হল্যান্ড থেকে

ফিরে দেখা : হল্যান্ডে কাটানো চৌত্রিশ বছর - অতঃপর?

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ১৯ এপ্রিল, ২০২৫ at ১০:২৪ পূর্বাহ্ণ

অনেকগুলি দিন, মাস, বছর পিছু ফেলে এসেছি। দেখতে দেখতে ৩৪টি বছর হল্যান্ডেই কাটিয়ে দিলাম। ভাবছি কতগুলি দিন, কতগুলি মাস কেটে গেছে এই বিদেশবিভুঁয়ে। অথচ ইউরোপের ছোট্ট অতি উন্নত এই দেশটিতে যাবো সে কথা যাবার বছর খানেক আগেও ভাবনায় আসেনি। জীবনের বাঁক যখন ঘুরে গেলো, যখন স্বদেশ ছেড়ে সেদেশে যাওয়া অনিবার্য হয়ে উঠলো, তখনও মনের মধ্যে এই ভাবনাটাই ছিল যে বড় জোর বছর পাঁচেক। তারপর ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসবে। কিন্তু তা আর হলো না। মেঘে মেঘে বেলা অনেক পেরিয়ে গেছে। ইতিমধ্যে ঘরের ছেলের বয়স বাড়তে শুরু করেছে, কিন্তু যেদেশ পিছু রেখে গেছে একদিন ফিরে আসবে বলে, সেদেশে ফিরে আসা আর হয়নি। একেবারে যে আসা হয়নি বা হয়না তা না। আসা হয়েছে, বলা যায় প্রায় ফিবছর, কিন্তু যাকে বলে একেবারে ফিরে আসা সেটি আর হয়ে উঠেনি এতগুলি বছর পেরিয়ে এসেও। আগামীদিনে ফিরে আসবে সে সম্ভাবনাও ক্ষীণ। হয়তো একদিন ফিরে আসবে, চিরদিনের তরে। সুকান্তের সেই মুরগির মত। একটি মুরগি খাবারের অন্বেষণে খাবারটেবিলের নিচে ঘুরঘুর করতো, আর ভাবতো কবে সে একদিন ওই টেবিলে বসে খেতে পারবে। একদিন সে ঠিক ওই ডাইনিং টেবিলে উঠে এলো। তবে খাবার খেতে নয়, খাবার হিসাবে। বেচারা মুরগির মত হয়তো আমারও একদিন দেশে ফিরে আসার দীর্ঘদিনের আশা, আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে। তবে সেআসা হয়তো চিরদিনের জন্যে। প্রবাসে যারা দীর্ঘদিন থাকেন, স্থায়ী আবাস গাড়েন কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া তাদের সবার পরিণতি ওই বেচারা মুরগির মত। তবে আমার এই ফিরে আসার কথা শুনে আঁতকে উঠেছিলেন বিশিষ্ট কবি, সাহিত্যিক ও দৈনিক আজাদীর প্রবীণ সাংবাদিক অরুণ দাশ গুপ্ত, সবার অরুণদা। এমন সৎ ও সজ্জন ব্যক্তি খুব কম দেখেছি দেশে। মনে পড়ে রিকশায় চেপে দৈনিক আজাদী অফিসের দিকে এগুচ্ছি। উনিও আর এক রিকশায়, পাশে বসা অচেনা এক ভদ্রলোক উল্টোদিক থেকে আসছেন। কাছাকাছি হতেই দুই রিকশার গতি শ্লথ হতে থাকে। উঁচু গলায় জানতে চাইলেন কবে দেশে এসেছি। তার উত্তর দিয়ে বললাম, কিছুদিন পর কিন্তু একেবারে চলে আসবো। শুনে উনি যেন আঁতকে উঠলেন। বললেন, ‘অমন ভুলকাজটি ভুলেও করবেন না। খুব ভালো আছেন সে দেশে।’ সেঘটনা আজ থেকে কম করে হলেও বছর কুড়ি আগের কথা। না, অরুণদা যে ভুলের কথা বলেছিলেন সে ভুল করা হয়নি। দেশে আর ফেরা হয়নি। ছেলেমেয়ের নিশ্চিত ভবিষৎ, উদ্বেগহীন জীবন, স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি, মুক্ত বায়ুতে নিঃস্বাস নেয়া, নিশ্চিত চিকিৎসা সেবাসব মিলিয়ে আজ ৩৪ বছর পেরিয়ে এসে মনে হয়, অরুণদার সেই ‘ভুল’ না করে খুব একটা ভুল করিনি। তারপরও জন্মভূমি বলে কথা। ফিরে আসি বারবার। দেশের সাথে যে নাড়ির টান। এই দেশে জন্ম, এই শহরে জন্ম, বেড়ে উঠা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর বছর কয়েক সাংবাদিকতা, তারপর ঢাকা, সেখানে নতুন চ্যালেঞ্জ, নতুন চাকরি, আবারো সাংবাদিকতা। বন্ধু, আত্মীয়, নিকটজন, পরিচিতজনদিন বাড়ার সাথে সাথে এই পরিধিও বাড়তে থাকে। তারপর একদিন হুট্‌ করে উড়াল দেয়া, সাত সমুদ্র পার হয়ে একেবারে ইউরোপের ছোট্ট একটি দেশে কেবল যাওয়া নয়, থিতু হয়ে বসা। চৌত্রিশটি বছর। অথচ এখনো মনে হয় এইতো সেদিন। অনেকে তো ৩৪ বছরও বাঁচে না। কত কাছের বন্ধু ৩৪ পেরোবার আগেই চলে গেলে চিরদিনের তরে।

অথচ এখনো কী স্পষ্ট সব মনে আছে। যেন এইতো সেদিন ঢাকার সবুজবাগে আমার চার তলার দুকামরার ফ্ল্যাট ছেড়ে দল বেঁধে দুটো মাইক্রোবাসে বন্ধু, সহকর্মী, নিকটজন এবং মা সহ ঢাকা এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছি রাতের বেলা। যে মাইক্রোতে বসেছিলাম তাতে ছিল বাংলাদেশ টাইমসের সহকর্মী ও বন্ধু সৈকত রুশদী সহ আরো জনা কয়েক নিকটজন। দুজন একসাথে দৈনিক বাংলা ভবনের দোতলায় বাংলাদেশ টাইমসসে যোগ দিয়েছিলাম রিপোর্টার হিসাবে। এয়ারপোর্টের উদ্দেশে যেতে যেতে সৈকত বলে, মনে হচ্ছে যেন বরযাত্রী হয়ে ইউরোপ যাচ্ছি। মা প্যারালাইসড। শরীরের ডানদিকটা অবশ। চাটগাঁ থেকে ঢাকা এসেছেন তার সেজ ছেলেকে বিদায় দিতে। এয়ারপোর্টের বাইরে বিদায় বেলায় পা ছুঁয়ে প্রণাম করতেই মা হু হু করে কেঁদে উঠেন। নিজ ভাইবোন, মামাতো ভাই অনেকেই ছিল সেই মুহূর্তে। মায়ের কান্নায় আমার চোখ আদ্র হয়ে এসেছিল কিনা আজ অনেক দিন পেরিয়ে এসে মনে পড়ে না। এখন যখন মনে হয় চোখ খুব একটা ভেজেনি তখন নিজেকে খুব স্বার্থপর মনে হয়। এই ভেবে ইউরোপ যাচ্ছি মনের ভেতর এই অজানা আনন্দ কিংবা উত্তেজনার কারণে কি মায়ের কান্নায় আমার কান্না পায়নি। খুব চেষ্টা করি মনে করতেআমি কি আসলেই কান্না করিনি? এতগুলি বছর এদের সাথে কাটিয়ে, এদের স্নেহমায়া, ভালোবাসায় বড় হয়ে এদের ছেড়ে যাবার মুহূর্তে চোখ ভেজেনি? মন আদ্র হয়ে উঠেনি? এমনটি যদি হয় তাহলে তো নিজেকে স্বার্থপর ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারিনা। এদিককার দশা যখন এমন, তখন অন্য দিকে অর্থাৎ সাত সমুদ্র পাড়ে রিসিভিং পয়েন্টে ভিন্ন সিনারিও। সেখানে অপেক্ষা করছে নব বিবাহিত বধূ, ভালোবাসার পাত্রী, তার মা, বোন ও ভাইয়েরা। আজ ভাবতে অবাক লাগে প্রচন্ড শব্দে যখন বাংলাদেশ বিমানের বিশাল উড়োজাহাজটি উড়াল দেয় তখন দেশের জন্যে মন খুব একটা খারাপ লাগেনি। হয়তো অজানা ভবিষ্যতের কথা ভেবে। তখনও মাথার মধ্যে যেটি ছিল তা হলো, বছর পাঁচেক সেদেশে থেকে স্বদেশে ফিরবো। সেই চিন্তা মাথায় রেখে অফিসে কিছু বলা হয়নি। সেদিন ছিল ৭ এপ্রিল ১৯৯০। বাংলাদেশ টাইমসসে মাসের বেতন দেয়া হতো সাত তারিখ। সকাল এগারটা নাগাদ একবার অফিসে ঢুঁমারা ছিল আমাদের অর্থাৎ রিপোর্টারদের নিত্য কাজ। অফিস গিয়ে লগ বুক খুলে সেদিন কোন অনুষ্ঠান কভার করতে হবে কিনা, কিংবা কোন এসাইনমেন্ট আছে কিনা তা দেখা। না, আমার কোন এসাইনমেন্ট ছিল না। আমাদের একাউন্টস বিভাগ তিন তলায়। প্রতিমাসের মত সেখানে গেলে হাতে ধরিয়ে দেয় বাদামি রংয়ের একটি ইনভেলাপ। তাতে মাসের বেতন। সেটি নিয়ে গেইট গলিয়ে বাইরে এসে রিকশায় চেপে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছাকাছি ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা, টাইডএ যাই। সে সময় টাইমসসে কাজ করার পাশাপাশি টাইডের ‘সিনেমা’ পাতাটি সম্পাদনা করতাম। সেটি ছিল আমার একক দায়িত্বে। মাসের টাকাটা নিয়ে সোজা সবুজবাগ। আমার চার তলার ছোট্ট ফ্ল্যাটটি তখন ভাইবোন, মা, নিকটজন, বন্ধুদের আনাগোনায় মুখর। কেউ কেউ এলো আমাকে দিকে তাদের চাকরির জন্য সুপারিশ লেখার জন্যে। ওদের ধারণা, আমার সুপারিশে তাদের চাকরি হবে। শত ব্যস্থতায়ও তাদের কয়েকজনের সুপারিশ লিখতে গিয়ে টাইপ মেশিন নিয়ে বসতে হয়েছে। এলো বন্ধু উলফাৎ কবির ও তার স্ত্রী রোকসানা কবির। দেশের একমাত্র জাদুকর দম্পতি হিসাবে দেশে তাদের বেশ পরিচিতি তখন। কিছুদিন আগে জানতে পারলাম উলফাৎ কবির মারা গেছেন। অত্যন্ত ভালো বন্ধু ছিলেন তিনি। দুজন একসাথে গাড়ি ড্রাইভিং শেখা শুরু করি। তার ছিল স্টিল আলমিরা তৈরির কারখানা। মতিঝিল বাংলাদেশ ব্যাংকের একেবারে পাশেই তার কারখানা। যখনই তার কারখানায় গেছি বা তার বাসায় কখনই নাখেয়ে ফিরে আসিনি। এরপর দেশে গেলে তার সাথে কয়েক অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছে। আড্ডা দেয়া হয়েছে। সেই আড্ডায় তারা দুজন খাবারশেষে ম্যাজিক দেখাতেন। আমাদের সবাইকে চমকে দিতেন। আমাদের বন্ধুদের সে আড্ডায় আর একজন ছিলেন মধ্যমনি। সাংবাদিক বন্ধু ও কলিগ মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর। দুজন একসাথে একই ভবনে পাশাপাশি দুটিকামরায় তিন বছর কাজ করেছি। ঢাকায়, সার্কিট হাউজ রোডে সাংবাদিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটে। জাহাঙ্গীর ভাই ছিলেন প্রশিক্ষক, আমি রিপোর্টার। পরে অবশ্য দুজনেই সেই সরকারি/স্বায়ত্বশাসিত চাকরি ছেড়েছি। উনি তার সৃষ্টি সাংবাদিকতা বিষয়ক কেন্দ্র খুলে বসেছেন এবং আমি আবারো সক্রিয় সাংবাদিকতায়, বাংলাদেশ টাইমসসে যোগ দিলাম, সেখানে আরো তিনটি বছর (১৯৮৭১৯৯০) সালের এপ্রিল তক। তারপর সেটি ছাড়লাম। ছাড়লাম দেশ। তখন দেশ উত্তাল। এরশাদ হটাও আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করেছে। হল্যান্ড যাওয়া হয়তো আরো প্রলম্বিত হতো, যদি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তাল না হতো। কেউ কেউ বললো, ‘ভিসা’ এসে যখন অপেক্ষা করছে এবং দেশের পরিস্থিতি যখন খারাপের দিকে তখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে যাওয়া উত্তম। বিশেষ করে যখন যাবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছো।

অচেনা দেশ! দেশের বাইরে বলতে কেবল কলকাতা, দিল্লিও নয়। এর আগে প্লেনে চড়েছি কেবল একবার। চট্টগ্রাম টু ঢাকা এন্ড ব্যাক। সাংবাদিক হিসাবে জাতিসংঘের উদ্যোগে আয়োজিত পরিবেশ সংক্রান্ত সপ্তাহব্যাপী এক প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশ নিতে। আয়োজন করা হয়েছিল বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটে। পরবর্তীতে সেখানে তিন বছর কাজ করেছি প্রথম শ্রেণি সরকারি পদ মর্যাদায় রিপোর্টার হিসাবে। সেখানে তখন কাজ করতেন মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর। পাশাপাশি দুটি কামরায় আমরা দুজন বসতাম পিআইবির তেতলায়। আমার হল্যান্ড যাবার পেছনে তারও সামান্য ভূমিকা ছিল। দেশ ছাড়বো কিনা এই নিয়ে মনের মধ্যে কোন দ্বিধা এলে তিনি উৎসাহ দিতেন। পেছন থেকে ‘পুশ’ করতেন, যেমনটি করেছিলেন কাজের বাইরেও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করার জন্যে। যার একটি ফসল দৈনিক আজাদীর এই কলাম, ‘হল্যান্ড থেকে’। তার হাত ধরেই এর যাত্রা শুরু। বিগত ৩৪ বছর ধরে। জাহাঙ্গীর ভাই এক প্রশিক্ষণে যাবেন হল্যান্ডের হেগ শহরে, যে শহরে হবু পাত্রীর স্থায়ী বসবাস, তার মাবাবার সাথে। পাত্রীর সাথে পাত্রের ছিল ডাকযোগে চিঠি চালাচালি। তখন মোবাইলের জন্ম হয়নি। জাহাঙ্গীর ভাই পত্রবাহক হয়ে উত্তর সাগর পাড়ে এক কফি শপে দেখা করলেন পাত্রীর সাথে। এদিকে বিয়ের সময় ঘনিয়ে এসেছে। সব ঠিক। অনেকটা দুয়ারে গাড়ি দাঁড়ায়ে। পাত্রের হাতে টাকা যা আছে তাতে আর যাই করা যাক না কেন বিয়ে নামক দিল্লী কা লাড্ডু খাওয়া যাবে না। বলতেই কোন প্রশ্ন ছাড়া বড় অংক নিয়ে মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর এগিয়ে এলেন। বিয়ে হবে পাত্রের জন্মস্থানে। জাহাঙ্গীর ভাই এলেন চাটগাঁ। ঢাকা থেকে আরো কয়েক সাংবাদিক বন্ধু এসেছিলেন বিয়েতে। বিয়ের যে ভিডিও তার সম্পূর্ণ পরিকল্পনা করলেন তিনি, পাত্রের অজান্তে। বিয়ের ছয় মাসের মাথায় পাত্র দেশ ছাড়লেন। বছর কয়েক আগে এই নশ্বর পৃথিবী ছাড়লেন প্রিয় বন্ধু মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর। বার কয়েক গেছেন হল্যান্ড। আমার সংগঠন আয়োজিত সম্মেলনে অতিথি বক্তা হিসাবে যোগ দিতে। মৃত্যুর মাস কয়েক আগে তার আত্মজ অপূর্ব জাহাঙ্গীরকে সাথে নিয়ে। তখন তার একা জার্নি করার মত শারীরিক সক্ষমতা নেই। কিন্তু ছিল অসীম মনোবল। মরণব্যাধির কাছে সহজে হার মানেননি। শেষ তক কাজ করে গেছেন মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর।

চলবে

লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধছাদে রেস্তোরাঁ নয়, বাগান দরকার : বাঁচুক পরিবেশ
পরবর্তী নিবন্ধফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি প্রকাশে অপূর্ব অধ্যায়