প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ ছিলেন একজন ‘আপাদমস্তক ভদ্রলোক’। ভদ্রলোকের সংজ্ঞা কী? ইংরেজ জীব ও নৃবিজ্ঞানী থমাস হেনরি হাক্সলির মতে, অন্যের ভালোর জন্যে যিনি চিন্তা ও কাজ করেন, যিনি উদারতা, বিনয় এবং আত্মসম্মানের অধিকারী তিনিই প্রকৃতপক্ষে ‘ভদ্রলোক’। প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদকে যাদের দেখা, চেনা ও জানাশোনার সুযোগ হয়েছে তারা, আমার বিশ্বাস নির্ধিদ্বায় স্বীকার করবেন যে, তার মাঝে এই সমস্ত গুণাবলীর সমন্বয় তো ঘটেছিল, বরঞ্চ এর বাইরে ভদ্রলোকের সংজ্ঞায় আর যা যা গুণাবলী রয়েছে তারও সমন্বয় ঘটেছিল। আর ঘটেছিল বলেই তিনি ছিলেন সর্বজনশ্রদ্ধার পাত্র। দেখতে আর পাঁচ–দশ জনের চাইতে খুব একটা ব্যতিক্রম ছিলেন না। কিন্তু তার মাঝে এমন কিছু একটা ছিল যা মানুষের মনে শ্রদ্ধার ভাব জাগ্রত করতো আপনাতেই। প্রচার–বিমুখ ও নিজের মাঝে নিজেকে গুটিয়ে রাখা প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এক আদর্শবাদী ও ত্যাগী ব্যক্তিত্ব। নির্মোহ ছিলেন বলেই ক্ষমতা, বিত্ত–বৈভব তাকে টানতে পারেনি। ছাত্র বয়স থেকে ছিলেন রাজনীতিতে সচেতন, পরবর্তীতে সক্রিয় রাজনীতিতে নিজেকে জড়িয়েছেন এবং সফল হয়েছেন। তার জীবন এমনই ঘটনাবহুল ও বিচিত্র যে তার কোন সত্তাটি বড় সেটি নির্দিষ্ট করে বলা এক দুরূহ কাজ। জীবন ও জীবিকার তাগিদে কাজ করেছেন ব্যাংকে, করেছেন ব্যবসা। বীমার সাথেও নিজেকে জড়িয়েছেন। দিন শেষে সাংবাদিকতা এবং সেখান থেকেই তার প্রস্থান, চিরদিনের তরে। মজার ব্যাপার হলো, তিনি সাংবাদিকতায় আসেন তার ভাষায় ‘বাই চান্স’, অর্থাৎ ‘দৈবক্রমে’। ভাবি যদি ‘বাই চান্স’ প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ সাংবাদিকতায় না আসতেন তাহলে আজকের দৈনিক আজাদীর যে অবস্থান, সে অবস্থানে পৌঁছুতে পারতো কি? কথাটি ‘হাইপোথেটিক্যালি’ বলা। হয়তো পারতো, কিংবা নাও পারতো। তবে সে যাই হোক না কেন এটি অনস্বীকার্য যে ‘দৈবক্রমে’ সাংবাদিকতায় আসা এই ব্যক্তিটি একদিকে যেমন চট্টগ্রামের সাংবাদিকতাকে এক উচ্চাসনে নিয়ে যেতে অবদান রেখেছেন, ঠিক তেমনি এই নগরীতে সাহিত্য, সংস্কৃতি প্রসারেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে গেছেন। একটা সময় ছিল যখন ‘আজাদী’ আর প্রফেসর খালেদ ছিলেন যেন মুদ্রার এপিট–ওপিট। এখন যেমনটি আজাদী ও বর্তমান সম্পাদক এম এ মালেক, যিনি প্রফেসর খালেদের মৃত্যুর পর পত্রিকার হাল ধরেছেন, এগিয়ে নিয়ে গেছেন দক্ষ হাতে। প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আই এম এ প্রোডাক্ট অব আজাদী। আজাদী যদি আমাকে শেষ আশ্রয় না দিতো, তাহলে আমার জীবনটা অন্য রকম হয়ে যেতো। কত রকম ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে কোথায় চলে যেতাম। দেশ, রাষ্ট্র যে সম্মান আমাকে দিয়েছে, তা আজাদী এনে দিয়েছে। অন্যথায় আমার মনে হয় না আমি কিছু পেতাম। এত ঘাটে, কত ঘাটে গেলাম। আমার রাজনৈতিক জীবন। কোথায়ও আমি নেই। কিন্তু আজাদীতে চিরদিনের জন্যে রয়ে গেলাম।’ (সাক্ষাৎকার : শরীফা বুলবুল ও হোসেন শহীদ)।
