ক‘দিনের ব্যবধানে রাজধানী ঢাকায় হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরে দুটি লাউঞ্জ-‘প্রবাসী লাউঞ্জ’ ও ‘ওয়েটিং লাউঞ্জ’– উদ্বোধন করা হলো। যদ্দুর জানি বাংলাদেশে প্রবাসী, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যগামী ও সেখান থেকে দেশে ছুটিতে বা ফিরে আসা কর্মীদের জন্যে এই প্রথম এই ধরনের কোন সেবা চালুর করা হলো। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে যে প্রবাসী শ্রমিকরা গায়ের ঘাম ঝরায়, দেশে ফিরে কিংবা বিদেশে যাবার পথে বিমানবন্দরে তারা শিকার হোন সীমাহীন দুর্ভোগের। কর্মসূত্রে বিদেশ যাওয়া–আসার সময় বিমানবন্দরের এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা আর কর্মচারীদের দুর্ব্যবহার, হয়রানি আর হেনস্তার শিকার হন তারা। এ নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে পত্র–পত্রিকায় ও সামাজিক মাধ্যমগুলোতে। প্রবাসী শ্রমিকদের ‘প্রাক ও মাইগ্রেশনোত্তর’ সময়ে হয়রানি, পাসপোর্ট বানানো থেকে শুরু করে দালাল ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ব সহ বহুবিধ হয়রানি বন্ধ করার জন্যে সরকারের কাছে দেশের অভিবাসী বা মাইগ্রেন্ট সংগঠনগুলি একজোট হয়ে সরকারের কাছে ধর্ণা দিয়েছে অনেকবার। বিগত দিনে সরকার প্রবাসী শ্রমিকদের ‘দেশের সূর্য সন্তান’ বলে আখ্যায়িত করে নিজেরা আত্মসন্তুষ্টি লাভে সচেষ্ট থেকেছে। কিন্তু প্রবাসী শ্রমিকদের অবস্থার দৃশ্যমান তেমন কোন উন্নতি ঘটেনি। সুখের বিষয় অন্তর্বর্তী সরকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু অবহেলায় পড়ে থাকা এই দিকটায় শুরু থেকেই বিশেষ নজর দিয়েছে। ক্ষমতায় বসে আইন ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এই বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, প্রবাসী কর্মীদের কল্যাণের জন্যে সরকার খুব শীঘ্র পদক্ষেপ নেবে।
আইন উপদেষ্টার দেয়া ঘোষণার কিছু দিনের মধ্যে আমরা দেখতে পাই হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরে প্রবাসীদের সুবিধার জন্য দুটি বিশেষ লাউঞ্জের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাংলাদেশে এই প্রথম প্রবাসীদের জন্যে এই ধরনের লাউঞ্জ খোলা হলো, যেখানে তারা সাময়িক বিশ্রাম ছাড়াও সুলভে খাবার পাবেন বলে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়। প্রবাসীরা বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া ও অন্যান্য দেশে কর্মরত বাংলাদেশী শ্রমিকরা বিদেশে যাবার সময় কিংবা ফিরে এসে বিমানবন্দরে যে কী ধরনের আচরণের সম্মুখীন হন তা আমাদের কারো অজানা নয়। যদিও বা স্বীকার করতে হয় বিমানবন্দরে বিগত কয়েক বছরে ইমিগ্রেশন বিভাগে যাত্রীদের সেবাপ্রদানের মান কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কিন্তু তারপরও দেখা যায় সেখানে এক শ্রেণীর কর্মচারী ও কর্মকর্তা প্রবাসী শ্রমিকদের সাথে কেবল রূঢ় ও অসৌজন্যমূলক আচরণই করেন না, তাদের অনেক সময় অহেতুক হেনস্তা ও হয়রানি করেন। ইমিগ্রেশন পার হয়ে পুনরায় তাদের মালামাল স্ক্যান করা সহ বিদেশ থেকে সাথে নিয়ে আনা মালামাল নিয়ে নানা প্রশ্ন ও হেনস্তার মুখে প্রবাসী কর্মীদের পড়তে হয়। তখন এই সমস্ত প্রবাসী কর্মীদের চেহারা দেখলে কষ্ট হয়, খারাপ লাগে। কোন–দেশ থেকে প্রবাসী যাত্রী আসছেন, তার বেশভূষা, কথাবার্তা, চালচলন এই সবের ওপর নির্ভর করে তাদের সাথে ব্যবহার করা হয়। যাত্রী হিসাবে প্রবাসী কর্মীরা বিশেষ করে শ্রমিক পর্যায়ে যারা তারা সামান্যতম সম্মান বা মর্যাদা পান না। বিমানবন্দরে তাদের প্রতি তাচ্ছিল্য, অবহেলা নতুন কোন ব্যাপার নয়। অথচ এমনটি হবার কথা নয়। আমরা ভুলে যাই এরাই সেই ‘সোনার হরিণ’ রেমিটেন্স পাঠিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে চালু রেখেছেন। আমার মত তথাকথিত ‘হোয়াইট কলার’ প্রবাসী কর্মীরা নয়। কেননা একজন শ্রমিক প্রবাসে যেটুকু অর্থ উপার্জন করেন, তার সামান্যটুকু নিজের জন্যে রেখে আয়ের সিংহভাগ তিনি পাঠান দেশে ফেলে আসা পরিবারের জন্যে। তাতে পরিবার ও দেশ উপকৃত হয়। অন্যদিকে ‘হোয়াইট–কলার’ প্রবাসীরা তাদের আয়ের সিংহভাগ ব্যয় করেন প্রবাসে নিজের আয়েশ–আরামের জন্যে, নিজ পরিবারের সদস্যদের জন্যে। দেশে তাদের পাঠানো রেমিটেন্সের পরিমাণ খেঁটে–খাওয়া শ্রমিকের চাইতে অনেক কম। অথচ এই অশিক্ষিত, অর্ধ–শিক্ষিত প্রবাসী কর্মীরা প্রায় সময় দেশে নিগৃহীত হন। মাইগ্রেশন–প্রসেসের প্রতিটি পদক্ষেপে এরা হয়রানির শিকার হন। বিদেশ যাবার প্রাক্কালে দালালের খপ্পরে পড়ে সব খুঁইয়েছে এমন ঘটনা রয়েছে ভুরি ভুরি। তার উপর রয়েছে পাসপোর্ট বানানো থেকে শুরু করে প্লেনের টিকেট কাটা পর্যন্তু নানা প্রতিবন্ধকতা। প্রতিটি পদক্ষেপে এদের অনেকেই প্রতারিত হন, কিংবা তাদের বাড়তি অর্থ দিতে হয়। অথচ এই প্রবাসী শ্রমিক গোষ্ঠী আমাদের দেশের অর্থনীতির মেরুদন্ড। এদের পাঠানো ‘রেমিটেন্স’ দেশে না এলে দেশের অর্থনীতির কী ভয়াবহ দশা হতো সে কল্পনা করতেও ভয় লাগে।
সুখের বিষয়, অন্তর্বর্তী সরকার শুরুতেই অভিবাসী ইস্যুতে বিশেষ নজর দিয়েছে এবং প্রবাসী শ্রমিকরা যাতে ভবিষ্যতে হয়রানির সম্মুখীন না হন সেদিকে বিশেষ ব্যবস্থা নেবেন বলে সরকার পক্ষ থেকে আশ্বাস দেয়া হয়। তারই ধারাবাহিকতায় অন্তর্বর্তী সরকার প্রথমে উদ্বোধন করলো ‘প্রবাসী লাউঞ্জ‘। দেশের প্রতি প্রবাসীদের অবদানের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে লাউঞ্জ উদ্বোধনকালে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস বলেন, ‘আপনাদের যে প্রাপ্য সম্মান সেটি যেন জাতি দিতে পারে।’ প্রবাসী কর্মীদের দেশ–গড়ার কারিগর আখ্যায়িত করে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুস বলেন, আমরা তাদের কাছে সব সময় কৃতজ্ঞ। আমরা বিশ্বাস করি এই লাউঞ্জ তাদের ভ্রমণকে সহজ করবে। ‘প্রবাসী লাউঞ্জ’ উদ্বোধনের ক’দিনের মাথায় আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অনুষ্ঠিত কপ–২৯ সম্মেলনে যোগদান শেষে দেশে ফিরে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস বিমানবন্দরে প্রবাসী যাত্রী ও তাদের স্বজনদের জন্যে আর একটি লাউঞ্জ (ওয়েটিং লাউঞ্জ) উদ্বোধন করেন। এটি উদ্বোধন করে তিনি বলেন, ‘আজারবাইজানে যাবার পথে প্রবাসীদের জন্যে বিমানবন্দরে একটি লাউঞ্জ উদ্বোধন করেছিলাম। আর এই লাউঞ্জটা প্রবাসীদের জন ‘ডেডিকেইটেড’, যাতে তাদের পথে পথে ঘুরতে না হয়। বিদেশ যাওয়া ও আসার সময় তারা এটি আরামে ব্যবহার করতে পারবেন।’ বিমানবন্দরের মাল্টিলেভেল কার পার্কিং এলাকার দ্বিতীয় তলায় এই প্রশস্ত ও আরামদায়ক ওয়েটিং লাউঞ্জের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে সংবাদে প্রকাশ। নতুন লাউঞ্জটিতে নির্ধারিত ওয়েটিং রুম, বেবি কেয়ার কক্ষ, নারী–পুরুষদের জন্য নামাজের স্থান এবং সুলভ মূল্যের ক্যাফেটেরিয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই সুযোগ–সুবিধা সকল প্রবাসী নাগরিক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্যে নিবেদিত বলে জানা যায়।
বিমানবন্দরে লাউঞ্জ উদ্বোধনে আমার উৎফুল্ল হওয়া দেখে প্রবাসী এক বন্ধু বলেন, ‘এতে এতো উচ্ছসিত হবার কী আছে? এতো কেবল লাউঞ্জ। বিমানবন্দরে তো যাত্রীদের জন্যে বিভিন্ন ব্যাংকের লাউঞ্জ রয়েছে। প্রবাসী শ্রমিকদের আরো বড় সমস্যা রয়েছে। সেগুলি সমাধানের দিকে সরকারের নজর দেয়া জরুরি।’ উত্তরে বলি, ‘বিমানবন্দরে যে সমস্ত লাউঞ্জ আছে তাতে শ্রমিক শ্রেণীর প্রবেশাধিকার কতটুকু আছে আমার জানা নেই। বিমানবন্দরের দোতালার চমৎকার একটি লাউঞ্জে একবারই কয়েক ঘন্টা ছিলাম। কিন্তু তার যে জৌলুস সেখানে সাধারণ প্রবাসী কর্মী ঢুকতেও সাহস পাবেন বলে মনে হয়না আমার।’ যে বিষয়টিকে আমি ইতিবাচকভাবে দেখি তা হলো, এই সেবা প্রবর্তনের মধ্যে দিয়ে প্রবাসী কর্মীদেরও যে বিমানবন্দরে এই জাতীয় সুবিধা পাওয়া অধিকার রয়েছে সেই বিষয়টিকে সরকার গুরুত্ব দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তাদের সম্মান জানানো হয়েছে। সুবিধাভোগী শ্রেণী বরাবর নিজের সুবিধার কথাটাই চিন্তা করেন এবং সে–চিন্তা মাথায় রেখে ব্যবস্থা নেন। কিন্তু অবহেলিত অথচ দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি প্রবাসী শ্রমিকদের সামান্যতম সুযোগ–সুবিধার কথা ওনারা ভাবেন না। সে কারণেই বিমানবন্দরে লাউঞ্জ খোলার সংবাদটি দেখে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিলাম। এই লাউঞ্জ দুটি উদ্বোধনের মধ্যে দিয়ে প্রবাসী শ্রমিকরা যে দেশের অর্থনীতিতে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সে বিষয়টি আমাদের এবং সাথে সাথে বিমানবন্দর, কাস্টমসের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মনে করিয়ে দেয়া হলো। অভিবাসী কর্মীদের অধিকার, সুরক্ষা ইত্যাদি ইস্যু নিয়ে ২০০৫ সাল থেকে কাজ করে আসছি। বিগত এই দীর্ঘ সময়ে হল্যান্ডের ডায়াসপোরা সংগঠন, বাসুগের সদস্য হিসাবে মাইগ্রেন্টসদের অধিকার নিয়ে জাতিসংঘ সহ দেশে–বিদেশে বিভিন্ন ফোরামে সক্রিয় থেকেছি। মাইগ্রেন্টসদের অধিকার আন্দোলনে বিভিন্ন সংগঠনের প্লাটফরম, ‘বাংলাদেশ সিভিল সোসাইটি ফর মাইগ্রেন্টস’ (বিসিএসএম) দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে। ‘বাসুগ’ এই প্লাটফর্মের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। কিছুদিন আগে এই প্লাটফর্মের সাথে আইন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের বৈঠক হয়েছিল। এতে প্রতীয়মান হয় যে অন্তর্বর্তী সরকার অভিবাসীদের সমস্যা ও সমস্যা–সমাধানের বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে দেখছেন। এর আগেও সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ের সাথে আলাপ–আলোচনা হয়েছিল। ওইসব আলোচনায় অভিবাসী কর্মীদের অধিকার, সুযোগ–সুবিধা, বিমান বন্দরের হয়রানি বন্ধ সহ নানা সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়। আশ্বাস আসে সমস্যা সমাধানের। কিন্তু বাস্তবায়ন খুব একটা হয়েছে তেমনটি দাবি করা যাবে না।
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল আর একটি সুখকর সংবাদ শোনালেন। তা হলো, প্রবাস থেকে ফিরে আসার পর বিমানবন্দরে মাইগ্রেন্টস কর্মীদের যে হয়রানি করা হয় তা বন্ধ করার লক্ষ্যে সরকার দুই থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে ভিআইপি সার্ভিসের ব্যবস্থা করবেন। তার মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময় উপদেষ্টা বলেন, প্রথম ধাপে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফিরে আসা মাইগ্রেন্টসরা এই সেবা পাবেন, পরবর্তীতে অন্যান্য প্রবাসীরা এই সেবার আওতায় আসবেন। ড. আসিফ নজরুল আরো বলেন, মাইগ্রেন্টসরা যাতে ভিআইপি লাউঞ্জে প্রবেশাধিকার পায় সে বিবেচনা করছি। অতীতে কেবল দুর্নীতিপরায়ণ এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এই সমস্ত সেবা পেতেন। মাইগ্রেশন ও দেশে রেমিটেন্স পাঠানোর প্রসেস সহজতর করার লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মীদের জন্য সরকার গন্তব্য সমপ্রসারণের চেষ্টা করছে। এই বিষয়টি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কেননা অনেক উন্নত দেশ, বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বে অনুন্নত দেশ থেকে যাওয়া অভিবাসীদের জন্যে তাদের দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে। আগামী দুই মাসের মধ্যে দেশের অভিবাসন প্রত্যাশীদের জন্য আরও গন্তব্য উন্মুক্ত হবে বলে তিনি যে আশা ব্যক্ত করেন তা বাংলাদেশ এবং অভিবাসীদের জন্যে সুখকর সংবাদ তাতে কোন সন্দেহ নেই। আশা করি এই সমস্ত আশ্বাসবাণী কেবল আশ্বাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, লাউঞ্জের মত বাস্তবের মুখ দেখবে অচিরে, সেই প্রত্যাশায়।
(২০–১১–২০২৪)
লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট