্রপতি গুস্তাভো পেত্রোর ভিসা বাতিল করবে। তবে যখন এই ঘোষণা এলো ততক্ষণে কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট পেত্রো আমেরিকা ত্যাগ করেন।
তুখোড় বক্তা ও শিক্ষাবিদ গুস্তাভো পেত্রো কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে ব্যাচলার ডিগ্রি অর্জন করার পর বেলজিয়ামের ইউনিভার্সিটি ক্যাথলিক দ্য লুভ্যানে অর্থনীতি ও হিউম্যান রাইটস নিয়ে পড়াশেনা করেন। এছাড়া স্পেনের উনিভার্সিটি অফ সালামাঙ্কা থেকে পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিষয়ে ডক্টরাল ডিগ্রি লাভ করেন। সতের বছর বয়সে তিনি কলম্বিয়ার এক গেরিলা দলে যোগ দেন এবং এর ১৭ বছর পর রাজনীতিতে যোগ দেন। আমার সৌভাগ্য হয়েছে কাছ থেকে তার বক্তব্য শোনা। যে–সম্মেলনে আমার কলম্বিয়া যাওয়া, সেই সম্মেলনে তিনি এসেছিলেন এবং ভাষণ দিয়েছিলেন। স্প্যানিশ ভাষায় দেয়া তার প্রায় দেড় ঘন্টা ভাষণে তিনি আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলিকে তাদের শোষণনীতির তীব্র সমালোচনা করেন। কলম্বিয়ার এই বিপ্লবী নেতা বলেন, ‘প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মতো, আমি চাই তরুণরা, শ্রমিক ও কৃষকদের ছেলেমেয়েরা, ইসরায়েল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়েরই, তাদের রাইফেল মানবতার দিকে নয়, বরং অত্যাচারী এবং ফ্যাসিস্টদের দিকে তাক করুক।‘ মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর তার এই মন্তব্যের তীব্র সমালোচনা করে বলে, তিনি ‘মার্কিন সৈন্যদের আদেশ অমান্য করতে এবং সহিংসতা উস্কে দিতে‘ আহবান জানিয়েছেন।
প্রেসিডেন্ট পেত্রোর স্প্যানিশ ভাষায় দেয়া বক্তব্য অনুবাদের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেই জন্যে এক ধরনের বিশেষ অনুবাদ–যন্ত্রের ব্যবস্থা ছিল। আমাদের বলা হলো পাসপোর্ট বা আইডি জমা দিয়ে এই যন্ত্র নেয়া যাবে। যদি হারিয়ে যায় এই ভয়ে পাসপোর্ট বা আইডি কোনোটাই না দিয়ে নিজের ড্রাইভিং লাইসেন্স দিলাম। তাতে ছবি আছে। সেটিকে পাসপোর্ট কিংবা আইডি –দুটোর একটি ধরে নেয় সম্মেলন হলের বাইরে ডেস্কের সামনে বসে থাকা কয়েকটি স্কুল–কলেজগামী ভলান্টিয়ার। ক্যারিশমেটিক ও সুদর্শন এই রাজনীতিবিদ যার পুরো নাম গুস্তাভো ফ্রান্সিসকো পেত্রো উরেগো ২০২২ সালে কলম্বিয়ার ৩৫তম প্রেসিডেন্ট হিসাবে নির্বাচিত হন। তিনি কলম্বিয়ার সামপ্রতিক ইতিহাসের প্রথম বামপন্থী প্রেসিডেন্ট। তার ভাষণ, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ উপস্থিত সবাইকে মুগ্ধ করে। আমাকে তো বটেই। তার বক্তব্যের অনেক অংশ জুড়ে ছিল পশ্চিম ও আমেরিকার অনুসৃত নীতির তীব্র সমালোচনা। জানিনে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ওই সমস্ত দেশের উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারা কিভাবে হজম করেছিলেন। তবে মুগ্ধ হয়ে শুনেছিলাম তার বক্তব্য। একই মন্তব্য করলেন আমার পাশে বসা বাংলাদেশ থেকে আসা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক তরুণ কর্মকর্তা। এই সম্মেলনে বাংলাদেশ সহ ৪২টি দেশের সরকারি প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
যাই হোক– নির্দিষ্ট সময়েই রিওচা পৌঁছে গেলাম। ছোট্ট বিমানবন্দর। একটি মাত্র লাগেজ বেল্ট। চট্রগ্রাম এয়ারপোর্টের চাইতে অনেক ছোট। আমার কেবল একটি হ্যান্ড লাগেজ ও ল্যাপটপ ব্যাগ। ফলে লাগেজ বেল্টে যাবার কোন প্রয়োজন নেই। এয়ারপোর্টের ভেতর দেখলাম কয়েক তরুণ–তরুণী স্প্যানিশ ভাষায় লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা প্রতিনিধিদের সুবিধার্থে এরা সেখানে অপেক্ষা করছিল। ভাষার কারণে সেটি টের পাইনি। ফলে তাদের পাশ কাটিয়ে বের হবার জন্যে এগিয়ে ছোট্ট হলঘরের এদিক–ওদিক খুঁজতে থাকি, কেউ এসেছে কিনা রিসীভ করার জন্যে। ধরে নিয়েছিলাম ইংরেজিতে লেখা কোন বোর্ড থাকবে। অপেক্ষা করছি এমন সময় একজন আমার কাছে এসে জানতে চাইলেন মাইগ্রেশন–সম্মেলনে এসেছি কিনা। হ্যাঁ–সূচক উত্তর দিতেই ওই লোক ডান দিকের একটি ডেস্কে যাবার পরামর্শ দিলেন। নাম বলতেই সেখানে থাকা এক কর্মী বললেন, তাড়াতাড়ি করুন, বাইরে গাড়ি অপেক্ষা করছে। বের হয়ে দেখি একটি মাইক্রোব দাঁড়িয়ে। তখন দুপুর সাড়ে চার। বাইরে প্রচন্ড গরম। গায়ের কোট হাতে নিয়ে মাইক্রোতে গিয়ে বসি। ভেতরে যারা বসে আছেন তারা সবাই অপরিচিত। বেশিরভাগ আফ্রিকীয়। এয়ারপোর্ট থেকে খুব দূরে নয় হোটেল। রাস্তার দু–ধারে দোকানপাট, বাসাবাড়ি, রাস্তার দশা দেখে প্রথম দর্শনে মনে হলো গরিব কোন দেশে এলাম। মিনিট পনেরর মধ্যে গাড়ি এসে থামলো হোটেলে। রিসিপশনে বিভিন্ন দেশ থেকে সম্মেলনে যোগ দিতে আসা ডেলিগেটসদের ভিড়। (চলবে) – ০২–১০–২০২৫।
লেখক : সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কলামিস্ট।