২) বিনয়ী ও কৃত্রিম–গাম্ভীর্যহীন প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদকে কাছ থেকে দেখা ও জানার সৌভাগ্য ও সুযোগ আমার হয়েছিল। তবে সেটি অনেকটা ‘ক্ষণিক দেখায় আধেক চেনার’ মত। তাকে প্রথম দেখা আন্দরকিল্লার মোড়ের কাছাকাছি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালের সামনে দৈনিক আজাদী অফিসের পুরানো ধাঁচের এক বিল্ডিংয়ের দোতলায়। আশির দশকের শুরুতে অনার্স পরীক্ষা দিয়ে যখন রেজাল্টের অপেক্ষায়, সে সময়টায় বেশ ঘটা করে চট্টগ্রাম থেকে বের হয়েছিল ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা, দি ডেইলি লাইফ। বাবার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে (তখনও মাস্টার্স দেয়া হয়নি বলে) যোগ দিয়েছিলাম সাংবাদিকতায়। অনেকটা হুট করে। এই ব্যাপারে প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদের সাথে আমার মিল। আমারও সাংবাদিকতায় প্রবেশ হুট করে, ‘উঠ ছুড়ি তোর বিয়ে লেগেছে’ বলে কনেকে বিয়ের–পিড়িতে বসিয়ে দেয়ার মত কিংবা প্রফেসর সাহেবের ভাষায় ‘বাই চান্স’। যাই হোক, তখন প্রায়–সকালে (এগারটা নাগাদ) যেতাম দৈনিক আজাদী অফিসে, তখনকার রিপোর্টার, সিনিয়র বন্ধু এম নাসিরুল হকের সাথে। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতেই চোখে পড়তো একটি টেবিলকে ঘিরে জনা–কয়েক সাংবাদিক বসে। তাদের একজন প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ। পত্রিকা অফিস আর আড্ডা – এ যেন ‘সিনোনিম’। আড্ডা ছাড়া পত্রিকা অফিসে বিশেষ করে নিউজ ডেস্কের কথা ভাবাই যায় না। কাজের ফাঁকে ফাঁকে চলে আড্ডা। তবে তখন সে আড্ডায় অংশ নেবার মত জ্ঞান, অভিজ্ঞতা বা বয়স কোনোটিই আমার হয়নি। মাঝে মাঝে একটু দূরে ক্ষণিক দাঁড়িয়ে শুনতাম। এর অনেক পর যখন হল্যান্ড চলে আসি নব্বই দশকের প্রথমার্ধে, তখন থেকে তার সাথে যোগাযোগটা বলা চলে বাড়ে। সেটি ঢাকায় বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশে (পিআইবি) কর্মরত বিশিষ্ট সাংবাদিক, লেখক বন্ধু মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরের হাত ধরে। হল্যান্ড থেকে আমার পাঠানো লেখাগুলি ডাকযোগে প্রথম দিকে যেত জাহাঙ্গীর ভাইয়ের কাছে, তিনি তা ডাকযোগে পাঠিয়ে দিতেন প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদের কাছে। এক সময় লেখা সরাসরি প্রফেসর সাহেবের কাছে পাঠানো শুরু করলাম। তিনি অতি যত্নে আমার লেখাগুলো গুরুত্ব দিয়ে উপ–সম্পাদকীয় পাতায় ছাপতেন। দেশে এলে তার সাথে দেখা হলে মাঝে মধ্যে লেখার বিষয় নিয়ে পরামর্শ দিতেন। তখন টের পেলাম, পরিচয়ের শুরুতে তাকে যেমনটি মনে হয়েছিল, তিনি তার ঠিক উল্টো। দেখলাম সহজ, সরল, স্বল্পভাষী, নিরহংকারী এক ব্যক্তি। অন্যের কাছে নিজেকে প্রকাশ করার বিন্দুমাত্র প্রবণতা নেই। অথচ আমরা যারা অল্প জানি (কথায় আছে অল্প বিদ্যা ভয়ংকর), আমাদের মাঝে নিজেকে অনেক–জানি বলে অন্যের কাছে তুলে ধরার একটা তাগিদ কাজ করে, জেনে বা না–জেনে। প্রফেসর সাহেবের মাঝে এই বিষয়টি কোনদিন দেখিনি। বোধকরি সে কারণে তিনি অন্যদের কাছ থেকে কেবল আলাদা নন, আর দশজনকে ছাড়িয়ে তিনি ছিলেন অনন্য। যেন ‘আপন মহিমাতে আপনি উদ্ভাসিত’। প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদকে নিয়ে বিস্তর লেখা যায়। কিন্তু এই পাতায় সে সুযোগ নেই। যদ্দুর জানি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি দৈনিক আজাদীর সম্পাদকের গুরু দায়িত্ব পালন করেন। একচল্লিশ বছরেরও কিছু বেশি সময় তিনি জড়িত ছিলেন এই পত্রিকার সাথে, যার শুরু পত্রিকার স্থপতি ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের ১৯৬২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর মৃত্যুর পর। দৈনিক আজাদী প্রকাশের মাত্র দুই বছর ২০ দিন পর ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক মারা যান। প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ মৃত্যুবরণ করেন ২০০৩ সালের ২১ ডিসেম্বর, আমার হল্যান্ড আসার ১৩ বছর পর। এর আগে ১৯৬০ সালে ৫ সেপ্টেম্বর দৈনিক আজাদী প্রকাশ করার পর ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদকে পত্রিকার সাথে সংযুক্ত করেন এবং তার (স্থপতি) মৃত্যুর পর তিনি সম্পাদক হিসাবে এর হাল ধরেন।
৩) একবার দেশে এলে খবর পেলাম প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ অসুস্থ। নাসির ভাইকে নিয়ে কোন আগাম বার্তা ছাড়াই এক দুপুরে তাকে দেখতে গিয়েছিলাম সিরাজুদ্দৌলা রোডে মোবারক মঞ্জিলের দোতলায় তার বাসায়। ছিমছাম বাড়ি, জৌলুসের কোন বাড়াবাড়ি নেই। সাথে নাসির ভাইয়ের ব্যাংকার স্ত্রী, আমার তিন বছরের মেয়ে সপ্তর্ষি ও তার মা। আমাদের সমাদর করে বসালেন ড্রয়িং রুমে। ততক্ষণে সপ্তর্ষি তার মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে। তা দেখে প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বাসায় তিনি একা। বার কয়েক নিষেধ সত্ত্বেও তিনি ভেতরের কামরায় নিয়ে গিয়ে, নিজে বিছানায় নতুন চাদর বিছিয়ে সপ্তর্ষিকে শুইয়ে দেবার ব্যবস্থা করলেন। এই কাজটুকু তিনি না করলেও পারতেন। সপ্তর্ষি তার মায়ের কোলে ভালোই ছিল। কিন্তু তারপরও নিজে অসুস্থ অবস্থায় থেকে প্রফেসর সাহেব এই কাজটি করলেন। এরপরও কি উনি কোন ধাতুতে গড়া মানুষ তা বলার অপেক্ষা রাখে? স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বন্ধু নাসিরুল হক একবার বলেছিলেন, “সংবাদ পরিবেশনার ক্ষেত্রে প্রফেসর সাহেব ছিলেন আপোষহীন। আমরা রির্পোঁ তৈরী করে ডেস্কে দিতাম। মাঝে মধ্যে দেখেছি প্রফেসর সাহেব নিউজটা ঠিক করতে গিয়ে পুরো–সংবাদটিকেই পরিবর্তন করতেন। কিন্তু এ নিয়ে ‘এটি এমন কেন হয়েছে কিংবা অমন কেন হয়েছে’– এই ধরনের কোন অনুযোগ বা অভিযোগ করতেন না।” সে ১৯৮৬ সালের কথা। দৈনিক আজাদী আন্দরকিল্লার পুরানো বিল্ডিং থেকে আজকের ভবনে ঠাঁই পাবার কিছুদিন আগে প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ পত্রিকার সবাইকে নিয়ে নতুন ভবনে এলেন। প্রথম আসা, অতএব দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে কিছু তো খাওয়া যায়। প্রবীণ সাংবাদিক ও লেখক অরুণ দাশগুপ্ত প্রস্তাব রাখলেন, মুড়ি–গুড় এনে খাওয়া যায়। নাসির ভাই গোঁ ধরে বলেন, আজকের দিনে মুড়ি–গুড়ে চলবে না, চাই মিষ্টি। শেষ পর্যন্ত তাই আনা হলো। কথাগুলি নাসির ভাইয়ের মুখ থেকে শোনা। আর একটি মজার ঘটনার কথা বলে ইতি টানবো আজকের এই শ্রদ্ধাঞ্জলি। অফিসে তিনি বসতেন বার্তা সম্পাদক সাধন বাবুর পাশের চেয়ারে। তারা দুজন ছোট কালের বন্ধু। একদিন সাধন বাবু চেয়ার থেকে উঠে টয়লেট গেলেন। প্রফেসর খালেদ নিজ চেয়ার ছেড়ে সাধন বাবুর চেয়ারে বসে ড্রয়ার খুলে সেখান থেকে সিগারেট বের করে খেতে লাগলেন। সাধন বাবু ফিরে এসে ড্রয়ার থেকে প্যাকেট বের করে বলেন, ‘আমার পাশে এসে বসেছো কি এই কারণে? আমি সিগারেট গুনে রাখি।’ এমনই ছিল সাংবাদিকতার এই দুই দিকপালের সম্পর্ক। একসাথে তারা মঞ্চে নাটক করেছেন, রাজনীতি করেছেন, কলেজে শিক্ষকতা করেছেন, যদিও বা দু’জন দু’কলেজে। প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ নাজিরহাট কলেজে, সাধন ধর রাউজান স্কুলে। সাধন ধরেরও সাংবাদিকতায় আসা প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদের হাত ধরে। সাধন ধরের কথায় -‘খালেদ সাহেব আমাকে বললেন, ঘরের খেয়ে পরের মৌষ চড়ানোর কী দরকার। আমরা পত্রিকা বের করছি, এখানে জয়েন কর। তারপর সেই যে আজাদী–তে আসলাম প্রফেসর খালেদের হাত ধরে, সেই থেকে আমি সাংবাদিকতায়।’
মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য, সংসদ সদস্য, স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত এবং সব ছাড়িয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র, দৈনিক আজাদীর অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের আজ ২১তম মৃত্যুবার্ষিকী। বেঁচে থাকলে আজ তার বয়স হতো ১০২ বছর পাঁচ মাস ১৫ দিন। তার জন্ম হয়েছিল ১৯২২ সালের ৬ জুলাই অবিভক্ত ভারতের বিহার রাজ্যের রাজধানী পাটনায়। তার পৈতৃক নিবাস চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলা সুলতানপুর গ্রামের দারোগা বাড়িতে। আজকের দিনে তাকে, আর কর্মকে স্মরণ করি শ্রদ্ধাভরে।
লেখক
সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট