বিপুলা এ ধরণীর কতটুকু জানি! সে জানা অতি ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র। সমুদ্রের পাড়ে বিশাল জলরাশির সামনে একাকী দাঁড়িয়ে দৃষ্টি যতদূর যায়, ততদূর ছড়িয়ে দিলেই টের পাওয়া যায় পৃথিবীর আমরা কতটুকু জানি। ফিনল্যান্ড বেড়াতে এসে, ইউরোপের উত্তরে এই অতি উন্নত দেশটি সম্পর্কে তথ্য ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে জানলাম, ইউরোপের মধ্যে এই দেশটি সর্বপ্রথম জনগণের ভোটাধিকার প্রবর্তন করে। এর আগে সাধারণ জনগণের কোন ভোটাধিকার ছিল না। ১৯০৬ সালে এই নাগরিক অধিকার কার্যকর করা হয়েছিল। জনসংখ্যা মাত্র ৫৬ লক্ষ। সে তুলনায় বিশাল দেশ, ৩৩৮,১৪৫ বর্গ কিলোমিটার, আয়তনে বাংলাদেশের দ্বিগুন। বাংলাদেশের আয়তন ১৪৮,৪৬০ বর্গ কিলোমিটার এবং জনসংখ্যা প্রায় ১৮ কোটি। শেষ বরফ যুগের পর খ্রীস্টপূর্ব ৯০০০ সালে এ দেশের গোড়পত্তন। এই ছোট্ট দেশটির উপর নজর পড়ে পার্শ্ববর্তী শক্তিশালী দেশগুলির। তাদের মধ্যে রাশিয়া ও সুইডেন। এই দুই দেশই এক সময় ফিনল্যান্ড নিজেদের দখলে নেয়। মনে মনে ভাবি দখলবাজ সে অতীতেও ছিল। জনগণের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে পরদেশ নিজেদের দখলে নেবার ঘটনাও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি নিকট অতীতে। এখন এই পররাজ্য বা পর ভূখন্ড দখলের হুমকি শুনি সদ্য নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুখ থেকে। গ্রীনল্যান্ড ও পানামা খালের কথাই বলছি। ১৮০৯ সালে ‘ফিনিশ যুদ্ধে‘ সুইডেনের দখলে থাকা ফিনল্যান্ড নিজ দখলে নেয় রাশিয়া। শুরু হয় রুশ বিপ্লবের, সেটি ১৯১৭ সালের কথা। বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে রাশিয়ায় রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটে। ক্ষমতায় আসে সোসালিষ্ট (সমাজতান্ত্রিক) সরকার। ফিনল্যান্ড ঘোষণা করে নিজ দেশের স্বাধীনতা। কিন্তু রাশিয়ার আক্রোশ থেকে একেবারে মুক্ত হতে পারেনি এই দেশটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফিনল্যান্ড রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, পরবর্তীতে জার্মান নাৎসীদের বিরুদ্ধে। ফলে যা হবার তাই হলো। রাশিয়ার তুলনায় অনেক ছোট্ট এই দেশটি তার কিছু অংশ হারালো রাশিয়ার কাছে। তবে ধরে রাখতে সক্ষম হলো তাদের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র। ফিনল্যান্ড বর্তমানে সম্পূর্ণ স্বাধীন, কিন্তু এ দেশে এখনো সুইডেনের বেশ প্রভাব রয়েছে। তা চোখে পড়লো রাজধানী হেলসিংকিতে ঘুরতে এসে। ফিনিশ ভাষা এদেশের অফিসিয়াল ভাষা হলেও বিভিন্ন জায়গায় দেখেছি সুইডিশ ভাষার প্রচলন, যদিও বা সে (সুইডিশ) ভাষায় কথা বলে মাত্র ৫.১% শতাংশ জনগণ। বাকি ৮৪,৯% ভাগ নাগরিকের ভাষা ফিনিশ। ‘সামি’ নামে আর একটি ভাষা আছে। সে ভাষায় কথা বলে মাত্র ০,০৪% শতাংশ লোক। ভাষা বিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীতে বর্তমানে সাড়ে ছয় হাজার ভাষা রয়েছে। তবে এই সংখ্যা কমে বাড়ে, কেননা কিছু ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে, আবার অন্যদিকে কিছু ভাষা আবিষ্কৃত হচ্ছে। বাংলা ভাষার অবস্থান জনসংখ্যানুপাতে যদ্দুর জানি পঞ্চমে। মজার ব্যাপার বটে।
আগের সংখ্যায় উল্লেখ করেছিলাম ফিনল্যান্ডে এই আমার প্রথম আসা। দেশটির কী দেখবো, দর্শনীয় কী কী আছে তার কোন তথ্য না নিয়েই চলে এসেছি। অবশ্য তার জন্যে ভরসা ছিল ভাগ্নী–জামাই, জুয়েল। গুগল ঘেঁটে ও তার পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে সে ঠিক করে রেখেছিল কয়েকটি দর্শনীয় স্থান। প্রথমদিন তো আমরা রাজধানী হেলসিংকি শহর ঘুরে বেড়ালাম। সন্ধ্যার সময় গেলাম মূল শপিং এলাকায়। বিশাল রেল স্টেশন লাগোয়া বড় চত্বর। সেখানে শপিং মল, মার্কেট, রেস্টুরেন্ট। ডিনারের জন্যে আমরা বেছে নেই এক থাই রেস্তোরাঁ। যে হোটেলে উঠেছি (স্ক্যান্ডিক গ্রান্ড মেরিনা) সেখান থেকে হাঁটার দূরত্বে এই শপিং সেন্টার ও রেঁস্তোরা। এখানে আসা ও হোটেলে ফিরে যাবার পথে লক্ষ্য করলাম, রাস্তায়, ট্রাম স্টপেজে কোথায়ও একটি ছেঁড়া কাগজ বা ময়লার টুকরো নেই। তার চাইতেও যা আমাকে অবাক ও মুগ্ধ করলো তা হলো, আসার পথে দেখেছিলাম একটি ‘ওপেন কনসার্ট’ হচ্ছে। নানা বয়েসী দর্শক–শ্রোতা, বেশির ভাগ তরুণ–তরুণী, স্টেজের সামনে, দূরে, এখানে–ওখানে দাঁড়িয়ে বীয়ার থেকে শুরু করে নানা ধরণের মদ খেয়ে কনসার্ট উপভোগ করছে। তাদের অনেকে গানের তালে তালে নাচছে। সাধারণত এই ধরনের মিউজিক ফেস্টিভ্যালে যত্রতত্র বীয়ারের ক্যান, খাবারের প্যাকেট, আরো নানা ধরনের উচ্ছিষ্ঠ পড়ে থাকতে দেখা যায়। অনুষ্ঠান শেষে মিউনিসিপ্যালিটির লোকজন গাড়ি নিয়ে এসে তা পরিষ্কার করে। হল্যান্ডে এমনটিই ঘটে। কিন্তু হেলসিংকির এই মিউজিক্যাল ফেস্টিভেলে দেখলাম, উপস্থিত লোকজন পথের ধারে রাখা নির্দিষ্ট বিনে উচ্ছিষ্ট খাবার বা মদ–বীয়ারের বোতল ফেলছে। রাস্তায় সামান্যতম ময়লাও চোখে পড়লো না। অবাক করা ব্যাপার বটে। এই প্রসঙ্গে হল্যান্ডের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ না করলেই নয়। বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা। তখন হল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন চট্টগ্রামের সন্তান, শেখ মোহাম্মদ বেলাল। দেশের বিভিন্ন জাতীয় দিবসে তিনি তার সরকারি বাসভবনের পেছনের বড়সর মাঠে আয়োজন করতেন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। কখনো–সখনো দেশ থেকে তারকা–শিল্পীকে আনার ব্যবস্থা করতেন। অনুষ্ঠানে হল্যান্ড প্রবাসী বাংলাদেশীরা আমন্ত্রিত। প্রতিটি অনুষ্ঠানে লাঞ্চের ব্যবস্থা করা হতো। তাতে থাকতো মাছের রাজা ইলিশ থেকে শুরু করে মুখরোচক নানা খাবার। অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে দেয়া হতো লাঞ্চ। অনুষ্ঠান শেষে দেখা গেল মাঠের বিভিন্ন স্থানে, বসার চেয়ারের নিচ থেকে শুরু করে বাগানে– সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে ব্যবহৃত ওয়ান–টাইম প্লাষ্টিক প্লেট, চা–কফির কাপ। অথচ, মাঠের বিভিন্ন দিকে রাখা আছে বিন। লাঞ্চের আগে ঘোষণা দিয়ে উপস্থিত দর্শক–শ্রোতাদের অনুরোধ জানানো হয় তারা যেন নির্দিষ্ট স্থানে খাবারের অবশিষ্টাংশ বা উচ্ছিষ্ট ফেলেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা। সেখানেই শেষ নয়। অনুষ্ঠান শেষে দেখা গেলো রাষ্ট্রদূত পত্নীর নিজহাতে গড়া ফুলের বাগানের বেহাল দশা। উন্নত, সভ্য দেশে থেকেও কী অসভ্য আচরণ প্রবাসী বাংলাদেশিদের। অথচ এরা নিজ গৃহে এমন আচরণ করেন বলে মনে হয়না। ‘আসলে আমাদের ডিএনএ–র মধ্যে কোথায়ও কোন গন্ডগোল আছে‘, মন্তব্য এক প্রবাসী বাংলাদেশির। যাই হোক ফিরে আসি হেলসিংকিতে।
ফিনল্যান্ডে যে স্থানটিতে এসে মন জুড়িয়ে গেল তাহলো ‘সুমেনলিনা’ সামুদ্রিক দুর্গ’। ইংরেজিতে অনুবাদ করলে এর অর্থ দাঁড়ায় ‘ক্যাসেল অব ফিনল্যাণ্ড’ অর্থাৎ ‘ফিনল্যান্ডের দুর্গ’। আটটি দ্বীপের সমন্বয়ে গড়ে উঠা এই বড় আকারের ‘সামুদ্রিক দুর্গ’। একটির সাথে অন্য দ্বীপের সংযোগ ঘটেছে ব্রিজ তৈরি করে। রাজধানী হেলসিংকি শহরের দক্ষিণ–পূর্বে অবস্থিত এই স্থানে যাবার একমাত্র উপায় নদীপথ। এটি ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিঙ্কি শহর–কেন্দ্রের প্রায় চার কিলোমিটার দক্ষিণ–পূর্বে। আমাদের হোটেলের কাছাকাছি ফেরি বা জাহাজ ঘাট। অটোমেটিক মেশিন থেকে টিকেট কেঁটে ছোটখাট দোতলা জাহাজে চড়ে সেখানে যাওয়া হয় আমাদের। সেদিন ছিল প্রচন্ড ঠান্ডা। গায়ে সোয়েটার, ভারী ওভারকোট, মোটা হাত মোজা, মাথায় কান–ঢাকা সহ উলের টুপি। মোট কথা ঠান্ডা থেকে বাঁচার তাবৎ ব্যবস্থা। তারপরও ট্যুরিষ্টের কমতি নেই। দ্বীপে পৌঁছুতে যে সময়টুকু (প্রায় আধা ঘন্টা) পানির মধ্যে কাটলো সে এক চমৎকার দৃশ্য, অদ্ভুদ ভালোলাগা। যেতে যেতে চোখে পড়ে কয়েকটি ছোট্ট দ্বীপ, কিছু গাছগাছালি, কয়েকটি বাড়ি। মানুষজন চোখে পড়ে না। শান্ত বয়ে যাওয়া পানি, তাতে কোন ঢেউ নেই। জানা যায়, রাশিয়ার আগ্রাসন ঠেকাতে ১৭৪৮ সালে সুইডিশ রাজা এই দ্বীপপুঞ্জের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ১৮০৮ সালের ৩ মে মাসে রাশিয়া এই দ্বীপপুঞ্জটি নিজ দখলে নেয় এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এটিকে তাদের বাল্টিক বহরের ‘বেইস’ হিসাবে ব্যবহার করে। সফল রুশ বিপ্লবের পর ফিনল্যান্ড ১৯১৭ সালে নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করলে রাশিয়া সেখান থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়। ১৯৯১ সালে সুমেনলিনাকে ইউনেস্কো ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ হিসাবে ঘোষণা দেয়। প্রকৃতপক্ষে, এটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটে অন্তর্ভুক্ত হবার মত একটি স্থান। এখানে কোন গাড়ি চলাচল করে না। কদাচিৎ একটি দুটি গাড়ি অতি ধীরগতিতে এগিয়ে যেতে দেখেছি। রাস্তাগুলিতে শক্ত কংক্রিট পাথর বসানো, মসৃন নয়। বিভিন্ন দিকে এগিয়ে গেছে এই ধরনের কংক্রিটের রাস্তা। কোথায়ও কোথায়ও হাতে গোনা কিছু গিফট শপ, টয়লেট, ছোটখাট রেস্তোরাঁ যাতে এই দ্বীপপুঞ্জে ঘুরতে আসা পর্যটকরা কিছু খেতে ও ক্ষনিকের তরে বিশ্রাম নিতে পারেন। কেননা গোটা এলাকা হেঁটে দেখা ছাড়া আর কোন পথ নেই। বহিঃশত্রু আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্যে যে সমস্ত দুর্গ এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে তা বাস্তবিক দেখার মত। কেবল ভাবি কয়েকশ বছর আগে, যখন আধুনিক কোন মাধ্যম ছিলনা, কী করে এই সমস্ত প্রকান্ড দুর্গ বানানো সম্ভব হয়েছিল। পাহাড়ের চূড়ায় এখনো সমুদ্রের দিকে তাক করে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছু অকেজো কামান। সে সময় তো সমুদ্র পথই ছিল পরদেশ আক্রমনের একমাত্র উপায়। আমরা এক পাহাড়ের চূড়া থেকে অন্য পাহাড়ের চূড়ার দিকে এগিয়ে যাই।
এক সময় দেখা প্রায় সত্তর বয়সী (অনুমান নির্ভর) এক সুদর্শন ফিনিশ ভদ্রলোকের সাথে। তিনি আমার উল্টোদিক থেকে হেঁটে আসছিলেন। প্রথমে ভেবেছিলাম তিনিও আমাদের মত বেড়াতে এসেছেন। তার দিকে এগিয়ে যাই। তার সাথে কথা বলা যাবে কিনা জানতে চাইলে তিনি চমৎকার ইংরেজিতে হ্যাঁ–সূচক উত্তর দেন। এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘এই দ্বীপে আমি আছি প্রায় ২৫ বছর ধরে। বছর খানেক আগে আমার স্ত্রী মারা গেছেন।’ জানতে চাই, অনেকটা নির্জন এই দ্বীপে একা কী করে থাকেন? খারাপ লাগে না? এখানে তো কোন বাজার বা দোকান নেই। কেনাকাটা কীভাবে, কোথায় করেন?” উত্তরে বলেন, ‘না, আমার কোন সমস্যা হয় না। এতো সবুজ এই দ্বীপ, চমৎকার প্রকৃতি। শহরের কোলাহল নেই। সপ্তাহের দুইদিন ফেরি পার হয়ে শহরে যাই বাজার করতে। ছেলেরা আছে, কিন্তু ওরা এখানে থাকে না। ওরা হেলসিংকি শহরে।’ এই দ্বীপপুঞ্জে মাত্র ৮০০ লোকের বসবাস। কথা বলতে বলতে এগিয়ে চলি আমরা দুজন। কিছুটা পথ এগিয়ে যেতে আমাদের পথ দুদিকে ভাগ হয়ে যায়। তিনি ধীর পায়ে এগিয়ে চলেন বা–দিকে এগিয়ে যাওয়া রাস্তা ধরে। আমি এগিয়ে যাই সামনে দূরে হেঁটে চলা আমার দলের সদস্যদের সাথে যোগ দিতে। ভাবি– কী অপূর্ব শোভা, প্রকৃতি কত সুন্দর। চারিদিকে সবুজ গাছগাছালি আর বিশাল জলরাশি। মনে পড়ে অনেক আগে পড়া চমৎকার উক্তি : The earth has its music for those who will listen আমিও কান পাতি, ভেসে আসে পৃথিবীর সংগীত।
(৩০–০১–২০২৫)
লেখক
সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট