আগামী ৫ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। নানা কারণে এবারের নির্বাচনকে ঘিরে জল্পনা–কল্পনা, গুঞ্জন, উত্তেজনার শেষ নেই। কথা ছিল আসন্ন এই নির্বাচনে ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে লড়বেন ‘সিটিং’ প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। কিন্ত ২৭ জুন ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে মুখোমুখি টেলিভিশন–বিতর্কে মারাত্মকভাবে খারাপ পারফরম্যান্স করার পর তিনি নিজ দলের ভেতর ও বাইরে প্রচণ্ড সমালোচনার সম্মুখীন হন এবং তাকে শেষ মুহূর্তে এই নির্বাচনী লড়াই থেকে সরে আসতে হয়। যদিও বা তিনি বারবার দাবি করছিলেন তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে সম্পূর্ণ ফিট। কিন্তু ডেমোক্র্যাক্ট দলীয় সমর্থক, নেতা ও পৃষ্ঠপোষকরা তাকে বারবার তাগিদ দিচ্ছিলেন নির্বাচনী লড়াই থেকে সরে এসে আর কাউকে সুযোগ করে দেবার জন্যে। ডেমোক্র্যাক্ট পার্টির রাঘববোয়াল গোছের দাতারা এক পর্যায়ে এই বলে হুমকি দেন যে, বাইডেন নির্বাচনে দাঁড়ালে তারা দলকে কোন আর্থিক সমর্থন দেবেন না। বলা বাহুল্য, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হলো ‘টাকার খেল’। কোন প্রার্থী কত চাঁদা সংগ্রহ করতে পারলেন, নির্বাচনে সেটিও একটি উল্লেখযোগ্য বিবেচ্য বিষয়। যাই হোক, অবশেষে জো বাইডেনের সুমতি হয়। তিনি নির্বাচনী লড়াই থেকে সরে দাঁড়ান এবং ডেমোক্র্যাক্ট দলের নতুন প্রার্থী হিসাবে আবির্ভুত হন তারই ভাইস প্রেসিডেন্ট ভারতীয় বংশোদ্ভুত মার্কিন নাগরিক কমলা হ্যারিস। জো বাইডেন সরে দাঁড়াবার আগ পর্যন্ত অনেকটা ধরে নেয়া হয়েছিল যে আসন্ন নির্বাচনে রিপাবলিকান দলীয় প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হবেন। বিভিন্ন জরিপে সেই ধরনের আভাস পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু কমলা হ্যারিস নির্বাচনী–মঞ্চে আবির্ভুত হবার পর সে চিত্র অনেকটা বদলে যায়। বিশেষ করে সপ্তাহ আড়াই আগে ডেমোক্র্যাক্ট পার্টির ন্যাশনাল কনভেনশনের (ডিএনসি) পর ডেমোক্র্যাক্ট পার্টির নৌকায় নতুন জোয়ার আসে। এই কনভেনশনে ডেমোক্র্যাক্ট দলীয় ভূতপূর্ব কয়েক প্রেসিডেন্ট ও নেতৃস্থানীয় রাজনীতিবিদের উপস্থিতি ও বক্তব্য দলীয় সমর্থকদের মধ্যে, এমন কী যে সমস্ত ভোটার কোন প্রার্থীকে ভোট দেবেন এই নিয়ে এখনো দোদুল্যমান অবস্থায় রয়েছেন, তাদের মাঝেও নতুন উম্মাদনা, অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করে। ডেমোক্র্যাক্ট দলীয় কনভেনশনে বক্তব্য রেখেছিলেন ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, তার স্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, স্ত্রী মিশেল ওবামা এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের থেকে সমর্থন গুটিয়ে নেয়া রিপাবলিকান দলের কয়েক প্রাক্তন গভর্নর ও নেতা, এমন কী ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় হোয়াইট হাউসে কর্মরত কয়েক কর্মকর্তাও। চারদিন ধরে চলা ডেমোক্র্যাক্ট দলের এই কনভেনশন বলা চলে গোটা নির্বাচনী হাওয়া বদলে দিয়েছে। কনভেনশনের কয়েকদিন আগেও যখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় অনেকটা নিশ্চিত ধরে নেয়া হয়েছিল, ডেমোক্র্যাক্ট দলের এই অতি সফল–কনভেনশনের পর তা অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। কনভেনশন–পরবর্তী সময়ে পরিচালিত এক নির্বাচনী জরিপে দেখা যায়, ডেমোক্র্যাক্ট দলীয় নতুন প্রার্থী কমলা হ্যারিস ট্রাম্পের চাইতে এগিয়ে রয়েছেন। ডেমোক্রেটসরা আশা করতে শুরু করেন যে তারা এখন অপেক্ষাকৃত তরুণ, নতুন ও যোগ্য প্রার্থী পেয়েছেন যিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে লড়াই করতে পারবেন এবং তাদের জন্যে জয় ছিনিয়ে আনতে সক্ষম।
২. প্রশ্ন– ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস কি পারবেন ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পরাজিত করতে? কমলার ভোটের পরিমাণ বেড়েছে একথা ঠিক, কিন্তু সেটি কি এই নির্বাচনে জয়ী হবার জন্যে যথেষ্ট? এই প্রসঙ্গে মার্কিন অনুসন্ধানী সাংবাদিক এন্ড্রু প্রকোপ যিনি হোয়াইট হাউস কভার করেন এক প্রতিবেদনে লেখেন, দু’সপ্তাহের কিছু আগে কমলা হ্যারিস নির্বাচিনী–দৌড়ে অংশ নেবার পর থেকে ডেমোক্র্যাক্ট দলে নতুন উম্মাদনা দেখা দেয়, হ্যারিসের ভোটের পরিমাণও বাড়তে থাকে। কিন্তু আপনারা যা ভাবছেন সে পরিমাণে বাড়েনি। অন্তত এখন পর্যন্ত না। এটি ঠিক এই মুহূর্তে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ের জন্যে পুরোপুরি ‘ফেবারিট’ না, কিন্তু কমলাও যে একেবারে পরিষ্কার এগিয়ে আছে তা নয়। বিশেষ করে ‘সুইং স্টেটে’ (দোদুল্যমান রাজ্যে) দেখা যাচ্ছে দুজনের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। ফলে ফলাফল দু’দিকেই যেতে পারে।’ তবে এটি নিশ্চিত করে বলা যায়, জো বাইডেনের অবস্থানের চাইতে বর্তমানে ডেমোক্র্যাক্ট দলের অনেক এগিয়ে আসা হয়েছে। গত বছরের শেষের দিকে দেখা গিয়েছিল ডোনাল্ড ট্রাম্প বাইডেনের চাইতে অনেক এগিয়ে আছেন, বিশেষ করে জাতীয় পর্যায়ে এবং সুইং স্টেটে। সেই অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দেয়া বা কমিয়ে দেয়া হবে ডেমোক্র্যাক্টসদের জন্যে বড় চ্যালেঞ্জ। ট্রাম্প টিম ধরে নিয়েছিল যে তারা বাইডেনকে হারাবেন তা অনেকটা নিশ্চিত। কিন্তু বর্তমানে পট পরিবর্তনের পর তারা তেমনটি নিশ্চিত নন, বলা চলে কিছুটা চিন্তিত। একই সাথে যা একটু আগে উল্লেখ করেছি, কমলা হ্যারিসের বিজয়ও নিশ্চিত নয়। কেননা মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সংখ্যার দিক থেকে বেশি ভোট পেলেই যে নির্বাচিত হবেন তা নয়। এই ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে ‘ইলেকটোরাল কলেজ’। সুইং স্টেটগুলির কয়টিতে আসন কোন প্রার্থীর পক্ষে গেল সেটি মূলত বড় ভূমিকা রাখে। সে ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত এই সমস্ত সুইং স্টেটে কমলার নিশ্চিত–বিজয় হবে সেটি বলা যাচ্ছে না। বিখ্যাত ব্লুমবার্গ/মর্নিং কনসাল্ট পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, মিশিগানে কমলা বড় ব্যবধানে এগিয়ে থাকবেন, কম ব্যবধানে এগিয়ে থাকবেন ছোট ছোট রাজ্যে যেমন ইউসকন্সিন, আরিজোনা এবং নেভেডায়। কিন্তু একই জরিপে এও বলা হয় যে, ট্রাম্প পেনসিলভেনিয়া, নর্থ ক্যারোলিনা রাজ্যে এগিয়ে থাকবেন। জর্জিয়ায় দুজনের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের ইঙ্গিত দেয় এই জরিপ। যদি এই জরিপ সঠিক হয়, তাহলে বলা যায় নির্বাচনে জয়–পরাজয় অনেকটা নির্ভর করবে জর্জিয়ার ফলাফলের উপর। অন্যদিকে, ফক্স ও এমারসন পরিচালিত ভিন্ন এক জরিপে দেখা যায় বেশির ভাগ সুইং স্টেটে ট্রাম্প সামান্য ব্যবধানে এগিয়ে থাকবেন।
৩. ডেমোক্রাট দলের কনভেনশন শেষে কমলা হ্যারিস নতুন উদ্দামে নির্বাচনী প্রচারণায় নেমেছেন। ইতিমধ্যে তিনি নির্বাচনী প্রচারণার জন্যে রেকর্ড–পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছেন। পজিটিভ মিডিয়া কভারেজ পাচ্ছেন। পাচ্ছেন মহিলা ভোটারদের সমর্থন। জুলাই ২৭ থেকে জুলাই ৩০ তারিখ পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, মহিলা ভোটারদের মধ্যে শতকরা ৫০% কমলার পক্ষে, অন্যদিকে ট্রাম্পের পক্ষে ৩৯%। কমলার পক্ষে মহিলাদের এই সমর্থনের পেছনে কয়েকটি বিষয় কাজ করছে বলে ধারণা। তার মধ্যে অন্যতম, তিনি মহিলা, হোয়াইট হাউসে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে, উপরন্ত ‘গর্ভপাত’ ইস্যুতে তিনি এর পক্ষে তার শক্ত অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। ট্রাম্প এর বিপক্ষে। গর্ভপাতে মহিলাদের অধিকার সমপ্রতি ডোনাল্ড ট্রাম্প নিয়োগকৃত সুপ্রিম কোর্ট বিচারক বাতিল করেন। ট্রাম্পকে নিয়ে নানা যৌন কেলেঙ্কারির কাহিনী প্রচলিত রয়েছে, যে কারণে অনেক মহিলা তাকে পছন্দ করেননা। অন্যদিকে ট্রাম্পের চাইতে বয়সে কমলা ১৮ বছরের ছোট। তার বর্তমান বয়স ৫৯, ট্রাম্পের ৭৭। তিনি মহিলা এবং অশেতাঙ্গ। আসন্ন নির্বাচনে আরো যে কয়েকটি বিষয় ভোটারদের প্রভাবিত করবে তা হলো জলবায়ু ও অবৈধ অভিবাসী ইস্যু। ডোনাল্ড ট্রাম্প জলবায়ু–পরিবর্তনকে একটি ‘হোক্স’ বা ভ্রান্ত ধারণা বলে মনে করেন এবং এই ব্যাপারে তার পলিসি হচ্ছে, ‘ড্রিল বেবী ড্রিল’, অর্থাৎ জ্বালানির সন্ধানে আরো খনন কাজ চালিয়ে যাও। তিনি ইতিমধ্যে এই বলে ঘোষণা দিয়েছেন যে যদি নির্বাচিত হন তিনি ‘প্যারিস–জলবায়ু চুক্তি’ থেকে পুনরায় বেরিয়ে আসবেন। ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন তিনি ক্ষমতায় এলে অবৈধপথে আসা মাইগ্রেন্টসদের দেশ থেকে বের করে দেবেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে বিশ্ব রাজনীতি কোনদিকে মোড় নেবে তা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও, গণতন্ত্র ও মুক্ত বিশ্বের জন্যে যে সুখকর কোন বার্তা বয়ে আনবে না রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের তেমন ধারণা। ট্রাম্প আগে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে তিনি ক্ষমতায় এলে ইউক্রেনকে দেয়া সমস্ত সাহায্য বন্ধ করে দেবেন এবং ন্যাটোভুক্ত যে সমস্ত সদস্য রাষ্ট্র এই সংস্থার জন্যে বর্ধিত–চাঁদা দেবেনা সেই সমস্ত দেশকে আক্রমণ করার জন্যে রাশিয়াকে উৎসাহিত করবেন। আমেরিকা ও পশ্চিমের বিরুদ্ধে থাকা রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন ও উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম উনের সাথে ট্রাম্পের স–সুম্পর্ক নিয়ে অনেকের সন্দেহ ও আশংকা রয়েছে।
৪. সবশেষে, সব–সম্ভবের দেশ আমেরিকা। বিশ্বের সবচাইতে ক্ষমতাবান এই দেশটিতে এখনো ‘কালোদের’ অধিকার আদায়ের জন্যে আন্দোলন হয়। এখনো এদেশে কালোরা নির্যাতিত। আবার এই দেশেই দেখা যায় কালো–প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে একবার নয় দু–দুবার প্রেসিডেন্ট হিসাবে নির্বাচিত হতে। অন্যদিকে, ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজয়ের পর ডোনাল্ড ট্রাম্পের উস্কানিতে তার অন্ধ সমর্থকরা ওয়াশিংটনে ক্যাপিটাল হিল আক্রমণ করার ঘটনায় এবং বিভিন্ন ধরনের ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার কারণে কয়েকটি আদালতে দোষী সাব্যস্ত হবার পরও মার্কিন জনগণের বৃহৎ অংশ তাকে দ্বিতীয়বারের মত দেশের ক্ষমতায় দেখতে চান। অবাক করা ব্যাপার নয় কি? কমলা হ্যারিস মহিলা এবং কৃষ্ণাঙ্গ। তিনি যদি নির্বাচিত হন তিনি হবেন এই বিশ্ব মোড়ল দেশটির প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট। বারাক ওবামার পর তিনি গড়বেন নতুন ইতিহাস। তিনি যদি নির্বাচিত হন তাহলেও অবাক হবার কিছু নেই। কেননা সব সম্ভবের দেশ যে আমেরিকা। ‘গড ব্লেস আমেরিকা’।
(৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪)
লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট