আজ থেকে মাত্র নয় দিন পর অর্থাৎ ৫ নভেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট–নির্বাচন। ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে শুরু হয়েছে ‘আর্লি ভোটিং‘ বা ‘আগাম ভোট‘। গেল সপ্তাহে শুরু হওয়া এই আগাম ভোটের প্রথম দিনে মূল ‘ব্যাটেল গ্রাউন্ড‘ হিসাবে পরিচিত জর্জিয়ায় তিন লক্ষ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। ভোট চলছে অন্যান্য রাজ্যেও। ভোট কেন্দ্রে গিয়ে কেবল আগাম ভোট দেয়া নয়, ডাক–যোগে ভোট দেয়া শুরু হয়েছে তারও আগে। আগাম ভোট–প্রদান মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বিগত ২০২০ সালের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই সে–বছর ভার্জিনিয়ার ৪৫ লক্ষ ভোটারের মধ্যে শতকরা ৬৩% ভাগ অর্থাৎ ২৮ লক্ষ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছিলেন। নির্বাচনে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী– ডেমোক্র্যাট দলের কমলা হ্যারিস ও রিপাবলিকান দলের ডোনাল্ড ট্রাম্প – প্রচারণার শেষ মুহূর্তে বিভিন্ন রাজ্যে বিশেষ করে ‘সুইং‘ স্টেটগুলিতে চষে বেড়াচ্ছেন ভোটারদের উজ্জীবিত করতে। তারা ভোটারদের কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেবার জন্যে আহবান জানাচ্ছেন। এই ভোটকে ঘিরে গোটা দেশ জুড়ে বিশাল আয়োজন। আমেরিকার সব কিছুর ‘সাইজ‘ বিশাল, সে ম্যাকডোনাল্ডের হ্যামবার্গার থেকে শুরু করে কোকাকোলা পর্যন্ত। এই ‘বিশাল‘ সাইজের সাথে আমার পরিচয় আজ থেকে ১৮ বছর আগে যেবার প্রথম নিউ ইয়র্ক গেলাম জাতিসংঘ ভবনে অনুষ্ঠিত ‘মাইগ্রেশন‘ শীর্ষক এক সম্মেলনে যোগ দিতে। চেক–ইন করে সন্ধ্যের দিকে হোটেল থেকে বের হয়ে কাছাকাছি উদ্দেশ্যহীন হাঁটছিলাম। কিছুদূর এগোতেই চোখে পড়ে রাস্তার ধারে ম্যাকডোনাল্ডস। ভেতরে ঢুকে দেখি প্রায় সবার হাতে বিশাল সাইজের বার্গার ও ড্রিংকস। কাউন্টারের পেছনে দেয়ালে মাথার উপর ছবি সহ খাবার (জাং ফুড) তালিকা। কিছুটা দ্বিধার সাথে কাউন্টারে বসা কালো মেয়েটিকে বললাম, ‘তুমি কি আমাকে সব চাইতে ‘স্মল‘ সাইজের একটা হ্যামবার্গার ও কোকাকোলা দিতে পারো?’ খানিকবাদে তরুণীটি যা দিলো তা দেখে আমার ভিমড়ি খাবার দশা। মনে মনে ভাবলাম এই যদি হয় ‘স্মল সাইজ‘, তাহলে ‘বিগ–সাইজ‘ না জানি কত ‘বিগ‘ হবে। পুরোটা খেতে পারলাম না। অর্ধেক ফেলে দিতে হলো ওয়েস্টবিনে। বিশাল সাইজের বার্গারের কথা মনে এলো নির্বাচনকে ঘিরে দেশব্যাপী বিশাল–আয়োজন দেখে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে ঘিরে যা যা ঘটে, তার সবকিছুই বিশাল, বিশাল আয়োজন; টিভি বিতর্ক থেকে শুরু করে দলের কনভেনশন বা নির্বাচনী প্রচারাভিযান সব। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে ঘিরে যে হই–হুল্লোড়, জল্পনা–কল্পনা, মিডিয়া–শো, টাকার–খেলা, কাঁদা ছোঁড়াছুড়ি বিশ্বের আর কোন দেশে কোন নির্বাচনকে ঘিরে এমনটি হয় বলে আমার জানা নেই। হল্যান্ডে তো নয়ই। হল্যান্ডে যেদিন জাতীয় নির্বাচন হয়, সেদিন বাইরে থেকে বুঝার কোন উপায় নেই যে নির্বাচন হচ্ছে। শহরের বিভিন্ন স্থান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রেলস্টেশনে খোলা হয় পোলিং সেন্টার। আপনি আপনার আইডি কার্ড বা পাসপোর্ট নিয়ে দেশের যে কোন কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারবেন। জাতীয় নির্বাচনের কারণে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা সামান্যতম ব্যাহত হয় না। কোন কেন্দ্রে কোন প্রার্থীর বা দলের কোন পোস্টার নেই, নেই দলের পক্ষে কোন কর্মী বা কোন প্রচারণা।
২. যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনী প্রচারণা এখন তুঙ্গে। গেল জুলাই মাস নির্বাচনী–লড়াই থেকে বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সরে দাঁড়াবার আগ পর্যন্ত রিপাব্লিকান দলীয় প্রার্থী ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম যে জয়ী হবেন সেটি অনেকটা ধরে নেয়া হয়েছিল। বাইডেনের সরে দাঁড়ানোর পর ভারতীয় বংশদ্ভুত কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস লড়াই মঞ্চে আবির্ভুত হলে গোটা নির্বাচনী–আবহ রাতারাতি বদলে যায়। ডেমোক্র্যাক্ট দলীয় ক্যাম্পে নুতন প্রাণের সঞ্চার হয়। জো বাইডেন নির্বাচন করলে যে সমস্ত রাঘব বোয়াল মার্কা ডোনার ডেমোক্র্যাক্ট দলকে চাঁদা দেবেন না বলে হুমকি দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন তারা ফিরে আসেন, উদার হস্তে নির্বাচন পরিচালনার জন্যে রেকর্ড পরিমাণ চাঁদা দেন। বর্তমানে দুই প্রার্থী মরীয়া হয়ে লড়ছেন, দুজনেই গোটা দেশ চষে বেড়াচ্ছেন বিশেষ করে ‘সুইং‘ স্টেটে যেখানে ভোটাররা এখনো দোদুল্যমান দু‘জনের কাকে তারা ভোট দেবেন এই নিয়ে। এবারের নির্বাচনে দুজনের মধ্যে যে হাড্ডাহাড্ডি–লড়াই হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে বলেন, এবারের নির্বাচনে ‘জেন্ডার‘ একটি বড় ফ্যাক্টর। মহিলা হওয়া সত্বেও সেটি কারো কারো মতে কমলা হ্যারিসের জয়ী হবার পথে অন্তরায় হিসাবে দেখা দিতে পারে। সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েট প্রেস এবং এন ও আর সি সেন্টার ফর পাবলিক অ্যাফেয়ার্স রিসার্চ পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, আমেরিকানরা মনে করেন যে, কেবল মহিলা হবার কারণে কমলা হ্যারিসের জয়ী হবার সম্ভাবনা ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। তারা এও মনে করেন যে মহিলাদের সম্পর্কে ডোনাল্ড ট্রাম্প বিভিন্ন সময় অসম্মানজনক মন্তব্য করা সত্বেও তার (ট্রাম্প) কেবল পুরুষ হবার কারণে নির্বাচনে জয়লাভ করা কিছুটা সহজ হবে।
৩. বিশ্ব মোড়ল বিধায় ভূ–রাজনীতিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফলের অনেক গুরুত্ব রয়েছে। রাশিয়া, আরব দেশ সমূহ, চীন সহ গোটা ইউরোপ আগ্রহ নিয়ে পর্যবেক্ষণ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। আর আসন্ন নির্বাচন এমন সময় হতে যাচ্ছে যখন একদিকে ইউরোপ (ইউক্রেন) ও অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্য জ্বলছে। এর বাইরে রয়েছে চীন ও উত্তর কোরিয়ার প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টা এবং হল্যান্ড সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে উগ্র ডান দলগুলির ক্ষমতায় উত্থান ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার। রয়েছে আমেরিকা সহ ইউরোপে ক্রমবর্ধমান ইমিগ্রেশন সমস্যা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, যদি ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হয় তাহলে ন্যাটোর ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কেমন হয় তা দেখার বিষয়। পাশাপাশি বিশ্ব জলবায়ু ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র কী পদক্ষেপ নেয় সেটিও দেখার ব্যাপার। এই দুই ইস্যুতে ট্রাম্পের রয়েছে নেতিবাচক মনোভাব। তবে কমলা হ্যারিস নির্বাচিত হলে তিনি যে এই ক্ষেত্রে তার পূর্বসূরি জো বাইডেনের অনুসৃত নীতি অনুসরণ করবেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। মার্কিন নির্বাচনে এবার যে সমস্ত ইস্যু বড় ভূমিকা পালন করছে বলে মনে করা হচ্ছে তা হলো, ইমিগ্রেশন, অর্থনীতি ও মুদ্রাস্ফীতি, ভায়োলেন্ট ক্রাইম, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও গর্ভপাত। এক জরিপে দেখা যায়, ১০ ভোটারের মধ্যে ৮ জন (৮১%) মনে করেন তাদের কাছে দেশের অর্থনীতি ভোট দানের ক্ষেত্রে সব চাইতে বড় ভূমিকা পালন করবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ট্রাম্প ও কমলা সমর্থকদের মধ্যে কোন ইস্যু গুরুত্বপূর্ণ এই নিয়ে বেশ পার্থক্য রয়েছে। ট্রাম্পের সমর্থকদের কাছে ইমিগ্রেশন (৯৩%) ও ভায়োলেন্ট ক্রাইম (৭৬%), সব চাইতে কম গুরুত্বপূর্ণ জলবায়ু (১১%)। অন্যদিকে, কমলা সমর্থকদের মধ্যে স্বাস্থ্য (৭৬%), সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগ (৭৩%), অর্থনীতি (৬৮%) এবং গর্ভপাত (৬৭%) গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু বলে ধারণা করা হচ্ছে।
৪. এখন দেখা যাক নির্বাচনের আর মাত্র ৯ দিন আগে কোন প্রার্থীর জেতার কেমন সম্ভাবনা। নির্বাচনী লড়াইয়ে কে এগিয়ে আছেন– কমলা হ্যারিস না ডোনাল্ড ট্রাম্প? অনেকের মনে যে প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসছে তা হলো–মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি প্রথমবারের মত নারী প্রেসিডেন্ট দেখতে চলেছে? নাকি দ্বিতীয়বারের মত ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউস নিজ দখলে নিতে চলেছেন? এখনো পর্যন্ত যে সমস্ত তথ্য ও জরিপের ফলাফল বেরিয়ে আসছে তাতে দেখা যায়, কমলা হ্যারিস গত জুলাই মাসে নির্বাচনী লড়াইয়ে নামার পর থেকে জাতীয় পর্যায়ে ট্রাম্পের চাইতে কিছুটা এগিয়ে আছেন। নির্বাচনী প্রচারণার প্রথম কয়েক সপ্তাহে আগস্ট মাসের শেষ পর্যন্ত তিনি ৪% এগিয়ে ছিলেন। এই অগ্রযাত্রা সেপ্টেম্বর থেকে, বিশেষ করে ১০ সেপ্টেম্বর দুই প্রার্থীর মধ্যে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট–বিতর্কের পর ‘স্থির‘ রয়েছে। উল্লেখ্য, ওই বিতর্কে জনমত জরিপে এগিয়ে ছিলেন কমলা হ্যারিস এবং প্রায় সাত কোটি দর্শক ওই বিতর্ক–অনুষ্ঠান দেখেছিলেন। যে বিষয়টি আগেও উল্লেখ করেছি এবং এখন আবার উল্লেখ করছি তা হলো, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ‘ইলেক্টোরাল কলেজের‘ ভূমিকা সব চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দেশব্যাপী সাধারণ জনগণের ভোট বেশি পেলেই যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন তা ভাবার কোন কারণ নেই। মোট ৫৩৮ ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের মধ্যে যে প্রার্থী ২৭০টি ভোট পাবেন, তিনিই হবেন বিজয়ী। হোয়াইট হাউস যাবে তার দখলে আগামী চার বছরের জন্যে। যদি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোটের ফলাফল ২৬৯–২৬৯ ‘টাই‘ হয়, তাহলে হাউস অব রিপ্রেসেন্টেটিভসসে রাজ্য–প্রতিনিধিরা ভোট দিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন চূড়ান্ত করবেন। দিন যত এগিয়ে আসছে ততই দুজনের – কমলা ও ট্রাম্প – ভোটের ব্যবধান কমে আসছে। এই মুহূর্তে শতভাগ নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছেনা কে হতে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের আগামী দিনের প্রেসিডেন্ট। কমলা না ট্রাম্প? আর সেটি দেখার জন্যে আমাদের আরো কটা দিন অপেক্ষা করতে হবে। (২৩–১০–২০২৪)।
লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট