গেল সংখ্যায় লেখা এসে থেমেছিল ‘নোবেল পুরস্কার’ প্রবর্তক, আলফ্রেড নোবেলে। আজকের লেখা শুরু ঠিক সেখান থেকে। নোবেল প্রাইজ সম্পর্কে অনেকের জানা। কিন্তু এই নোবেল পুরস্কার প্রবর্তনের পেছনে যে একটি মজার ঘটনা রয়েছে সেটি হয়তো অনেকের জানা নেই। ফরাসি এক সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি মৃত্যু–ঘটনাকে কেন্দ্র করে সে ঘটনা। ‘নোবেল পুরস্কার’ হয়তো কখনো দিনের আলো দেখতো না, যদি পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত একটি মৃত্যু সংবাদ ভুলভাবে ছাপা না হতো। সুইডিশ নাগরিক ও সফল যুদ্ধাস্ত্র, বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেলের ভাই, লুডভিগ যখন মারা যান, তখন একটি ফরাসি সংবাদপত্র ভুল করে তিনি (নোবেল) মারা গেছেন উল্লেখ করে একটি মৃত্যু সংবাদ পরিবেশন করে। প্রকাশিত ওই সংবাদে আলফ্রেড নোবেলের একটি দীর্ঘ স্মৃতিচারণ করা হয়। তা পড়ে আলফ্রেড নোবেল রীতিমত আতংকিত ও হতাশ হয়ে পড়েন। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সংবাদপত্রটি তাকে ‘মার্চেন্ট অব ডেথ’ অর্থাৎ ‘মৃত্যুর সওদাগর’ হিসাবে আখ্যায়িত করে লেখে, ‘তিনি ছিলেন এমন এক ব্যক্তি যিনি ধনী হয়েছিলেন বেঁচে থাকা অন্য আর কারো চাইতে খুব দ্রুত বেশি সংখ্যক মানুষ হত্যা করার উপায় বের করে।’ আলফ্রেড নোবেল (১৮৩৩–১৮৯৬) ছিলেন সফল যুদ্ধাস্ত্র ব্যবসায়ী এবং মারণাস্ত্র ডিনামাইটের আবিস্কারক। সংবাদটি পড়ে আলফ্রেড নোবেলের মনে হলো তিনি যদি মারা যান তাহলে তাকে মানুষ এইভাবে স্মরণ করবে, যা তিনি কিছুতেই চাননা। সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি এমন কিছু করবেন যাতে মানুষ তার মৃত্যুর পরও তাকে পজিটিভলি স্মরণ করে। আলফ্রেড নোবেল প্রচুর বিত্ত–সম্পত্তি অর্জন করেছিলেন। মৃত্যুর প্রায় বছর খানেক আগে তিনি তার শেষ উইল লিখে যান। তাতে তিনি উল্লেখ করেন যে তার রেখে যাওয়া ৩১ মিলিয়ন সুইস ফ্রাঙ্ক (আজকের মূল্যে ১৬০ মিলিয়ন ডলারের বেশি) মূল্যের সম্পত্তি নিয়ে একটি ফান্ড তৈরি করতে হবে এবং তা ‘সেইফ সিকিউরিটিজ’–এ বিনিয়োগ করে, সেখান থেকে যে বাৎসরিক আয় হবে তা ‘মানবতার কল্যাণে’ যারা বিশেষ অবদান রাখবেন তাদের পুরস্কারের আকারে ভাগ করে দেয়া হবে। নিশ্চয় জানতে ইচ্ছে করছে, একজন নোবেল বিজয়ী কী পরিমাণ অর্থ পুরস্কার হিসাবে পেয়ে থাকেন। একজন নোবেল বিজয়ী ২৪ ক্যারেট স্বর্ণের প্রলেপ দেয়া একটি পদক ছাড়াও একটি সনদ এবং এক লক্ষ ৩৫ হাজার মার্কিন ডলার (২০২৩ সাল) লাভ করেন। বিশাল পুরস্কারের মত বিশাল যে এই অংক এতে কোন সন্দেহ নেই। বলা বাহুল্য, নোবেল পুরস্কারকে বিশ্বের সবচাইতে মূল্যবান ও মর্যাদাপূর্ণ বলে গণ্য করা হয়। এবার দেখা যাক এই পুরস্কারের পেছনের কাহিনী।
২ ॥ পাহাড়ের দেশ সুইডেন। তবে এ মাটির পাহাড় নয়, শক্ত পাথরের পাহাড়। হেঁটে, গাড়িপথে কিংবা বাস–ট্রেনে চলতে গিয়ে যত্রতত্র চোখে পড়ে। পাহাড় কেটে জনপদ ও সড়ক তৈরি করা ছিল একটা সময় অত্যন্ত দুরূহ কাজ। আলফ্রেড নোবেল ছিলেন বিজ্ঞানী। শিক্ষার এক পর্যায়ে তিনি ইতালীয় রসায়নবিদ (কেমিস্ট) আসকানিও সবরেরোর (Ascanio Sobrero) সাথে সাক্ষাৎ করেন যিনি ‘নাইট্রোগ্লিসারিন’ আবিষ্কার করেছিলেন। এই পদার্থ দিয়ে ভারী বিস্ফোরণ ঘটানো যায়। কিন্তু এটি ছিল বিপজ্জনক কারণ কোন সতর্কতা ছাড়াই এটি বিস্ফোরিত হতে পারে। আলফ্রেড চেয়েছিলেন নাইট্রোগ্লিসারিনকে নিরাপদ ও আরো উপযোগী করে তুলতে। তিনি দেখলেন যদি এই পদার্থের সাথে কাদামাটি মিশিয়ে বিস্ফোরক তৈরি করা যায়, তাহলে সেটি নিরাপদজনক হবে। এইভাবে তিনি তৈরি করলেন ‘ডিনামাইট’। এরপর তিনি ফিউজ দিয়ে দূর থেকে ডিনামাইট বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য ‘ব্লাস্টিং ক্যাপ’ তৈরি করেন। এই উদ্ভাবনগুলি সুড়ঙ্গ, খাল নির্মাণ বা বড় পাথর অপসারণের মতো কঠিন কাজকে সহজ ও নিরাপদ করে তোলে। গেলবার যখন সুইডেন গিয়েছিলাম সময়াভাবে ‘নোবেল মিউজিয়ামে’ যাবার সুযোগ হয়নি। এবার আগে থেকেই একটি তালিকা তৈরি করে নেই, সুইডেনে গিয়ে দর্শনীয় কী কী দেখবো তার। তার মধ্যে একটি ছিল ‘নোবেল মিউজিয়াম’। রাজধানী স্টকহোমেই দাঁড়িয়ে আছে এই মিউজিয়াম। আকারে খুব যে একটা বড় তা নয়, কিন্তু সবকিছু কি আর আকার দিয়ে মূল্যায়ন করা যায়। আমরা তো কথায় কথায় বলি, ‘সাইজ ডাজ নট মেটার’। রাজধানী স্টকহোমের পুরানো শহর, গামলা স্টান (GamlaStan) এর পুরানো স্টকএক্সচেঞ্জ বিল্ডিংয়ে এই মিউজিয়াম ঠাঁই পেয়েছে। ভাগ্নি জামাই জুয়েলকে নিয়ে এক সকালে তার গাড়িতে রওনা দেই মিউজিয়ামের উদ্দেশ্য। এর আগে যেদিন যাবার কথা ছিল দেখা গেল সেদিন মিউজিয়াম বন্ধ। অতএব মিউজিয়াম না দেখে চলে যেতে হয় ফিনল্যান্ড। কেননা রাজধানী হেলসিংকির প্লেনের টিকেট আগেই কাটা হয়েছিল। হোটেলও বুক করা হয়ে গিয়েছিল। ফিনল্যান্ড থেকে পুনরায় সুইডেন ফিরে তিন দিনের মাথায় হল্যান্ড ফিরবো এমনটাই আগে থেকে প্ল্যান করা। ভাবলাম দু–দুবার সুইডেন এসে নোবেল মিউজিয়াম না দেখে ফিরে যাবো? আর যখন এটি রাজধানী স্টকহোমে, জুয়েলের বাসা থেকেও খুব একটা দূরে নয়। মনের ভেতর কেমন যেন খটকা লাগছিল। হল্যান্ড ফেরার দিন এয়ারপোর্ট যাবার আগে হাতে বেশ কয়েক ঘন্টা। জুয়েল জোর করে, বলে, ‘আধ ঘন্টার তো ড্রাইভ, টাইম কভার করবে, চলেন ঘুরে আসি।’ সুমনা, ভাগ্নি কণিকা, ওদের দুই কন্যা গেলোনা। ওরা ব্যস্ত হয়ে পড়লো রান্নাবান্না নিয়ে। ঘরের বাইরে ঠান্ডা হলেও চমৎকার রৌদ্রস্নাত দিন। আমরা দুজন বেরিয়ে পড়ি। মিউজিয়ামের কাছাকাছি পৌঁছে গাড়ি পার্কিং করতে কিছু সময় লেগে গেল। খালি জায়গা পাওয়া বড় সমস্যা। হল্যান্ড সহ ইউরোপের প্রায় সব দেশে একই, অভিন্ন চিত্র। মিউজিয়াম প্রবেশ–পথে হাতের ব্যাগ খুলে চেক করলো। টিকেট কেটে ভেতরে গিয়ে চোখে পড়ে নোবেল পুরস্কার ও নোবেল–বিজয়ীদের সম্পর্কে তথ্য, তাদের ছবি, চিঠি ইত্যাদি। নোবেল বিজয়ীদের কারো কারো ব্যবহৃত দ্রব্যাদি যেমন চশমা, স্যান্ডেল, চুরুটের পাইপ, চিঠি, কাঁচের বাঙে সাজানো। তাতে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী দালাই লামা থেকে শুরু করে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কুইজের ব্যবহৃত চোখের চশমা, জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল কফি আনানের আর্মব্যান্ড, ১৯৭১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া পাবলো নেরুদার চুরুটের পাইপ, প্রফেসর আব্দুস সালামের ব্যবহৃত জুতা, আছে নোবেল বিজয়ীদের ব্যবহৃত পুরানো আমলের টাইপ মেশিন, ডিক্শনারি, চামড়ার সুটকেস ইত্যাদি। ব্যতিক্রম, একটি কাঁচের বাক্সে রাখা একটি গোল্ড মেডেল। যিনি এই পদক পেয়েছিলেন তিনি তা গ্রহণ করেননি। ১৯৭৩ সালে শান্তির জন্যে তিনি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হ্যানরি কিসিঞ্জারের সাথে যৌথভাবে এই পুরস্কার পেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন উত্তর ভিয়েতনাম ও আমেরিকার যুদ্ধ বন্ধে উত্তর ভিয়েতনামের প্রধান মধ্যস্ততাকারী, লী ডাক থো। কিসিঞ্জার তার পুরস্কার গ্রহণ করে সুইডিশ একাডেমিকে ধন্যবাদ জানিয়ে চিঠি দেন। অন্যদিকে, নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়ে লী ডাক থো সুইডিশ একাডেমিকে টেলিগ্রাম পাঠিয়ে লেখেন, ‘যুদ্ধ এখনো চলছে, তাই আমি এই পুরস্কার গ্রহণ করতে অক্ষম।’ এরপর লী আর কখনো পুরস্কারটি গ্রহণ করেননি এবং সেটি বর্তমানে সেখানে সংরক্ষিত রয়েছে। নোবেল পুরস্কার নিয়ে বিতর্কেরও শেষ নেই। কোন পুরস্কার দেয়া হয়েছে রাজনৈতিক কারণে, কোন পুরস্কার দেয়া হয়েছে এমন ব্যক্তিকে যাতে খোদ নোবেল পুরোষ্কারকেই খাটো করা হয়েছে– এই ধরনের অনেক অভিযোগ রয়েছে। এই নিয়ে আগামীতে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছে রইলো। এখন ফিরে যাই নোবেল মিউজিয়ামে।
৩ ॥ কয়েকটি কামরা নিয়ে গড়ে উঠা এই মিউজিয়ামে দেখা মিললো প্রথম বাঙালি নোবেল পুরস্কার বিজয়ী, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবি, সাথে সংক্ষিপ্ত বিবরণ। কী বিষয়ে, কোন সালে পুরস্কার পেয়েছেন ইত্যাদি ইত্যাদি তথ্য। সযত্নে রক্ষিত আছে সব তথ্য। রক্ষিত আছে বাংলাদেশের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ছবি, সাথে সংক্ষিপ্ত তথ্য। শান্তির জন্যে ২০০৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের সাথে তাকে যৌথভাবে দেয়া হয় নোবেল পুরস্কার। তিনিই প্রথম ও একমাত্র বাংলাদেশি যিনি এই সম্মান লাভ করেন। যেদিন প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনুস নোবেল পুরস্কার লাভ করেন সেদিন আমার সুযোগ হয়েছিল ফোনে হল্যান্ড থেকে তাকে অভিনন্দন জানাতে। আর সেটি সম্ভব হয়েছিল তার পাশে সেই মুহূর্তে বসে থাকা তার ছোট ভাই, আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সিনিয়র সহকর্মী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরের কারণে। যাই হোক, ১৯০১ সাল থেকে শুরু করে ২০২৪ সাল পর্যন্ত যারা নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তাদের সবার ছবি, তথ্য রাখা আছে এই মিউজিয়ামে। বাঙালির আরো দুই কৃতি সন্তান, অধ্যাপক অমর্ত্য সেন ও অধ্যাপক অভিজিৎ ব্যানার্জির ছবি ও তথ্য চোখে পড়লো। অধ্যাপক অমর্ত্য সেন অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পান ১৯৯৮ সালে। অধ্যাপক অভিজিৎ ব্যানার্জি পান ২০১৯ সালে, আরো দুজনের সাথে ভাগাভাগি করে। সে দুজন হলেন, এস্থার দুফলো ও মিশেল ক্রেমার। দারিদ্য বিমোচনে তাদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকার জন্যে তারা সম্মিলিতভাবে এই পুরস্কার লাভ করেন। চার বাঙালির এই অর্জন – এ কী চাট্টিখানা কথা। খুব গর্ব হচ্ছিল। যে ছয়টি বিষয়ে ফি–বছর নোবেল পুরস্কার দেয়া হয় তা হলো: পদার্থবিদ্যা বা ফিজিক্স, রসায়ন (কেমেস্ট্রি), শরীরবিদ্যা বা চিকিৎসা (ফিজিওলজি বা মেডিসিন), সাহিত্য এবং শান্তি। এই পাঁচটি বিষয়ে ১৯০১ সাল থেকে নোবেল পুরস্কার দেয়া শুরু হয়। এরপর ১৯৬৮ সালে যোগ করা হয় অর্থনৈতিক বিজ্ঞান বা ইকোনোমিক সায়েন্স। আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যুর পাঁচ বছরের মাথায় এই পুরস্কার দেয়া শুরু হয়।
৪ ॥ এই লেখা শেষ করবো সংক্ষেপে একটি মজার ঘটনার উল্লেখ করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি সম্পর্কিত এই ঘটনা। মধ্য–নভেম্বরের এক শীতের দিনে কবি দল বেঁধে যাচ্ছিলেন বীরভূমের দিকে, এক দল বিদেশি অতিথিসহ। অতিথিদের বীরভূমে শাল ও পিয়াল গাছ দেখাতে। এমন সময় এক ডাকহরকরা (পিয়ন) দৌড়ে এসে তার হাতে একটি টেলিগ্রাম ধরিয়ে দিয়ে বলে, ‘আপনার জন্যে কর্তা’। কবি সেটি না খুলে তার পরনের জোব্বার পকেটে রেখে দিলেন। দলের কৌতূহলী সঙ্গীরা তাকে তাগিদ দেন টেলিগ্রাম খুলে দেখার জন্যে। সেটি পাঠানো হয়েছিল জোড়াসাঁকোর ঠিকানায়। তা ‘রি–ডাইরেক্ট’ করে শান্তিনিকেতনের ঠিকানায় পাঠিয়েছেন কবির কন্যার জামাই, নগেন্দ্রনাথ। পকেট থেকে টেলিগ্রামটি খুলে পড়তেই তিনি অবাক। একবার নয়, তিনবার পড়লেন। টেলিগ্রাম পাঠিয়েছে সুইডেন থেকে। তাতে ইংরেজিতে লেখা কয়েকটি শব্দ। তা হলো, ‘সুইডিশ একাডেমি আপনাকে সাহিত্যের জন্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করেছে।’ মুহূর্তেই গোটা বাংলায় খবরটি ছড়িয়ে পড়ে। শান্তিনিকেতনে শুরু হয় উৎসব। তারপর তো ইতিহাস।
(৫–১২–২০২৪)
লেখক
সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট।