হল্যান্ড থেকে

ডোনাল্ড ট্রাম্প কি তৃতীয়বারের মত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে লড়বেন?

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ৫ এপ্রিল, ২০২৫ at ১০:৩২ পূর্বাহ্ণ

সামপ্রতিক সময় বিশ্ব রাজনীতি মঞ্চে অনেক কিছু ঘটে চলেছে। ইসরায়েল প্যালেস্টাইনে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব বিবেককে উপেক্ষা করে। বিশ্ব বিবেকও যেন নীরব দর্শকের ভূমিকায়। কেউ কিছু বলছে না। ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের মত ক্ষমতায় আসার পর রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন নড়েচড়ে বসেছেন, পররাজ্য দখল করার অভিপ্রায়ে। পুতিনের আগ্রাসনঅভিলাষ দেখে ইউরোপ তার সামরিক শক্তিকে নূতন করে ঢেলে সাজাতে ব্যস্ত। এদিকে ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ হিসাবে পরিচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দেশের শাসনতন্ত্রের তোয়াক্কা না করে তৃতীয়বারের মত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হবার অভিপ্রায় প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন। এ ঘোষণা যে একেবারে ‘আউট অফ ব্লু’ তা নয়। এর আগেও তিনি এমন ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে তিনি তার সমর্থকদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘একবার নয়, বরং দুবার, তিনবার কিংবা চারবার দায়িত্ব পালন করতে পারা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্মান হবে।’ সমপ্রতি এনবিসির সাথে এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্পকে তৃতীয় মেয়াদে প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘এমন কিছু পদ্ধতি আছে যার মাধ্যমে আপনি এটি করতে পারেন’। আত্মবিশ্বাসের অভাব নেই ট্রাম্পের। সে আমরা বিগত নির্বাচনের আগেও দেখেছি। তিনি জিতবেন এবং হোয়াইট হাউসে ফিরে আসবেন এই ব্যাপারে তার দল এবং মার্কিনিদের মধ্যে সন্দেহ কম ছিল। ট্রাম্পও অনেকটা নিশ্চিত যে তিনি আবার নির্বাচনে দাঁড়ালে জয়ী হয়ে আসবেন। এই নিয়ে ইতিমধ্যে পক্ষেবিপক্ষে, বিরোধী ডেমোক্রেটিক শিবিরে তো বটেই এমনকী রিপাবলিকান দলেও বেশ আলোচনাসমালোচনা শুরু হয়েছে। এই প্রসঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, ‘আই এম নট জোকিং’ অর্থাৎ ‘আমি মজা করছি না’। তাকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিলেন, তিনি দেশের সব চাইতে কঠিন কাজ চালিয়ে যেতে চান কিনা? উত্তরে ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘আমি কাজ করতে পছন্দ করি।’ তিনি বলেন, ‘ওয়েল, দেয়ার আর প্ল্যানস।’ সাথে সাথে এও বলেন, ‘প্ল্যান আছে, তা নয়। তবে পদ্ধতি রয়েছে, তার মধ্যে দিয়ে করা যায়। অনেকেই চান আমি তা করি।’ রিপাবলিকান দলের ভূতপূর্ব কংগ্রেসম্যান, ডেভিড জোলি এনবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ট্রাম্পের কোন কথাই উড়িয়ে দেয়ার নয়। ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি তার বাস্তব উদাহরণ। যদি তিনি (ট্রাম্প) বলে থাকেন যে তিনি তৃতীয়বারের মত লড়বেন, তার অর্থ হলো তিনি সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেননি এবং আমাদের এটিকে একটি শাসনতান্ত্রিক হুমকি হিসাবে দেখতে হবে।’ এর মধ্যে দিয়ে ডেভিড জোলি এটিই বুঝাতে চাইছেন যে ট্রাম্প লড়তেও পারেন এবং তার জন্যে যত পথ আছে, হোক না তা রুদ্ধ কিংবা উন্মুক্ত, তিনি হয়তো চেষ্টা করতে পারেন। সেখানেই ভয় ডেমোক্রেটিক দলের। কেননা ডোনাল্ড ট্রাম্প সাধারণ জনগণের মাঝে এখনো অবিশ্বাস্যভাবে জনপ্রিয়। অন্যদিকে বিরোধী ডেমোক্র্যাক্ট দলে তাকে টেক্কা দেবার মত শক্তিশালী কোন নেতা বা প্রতিপক্ষ নেই।

) দ্বিতীয় মেয়াদ শেষে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বয়স হবে ৮২ বছর। তবে ইতিমধ্যে শীর্ষস্থানীয় রিপাবলিকানরা সংবিধান সংশোধনের মধ্যে দিয়ে ট্রাম্পের এই চিন্তা ভাবনাকে অনুমোদন দেবার ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলেন, অন্যান্য বিতর্ক থেকে মানুষের মনোযোগ সরিয়ে নেয়া এবং দলের মধ্যে আর কেউ যেন তাকে ছাড়িয়ে সামনে আসতে না পারেন, সেই লক্ষ্যে এই ধরনের কথাবার্তা বলছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। আবার কেউ কেউ মনে করেন, মার্কিন নাগরিকদের ‘মাইন্ড সেট’ জানার জন্যে হয়তো ট্রাম্প এই কৌশল অবলম্বন করছেন। যেন দেখিনা জনগণ কীভাবে নেয়। তবে ট্রাম্পের এই অভিলাষকে হালকা করে দেখছেন না অনেকে। যদিও দেশের শাসনতন্ত্র বলছে এইভাবে তৃতীয়বারের মত প্রেসিডেন্ট হবার কোন সম্ভাবনা নেই। তারপরও তার এই বক্তব্য রাজনৈতিক অঙ্গনে বিশেষ করে বিরোধী ডেমোক্র্যাক্ট শিবিরে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। কেননা ট্রাম্পের রয়েছে ‘অসম্ভবের সাথে লড়াই’ করার মত ঘটনার সাথে জড়িত থাকার ইতিহাস। ২০২০ সালের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাক্ট দলীয় প্রার্থী, জো বাইডেনের কাছে হেরে যাবার পর গোটা বিশ্ব অবাক হয়ে দেখেছে ডোনাল্ড ট্রাম্প কীভাবে নির্বাচনী ফলাফল উল্টে দেবার জন্যে সহিংস পথ অবলম্বন করেছিলেন এবং ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি তার অন্ধ সমর্থকদের ক্যাপিটাল হিল দখল করার উস্কানি দিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অনুয়ারি দুবারের বেশি কেউ প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হতে পারবেন না। তবে তাতে ট্রাম্প হাল ছেড়ে দেবার পাত্র নন। তিনি বলেন, ‘কিছু পদ্ধতি আছে যার মাধ্যমে এটি সম্ভব।’ সংবিধানের ২২তম সংশোধনীতে বলা হয়েছে : ‘কোন ব্যক্তি দুবারের বেশি প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হতে পারবেন না।’ এই ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে যেটি দেখা দিতে পারে তা হলো, সংবিধানে পরিবর্তন আনার জন্যে সিনেট এবং প্রতিনিধি পরিষদ উভয়ের দুইতৃতীয়াংশের অনুমোদনের পাশাপাশি দেশের রাজ্যস্তরের সরকারের তিনচতুর্থাংশের অনুমোদনের প্রয়োজন হবে। রিপাবলিকান কংগ্রেস উভয় কক্ষ নিয়ন্ত্রণ করলেও তাদের প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। অন্যদিকে, ডেমোক্রাট দল ৫০টি রাজ্য আইনসভার মধ্যে ১৮টি নিয়ন্ত্রণ করে।

) প্রশ্নএর আগে কি যুক্তরাষ্ট্রে আর কেউ দুই টার্মের বেশি প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেশ পরিচালনা করেননি? উত্তর, হ্যাঁ, করেছেন। তিনি হলেন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট। রুজভেল্ট চারবার প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। শেষ নির্বাচিত হন ১৯৪৪ সালে। এরপর আমেরিকার শাসনতন্ত্রে ২২তম সংশোধনী আনা হয় এবং আইন হয় যে, কোন ব্যক্তি দুবারের বেশি দেশের প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। মজার ব্যাপার হলো, কেউ কেউ এই বলে তাদের অভিমত প্রকাশ করেন যে, তারপরও শাসনতন্ত্রে ফাঁকফোঁকর রয়ে গেছে যা গলিয়ে ট্রাম্প তৃতীয়বারের মত প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন, যদি নির্বাচিত হন। তারা যুক্তি দেখান এই বলে, প্রেসিডেন্ট দুবারের বেশি হওয়া যাবে না, ঠিক আছে। কিন্তু ট্রাম্প ভাইসপ্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হতে পারবেন তার অনুগত কোন নির্বাচনী পার্টনারের সাথে। যদি ওই নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট কোন কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন, তাহলে ভাইস প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার স্থলাভিষিক্ত হবেন। তখন তিনিই হবেন প্রেসিডেন্ট, তৃতীয়বারের মত। তবে সে ক্ষেত্রে বড় প্রশ্ন হলো, তেমন কাউকে কি তিনি খুঁজে পাবেন, যিনি নির্বাচনে জিতেও বিশ্বের সব চাইতে ক্ষমতাশীল পদটির মায়া ছাড়তে পারবেন? তবে এই সব কিছুই অনুমাননির্ভর কথাবার্তা। ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের অধীনে এটর্নি হিসাবে কাজ করছেন জন ডিন। তিনি বলেন, ‘বারাক ওবামার দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হবার আগে অনেকেই বলেছিলেন, তার (ওবামা) আরও এক টার্মের জন্যে প্রেসিডেন্ট হওয়া উচিত। তিনি শাসনতন্ত্র পড়েছেন এবং বলেছিলেন, ‘আমি শেষ দৌড়ের পক্ষে নই’।

) আবার কেউ কেউ মনে করে ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি শেষ পর্যন্ত তার এই অভিলাষ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেন বা শাসনতান্ত্রিক বাধা নিষেধের কারণে তৃতীয়বারের মত প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হবার চিন্তাভাবনা থেকে দূরে থাকেন, তাহলে তার স্থান দখল করতে পারেন বর্তমান স্ত্রী ফার্স্ট লেডি, মেলানিয়ার ঘরে জন্ম নেয়া ছেলে, ব্যারন ট্রাম্প। ঊনিশ বছর বয়সী ৬ ফুট ৯ ইঞ্চি উঁচু ব্যারন ট্রাম্প সবার নজরে আসেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফা প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ অনুষ্ঠানে। ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দেখা যায় বিভিন্ন সময়ে ছেলের নানা গুণের কথা বলে প্রশংসা করতে। এতে রাজনৈতিক অঙ্গনের অনেকের মনে প্রশ্ন তিনি (ডোনাল্ড ট্রাম্প) ব্যারনকে রাজনীতিতে প্রবেশের শিক্ষা কিংবা দীক্ষা দিচ্ছেন নাতো? তবে সব গুঞ্জনকে উড়িয়ে দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, ‘না, তেমন কোন চিন্তা ভাবনা নেই তার কিংবা তার ছেলের। প্রযুক্তি ক্ষেত্রে ব্যারনের বেশ আগ্রহ এবং সেই বিষয় নিয়ে সে ইতিমধ্যে তার দক্ষতা প্রমাণ করে চলেছে।’ উল্লেখ করা যেতে পারে, নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ছাত্র ব্যারন অভিজাত স্টার্ন স্কুল অফ বিজনেসে ‘ব্যবসা’ নিয়ে পড়াশুনা করছেন। যদিও তিনি ব্যবসা নিয়ে পড়াশুনা করছেন, তার বাবার (ট্রাম্প) কথা থেকে বোঝা যায় যে, ব্যারনের পছন্দ বা ‘প্যাশন’ অন্য কোথাও। ট্রাম্পদম্পতি রাজনীতি এবং ব্যবসা উভয় ক্ষেত্রে জড়িত, কিন্তু ধারণা করা হচ্ছে ব্যারনের লক্ষ্য ভিন্ন। তবে বর্তমানে অনুসৃত পথ থেকে রাজনীতি নামক পিচ্ছিল পথের দিকে ধাবিত কিংবা প্রলুদ্ধ হতে কতক্ষণ। সময় বলে দেবে কোন দিকে যাবেন আজকের সুদর্শন ব্যারন ট্রাম্পপ্রযুক্তি না রাজনীতি। পাশাপাশি সময় এও বলে দেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প আদৌ তৃতীয়বারের মত প্রেসিডেন্ট পদের জন্যে লড়বেন কিনা। আর এই সবকিছু দেখার জন্যে আমাদের আরো বেশ কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে।

লেখক

সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের ভাষার বহুমাত্রিক ব্যবহার
পরবর্তী নিবন্ধসুপেয় পানি সংকটে বিপর্যস্ত পুরো বিশ্ব