হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ২৬ জুলাই, ২০২৫ at ৫:৪৬ পূর্বাহ্ণ

বাসা থেকে যখন বেরুচ্ছি তখন বিকেল পাঁচটা। মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই ট্রাম স্টপেজ। ট্রাম ধরে শপিং সেন্টারে পৌঁছুতে মিনিট তিরিশেক লেগে যায়। অফিসশেষে নির্দিষ্ট মলে (সিএন্ডএ) অপেক্ষা করবে সুমনা। সেখানে কাজ শেষে সে ফিরে যাবে তার অসুস্থ মায়ের কাছে। আমি আমার ডেরায়। রিয়ার মেয়ের মত আমাদের দু’ ছেলেমেয়েও থাকে ভিন্ন দুই শহরে। ওরা মাঝে মধ্যে আসে আমাদের সাথে কিছুটা সময় কাটাতে। ইউরোপে জীবন মেশিন, চলে সময় ধরে। অবসর সময় কোথায়? এখন এই বাড়িতে আমরা কেবল দুটি প্রাণী। একটা সময় সবাই মিলে কত প্রাণোচ্ছল ছিল। এটাই বুঝি জীবনের ধারা। একটা সময় একা হয়ে পড়ে মানুষ। ছেলেমেয়ে বড় হয়, যে ঘরে ওদের জন্ম, বেড়ে ওঠা, সে ঘর ছেড়ে নিজের ঘর গড়ে। মাবাবা একা হয়ে পড়ে। কখনো মা একা, কখনো বাবা। পরিস্থিতির কারণে। এক একজনের ‘সিচুয়েশন’ এক এক ধরনের। আমার কথাই যদি ধরি কয়েক মাস ধরে আমিও এই তেতলা বড় বাসায় একা। মায়ের কারণে সুমনাকে সপ্তাহের বেশি সময়টা সেখানেই কাটাতে হয়। মাঝে মধ্যে আসে রান্নাবান্না করতে। তার উপর তার শখের বাগান ঠিকঠাক করতে, গাছে পানি দিতে, নুতন ফুলের চারা লাগাতে। তার কাজেরও শেষ নেই। অন্যদিকে আমি চাকরি থেকে আগবাড়িয়ে অবসর নিয়েছি, এখানে বলে ‘আর্লি পেনশন’। চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি বটে, তবে ‘কাজ’ থেকে নয়। পরিচিতজনরা বলে, আমি নাকি ‘ওয়ার্ককোহোলিক’। মাঝে মাঝে ভাবি, মানুষ কাজ নাকরে থাকে কী করে। কাজ বলতে যে কেবল সকালবিকাল চাকরি তা তো নয়। চাকরির বাইরেও তো অনেক কাজ। জীবিকার জন্যে নয়, জীবনের প্রয়োজনে।

বলছিলাম রিয়ার কথা। ঠিক দরোজার সামনে দাঁড়িয়ে রিয়া কথা বলে চলে। ডাচ প্রতিবেশী আরো যারা আছে তাদেরও দেখি দেখা হলে দরোজার সামনে দাঁড়িয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলে চলে। কাউকে বলতে শুনিনা বা দেখি না বাসার ভেতরে ডেকে চাকফি খাইয়ে আড্ডা দিতে। প্রথম দিকে বিষয়টা আমার কাছে অস্বাভাবিক লাগতো, অসুন্দর লাগতো। বুঝি একেই বলে ‘কালচারাল শক’। আমার দৃষ্টিতে যা অস্বাভাবিক, ওদের দৃষ্টিতে হয়তো সেটিই স্বাভাবিক। এও দেখেছিমাবাবা সন্ধের সময় ডিনারে বসেছে। এমন সময় ছেলে এলো বাসায় ওদের দেখতে। মাবাবা ছেলেকে ওদের সাথে খাবে কিনা জিজ্ঞাসা না করে বলে, ‘তুমি বসো আমরা খেয়ে নেই। ছেলেও স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দেয়, কোন সমস্যা না। বিষয়টা আমি কোনভাবেই মেনে নিতে পারিনা। হতে পারে ইউরোপীয়, তাই বলে এমনটি হবে কেন? তাই বাইরে দরোজার সামনে দুই প্রতিবেশি, কখনো বা আরো বেশি যখন দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ কথা বলে, তখন ভাবি ভেতরে ডেকে নিয়ে বসলেই তো পারে। কিন্তু না, ওরা পারেনা, ওরা ডাকে না। এই দৃশ্য দেখছি বছরের পর বছর। এখন অবশ্য এসব গাসওয়া হয়ে গেছে। আমরাও এখন ওদের মত দরোজার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলি। কদাচিৎ ভেতরে গিয়ে বসা। কথায় আছে ‘মানুষ অভ্যাসের দাস’। গতকাল রিয়া ও ইয়োপের সাথে দরোজার সামনে দাঁড়িয়ে আলাপ হচ্ছিল, বলা চলে ‘খেঁজুরে আলাপ’। রিয়ার প্রশ্নের শেষ নেই। কেমন আছি, কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি, সুমনা কোথায় ইত্যাদি ইত্যাদি। উত্তরে বলি, ‘সে আমার জন্য দিন কয়েক আগে তিনটা সামারপ্যান্ট কিনেছে। খুব একটা পছন্দ হয়নি। সেগুলি বদলিয়ে নিজ পছন্দমাফিক কিনবো। আমি আবার একটু চুজি টাইপের।’ ‘ওহ, তাই নাকি? ইয়োপেরও তো একই অবস্থা। ওর সব নিজে দেখে শুনে কেনা চাই, ও খুব চুজি,’ বলে রিয়া। তারপর প্রশ্ন রাখে, ‘তোমরা নাকি বাড়ি বদল করার চিন্তা ভাবনা করছো?’ উত্তরে বলি, ‘বয়স তো হচ্ছে। ক’দিন পর তো ড্রয়িং রুম থেকে সিঁড়ি বেয়ে দোতলার বেডরুমে যেতে পারবোনা। তেতলায় যাবার কথা না হয় বাদই দিলাম। সেকারণে ভাবছি এই বাড়ি ছেড়ে ফ্ল্যাটে চলে যাবো।’ শুনে রিয়া বলে, ‘কেন “স্টেয়ারস লিফট” (বিশেষ ধরনের মোটরচালিত চেয়ার) লাগাবে, সুইচ টিপলেই উপরে উঠে যাবে। আমরা সেই ধরনের লিফট লাগাবো বলে ভাবছি। ফ্ল্যাটে গেলে আমি আমার বাগান মিস করবো। সামারে বাগানে বসে লোভলিউমে গান শুনে রোদপোহানোর যে কী মজা। ফ্ল্যাটে তো আর সেটি পাবো না।’ আমি বলি, ‘সেটি ঠিক। ফ্ল্যাট বাড়ি আমাদের ছিল। সেটি বিক্রি করে এখানে আসা। কারণ তোমার মতো সুমনারও বাগান চাই। আমি অত বাগানপাগল নই। বছরের সাত মাসই তো ঠান্ডা, বাইরে বাগানে বসার জো নেই।’ রিয়া কথার পিঠে কথা বানায়। ঘড়ির দিকে তাকাই। ইতিমধ্যে মিনিট দশেক পার হয়ে গেছে। ওদের বলি, ‘এবার আমাকে যেতে হয়। না হয় বড্ড দেরি হয়ে যাবে।’ ‘বাই’ বলে ওরা নিজ ঘরের দিকে পা বাড়ায়।

হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। প্রতিবেশি হিসাবে রিয়াইয়োপ বেশ ভালো, বন্ধুবৎসল। যে কোন প্রয়োজনে এগিয়ে আসে। আমরা ছুটিতে যখন দেশে কিংবা বাইরে কোথায়ও যাই, তখন তাদের জানিয়ে যাই। ফোন করে খবর নেই সব ঠিক আছে কিনা। এতো দীর্ঘ সময় একসাথে পাশাপাশি আছি তাদের সাথে কখনো কোন ঝামেলা হয়নি। অনেক সময় এই ইউরোপেও দেখি প্রতিবেশিদের সাথে সমস্যা আদালত পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়ায়। তবে ডাচ অধ্যুষিত এলাকায় থাকতে গেলে একটু হিসেব করে চলতে হয়। ওরা উইকেন্ড ছাড়া বাসায় খুব একটা আড্ডার আয়োজন করেনা। যে সমস্ত এলাকায় বিদেশী অর্থাৎ তুর্কি, মরক্কীয়, সুরিনামী, সিরীয়, আফ্রিকীয় জনগোষ্ঠীর বসবাস সেখানকার চিত্র ভিন্ন। সভ্য দেশে থেকেও তারা সুন্দরভাবে থাকার চেষ্টা করে না, যত্রতত্র আবর্জনা ফেলে, ভব্যতা, সভ্যতার তাদের ‘জিনে’ ঘাটতি আছে বলে মনে হয়। অনেক রাতভর শব্দ করে মিউজিক বাজায়, সামাজিক নুইসেন্স সৃষ্টি করে। ফলে কোন কোন সময় সেখানে পুলিশের আগমন ঘটে। আমরা যখন এদিকটায় এসেছিলাম তখন কেবল একটি তুর্কি ব্যবসায়ীপরিবার ছিল। বেশ ভদ্র গোছের। গৃহকর্তার নিজস্ব রেস্তোরাঁ ছিল। বছর কয়েক আগে বিক্রি করে তারা অবসরে গেছে। তাদেরও একটি মেয়ে ও ছেলে। ওরা এখন বড় হয়েছে। বিয়ে থা হয়েছে। মাঝে মধ্যে ওরা আসে, ওদের বাচ্চাদের দিয়ে যায় দাদাদাদির কাছে। সুমনার সাথে রিয়ার বেশ সখ্য। দুজনের বেশ মিল। দু’জনেই কথা শুরু করলে তা হয় দীর্ঘস্থায়ী। বাসায় স্পেশাল কিছু রান্না হলে সুমনা রিয়াকে দেয়। আমাদের দেশিয় খাবার ওদের খুব পছন্দ। খাবার খেয়ে বলে, ‘লেকার, লেকার’ অর্থাৎ ‘খুব মজা’। রিয়াও মাঝে মধ্যে কিছু দেয়। ঝামেলাহীন ভালো প্রতিবেশি পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। সে অর্থে আমরা ভাগ্যবান। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে। বঙ্গানুবাদ করলে তার অর্থ দাঁড়ায় – ‘একজন ভালো প্রতিবেশি হলো সেই ব্যক্তি যে পেছনের বেড়া দিয়ে হাসে, কিন্তু তা অতিক্রম করে না।’ রিয়াও মাঝেমধ্যে পেছনে আমাদের দুই বাগানের যে ‘বেড়া’ আছে সেখান থেকে কথা বলে। বেড়া উঁচু বিধায় দেখা যায়না। মাঝে মধ্যে সে টুল এনে সেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলে।

এতো গেল ডানদিকের রিয়াইয়াপের কথা। বাঁদিকে যে ডাচ পরিবারটি তাদের একটি চার/পাঁচ বছরের কন্যা। তরুণতরুণী স্বামীস্ত্রী দুজনেই চাকরি করে, দুজনের দুটি গাড়ি। দেখা হলেই ছেলেটি, নাম কার্ল ‘হ্যালো বিকাশ, কেমন আছো’ বলে শুভেচ্ছা জানায়। তার স্ত্রী ম্যারিয়ালাও। তাদের ছোট্ট মেয়েটি কথা বলে প্রচুর। পেছনে মাঝেমধ্যে যখন বাগানে যাই তার কথা শুনতে পাই। অনর্গল কথা বলে, তার মা কিংবা বাবার সাথে। প্রতিবেশির সাথে সুসম্পর্ক থাকা খুব দরকার। দেশেবিদেশে। বাসায় যখন আমরা থাকিনা, তখন ডাকযোগে কোন পোষ্ট এলে তা ডানে বা বায়ে কোন বাসায় দিয়ে যায়। পোস্টম্যান যাবার আগে একটি স্লিপ চিঠির বাক্সে ফেলে যায়। তাতে লেখা থাকে, ‘তোমাদের পেলাম না, তাই পোস্টটি অমুক নম্বর বাসায় দিয়ে গেলাম।’ পাশের বাসায় কাউকে না পেলে উল্টোদিকে ছোট্ট রাস্তার ওপারের কোন বাসায় দিয়ে যায়। নিকট অতীতে বাসায় কেউ না থাকলে পিয়ন একটি স্লিপ রেখে যেত ডাকবাক্সে, তাতে লেখা থাকতো, ‘এসেছিলাম অতটার সময়। তোমাদের পাইনি। আগামীকাল আবার আসবো।’ সে ব্যবস্থা বাতিল করেছে ডাকবিভাগ। খরচ কমাতে এই পরিবর্তন। কেবল তাই নয়, আগে যেখানে অলিগলিতে লাল রংয়ের ডাকবাঙ ছিল সেগুলির বেশিরভাগ এখন উধাও। আগে দিনে তিনটি নির্দিষ্ট সময়ে গাড়ি নিয়ে আসতো পিয়ন, পোস্টগুলি ব্যাগে ভরে চলে যেত ডাক অফিসে। এখন মানুষ আর আগের মত চিঠিপত্র লেখালেখি করে না। সব বন্দী হয়ে গেছে মোবাইল, মেইলে। চোখের সামনে কত কিছু পরিবর্তন হয়ে গেছে গত ৩৪ বছরে। হল্যান্ড ওয়েলফেয়ার স্টেট হিসাবে পরিচিত। জনগণ কীভাবে দোরগোড়ায় সকল ধরনের সেবা পাবে সেই ব্যবস্থা ছিল আগে। বাড়ির কাছেই ছিল পোস্ট অফিস, ব্যাংক, চেইন শপ, এটিএম। বছর কয়েক ধরে এই সব গুটিয়ে নেয়া হয়েছে। আগে ব্যাংকে গেলে কাউন্টারে যে সার্ভিস দেয়া হতো তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কর্মী ছাঁটাই করেছে, ব্যয় কমিয়েছে। এখন ব্যাংকের প্রায় সব কাজ গ্রাহককে করতে হয় অনলাইনের মাধ্যমে।

(২২২০২৫)

লেখক : সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্মরণের আবরণে যশশ্বী ইতিহাসবিদ ড. আবদুল করিম
পরবর্তী নিবন্ধমাদকের অপব্যবহারে তারুণ্যের ভবিষ্যৎ কোন পথে