এই লেখা যখন ছাপার অক্ষরে বের হবে তখন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে যাবে। মোট ৭২০ আসনের জন্যে নির্বাচন ৬–৯ জুন। পার্লামেন্টের মেয়াদ পাঁচ বছর। শেষ নির্বাচন হয়েছিল ২০১৯ সালে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলিতে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জনসংখ্যা অনুপাতে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে কোন দেশের কতজন সদস্য হবে তা নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। এবারের নির্বাচন হবে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ১০ম নির্বাচন এবং ইউনিয়ন থেকে বৃটেনের বের হয়ে (ব্রেঙিট) যাবার পর প্রথম ইউরোপীয়–পার্লামেন্ট নির্বাচন। ব্রেঙিটের কারণে বৃটেনের ২৭টি খালি হয়ে যাওয়া আসন ইতিমধ্যে অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের মাঝে ভাগাভাগি করে দেয়া হয়। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের আসন সংখ্যা এবার ৭০৫ থেকে ৭২০–এ বৃদ্ধি করা হয়েছে। গেল বছর ১৩ সেপ্টেম্বর ইউরোপীয় কাউন্সিলে এই মর্মে গৃহীত সিদ্ধান্তকে অনুমোদন দেয় ইউরোপীয় পার্লামেন্ট। আসন্ন নির্বাচনে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট কোনদিকে ঝুঁকে পড়বে– বাম না কট্টর ডান– এই নিয়ে নানা আলোচনা, কল্পনা–জল্পনা থাকলেও হল্যান্ড সহ আরো বেশ কটি সদস্য দেশে সমপ্রতি অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল দেখে সহজে অনুমেয় যে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনের ফলাফলে তার একটা বড় প্রভাব পড়বে। নির্বাচনে এই সমস্ত দেশে রেডিক্যাল–ডান রাজনৈতিক দলগুলির জয় হয়। আশংকা করা হচ্ছে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে রেডিক্যাল ডান–আদর্শে বিশ্বাসী দলগুলি ভালো করবে। বিভিন্ন জরিপে সেই ধরনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে সেন্টার–লেফট এবং গ্রিন পার্টিগুলি ভোট এবং আসন হারাবে। তার অর্থ এই ‘ইউরোপ–বিরোধী’ রেডিক্যাল ডান দলগুলি নির্বাচনে এগিয়ে থাকবে। সমপ্রতি পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের নয়টি সদস্য–রাষ্ট্রে ইউরোপ–বিরোধীরা এগিয়ে থাকবেন। এই নয়টি দেশ হলো হল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, চেক প্রজাতন্ত্র, ফ্রান্স, হাঙ্গেরি, ইতালি, পোল্যান্ড ও স্লোভাকিয়া। আরো নয়টি দেশে ইউরোপ–বিরোধী দলগুলির অবস্থান দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় স্থানে থাকবে বলে জরিপে প্রকাশ। এই দেশগুলি হলো, বুলগেরিয়া, এস্তোনিয়া, ফিনল্যান্ড, জার্মানি, লাতভিয়া, পর্তুগাল, রোমানিয়া, স্পেইন ও সুইডেন। এদিকে মাস সাতেক আগে হল্যান্ডে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে চরম–ডান রেডিক্যাল দল (পারতাই ফর ফ্রাইহাইদ বা ফ্রিডম পার্টি) জয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে চলেছে, যদিও বা দলটি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে সক্ষম হয়নি। ফলে দলটিকে আরো তিনটি রাজনৈতিক দলের সাথে কোয়ালিশনে যেতে হচ্ছে। আর এই কোয়ালিশন সরকারের অন্যতম লক্ষ্য হলো: হল্যান্ডে বিদেশী–আগমন বিশেষ করে অবৈধপথে আসা অভিবাসীদের ঠেকানো। আসন্ন এই সরকারকে বলা চলে এন্টি–ইমিগ্রেন্টস এবং জলবায়ু ও পরিবেশ–বান্ধব বিরোধী সরকার। আর এই মতবাদে বিশ্বাসী দলগুলির রাজনৈতিক উত্থান হয়েছে উপরে উল্লেখিত নয়টি দেশে। ফলে এ কথা অনেকটা নির্ধিধায় বলা চলে যে আগামী দিনগুলিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনুসৃত অনেক নীতিমালা উল্টোপথ ধরবে কিংবা সমস্যা দেখা দেবে। আগামী দিনগুলিতে জলবায়ু নিয়ে ইউরোপের নীতিমালা অনেকটা নেতিবাচক রূপ ধারণ করবে। যদিও বা বর্তমান জরিপগুলি এখনও ক্ষমতাসীন নেতা, উরসুলা ভন ডার লেয়েনের জয়ের ইঙ্গিত দেয়, তারপরও উগ্র ডানপন্থীদের আসনের সম্ভাব্য বৃদ্ধি ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ভবিষ্যতের জন্য উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে। ই ইউ–এর অর্থনৈতিক ল্যান্ডস্কেপে রাজনৈতিক প্রভাব প্রাথমিকভাবে ‘গ্রিন ডিল’ বাস্তবায়ন এবং ইউক্রেনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ককে প্রভাবিত করবে বলে মনে করা হচ্ছে। অন্যদিকে এটি পরোক্ষভাবে অন্যান্য জি–১০ মুদ্রার বিপরীতে ইউরোর অবমূল্যায়নও করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
২) প্রশ্ন : ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভুক্তদেশগুলির জনগণ দিন দিন ‘ইউরোপ–বিরোধী’ হয়ে উঠছে কেন? ইউরোপ–বিরোধীরা মনে করেন তাদের দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ইস্যুতে ইউনিয়ন অতিরিক্ত পরিমাণ নাক গলায়। তারা মনে করেন, ইউরোপের দিকে ধেঁয়ে আসা শরণার্থী ঠেকাতে ইউরোপ সম্পূর্ণ ব্যর্থ, ব্যর্থ ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার ব্যয় রোধে। রাশিয়ার সাথে ইউক্রেনের যুদ্ধ এবং ইউক্রেনকে ইউরোপের সাহায্য দেয়া তাদের অর্থনৈতিক মন্দার অন্যতম কারণ বলে তারা মনে করেন। আর এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে লাভবান হচ্ছে অতি–ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি এবং দলের নেতারা। তারা পাচ্ছেন সাধারণ জনগোষ্ঠীর সমর্থন। ফলে দেখা যায় লিবারেল–রাষ্ট্র হিসাবে পরিচিত ফ্রান্সে, ফ্রান্স ন্যাশনালিস্ট পার্টি নেতা মেরিন ল প্যান, জার্মানিতে ‘অলটারনেটিভ ফর ডয়েস্টল্যান্ড বা এ এফ ডি, অস্ট্রিয়ার ফ্রিডম পার্টি অব অস্ট্রিয়া, কিংবা হাঙ্গেরির কট্টর ডানপন্থী নেতা ভিক্টর ওরবানের মত রাজনৈতিক দল ও নেতাদের উত্থান ও অগ্রযাত্রা। এছাড়া রয়েছে ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে কৃষকদের মাঝে প্রচণ্ড অসন্তোষ। হল্যান্ডের কৃষকরা মনে করেন পরিবেশগত কারণ দেখিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন অতিরিক্ত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে চলেছে তার ফলে তাদেরকে অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। জাতীয় সরকার এই ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে চাইলেও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে পাশ কেটে যাবার কোন আইনগত পথ নেই। সে কারণে তারা ক্ষুদ্ধ। এই পরিস্থিতি ২০১৬ সালে ব্রেক্সিটের অপ্রত্যাশিত ফলাফল এবং ২০১৬ সালে মার্কিন নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ী হওয়ার কথা মনে করিয়ে দেয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাবার জন্যে সে সময় ইউরোপ–বিরোধীরা এই বলে ভোটারদের ভোট আদায় করেছিল যে ‘ইউনিয়ন দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে অত্যধিক নাগ গলায়, নানা শর্ত আরোপ করে এবং আমাদের নিজের সমস্যা সমাধানে আমরা নিজেরা কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারিনা। আমাদের চেয়ে থাকতে হয় ইউনিয়নের অনুমতির জন্যে।’ একটি দেশের জনগণ যখন ক্ষমতাসীন দলের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়, তখন তারা পরিবর্তন খোঁজে। ইউরো নিউজের জরিপ অনুসারে, দুটি অতি–ডান গোষ্ঠী প্রায় ২০% আসন লাভ করতে পারে, যা ইউরোপীয় পার্লামেন্টকে ডানদিকের পরিবর্তনের দিকে পরিচালিত করতে পারে।
৩) উদ্বেগের ব্যাপার হলো, উগ্র ডানপন্থী দলগুলোর প্রতি ক্রমবর্ধমান সমর্থন ইউক্রেনের সাথে ইইউ–এর কূটনীতিকে হুমকির মুখে ফেলবে। জার্মান এএফডি পার্টি, অস্ট্রিয়ান ফ্রিডম পার্টি এবং ফরাসি ন্যাশনালিস্ট পার্টি ইত্যাদি দলগুলিকে রাশিয়াপন্থী অবস্থানের দিকে ঝুঁকতে দেখা যায়। এটি রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা এবং ন্যাটোকে শক্তিশালী করার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রচেষ্টার পথে সম্ভাব্য বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন। দুর্বল–ন্যাটো মানে সবল–রাশিয়া। আর রাশিয়া যে ন্যাটোকে দুর্বল করার জন্যে অনেক আগ থেকে উঠে পড়ে লেগেছে তা আর গোপন কিছু নয়। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনের ফলাফল প্রভাবিত করতে রাশিয়া ব্যস্ত বলে ইতিমধ্যে অভিযোগ উঠেছে। গত ২৭ মার্চ চেক রিপাবলিক ‘ভয়েস অফ ইউরোপ’ নামে এক নিউজ সাইটের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। অভিযোগ এই নিউজ সাইট প্রো–রাশিয়ার নেটওয়ার্কের অংশ হিসাবে কাজ করছিল। এর ঠিক একদিন পর বেলজিয়ামের প্রধান মন্ত্রী ডি ক্রু বেলজিয়াম পার্লামেন্টে এই নিষেধাজ্ঞার কথা উল্লেখ করে বলেন, রাশিয়া ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্যদের টার্গেট করেছে, এমন কী তাদের অর্থও দিয়েছে। এরপর ২ এপ্রিল চেক নিউজ পোর্টাল ‘ডেনিক এন’ কয়েক মন্ত্রীর উদ্ধৃতি দিয়ে বলে, জার্মান অতি–ডান রাজনীতিবিদ পেটর বাইস্ট্রন (এমপি, এএফডি) এর অডিও রেকর্ডিং রয়েছে যেখানে তাকে অর্থ গ্রহণ করার জন্য দায়ী করা হয়। রাশিয়ার গোয়েন্দা তৎপরতা এখানেই থেমে থামেনি। ইউরোপীয় রাজনীতিবিদদের রাশিয়ার পক্ষে প্রচারের জন্য অর্থ প্রদান করা হয়েছিল কিনা এই মর্মে বেলজিয়ামের পাবলিক প্রসিকিউটর অফিস বর্তমানে তদন্ত করছে বলে জানা যায়। এছাড়া ইউক্রেনীয় রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ী ভিক্টর মেদভেদচুক, যিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠ হিসাবে পরিচিত তাকে ‘ভয়েস অফ ইউরোপের’ অন্যতম ব্যক্তি হিসাবে মনে করা হয়। ন্যাটোকে নিয়ে রাশিয়া বড় উদ্বিগ। ন্যাটোর কারণে রাশিয়া পারছে না ক্রিমিয়ার মত এক সময়কার সোভিয়েত ইউনিয়নের স্যাটেলাইট দেশগুলি পুনর্দখল করতে। উপসংহারে বলতে হয়, ইউরোপে এন্টি–ইউরোপ গোষ্ঠী দিনদিন শক্তিশালী হয়ে আত্মপ্রকাশ করছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন চলতি বছর। ডোনাল্ড ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে ফিরে আসার সমূহ সম্ভাবনা। ন্যাটোর প্রতি ট্রাম্পের মনোভাব কী তা সবার জানা। সবার জানা রাশিয়ার পুতিনের সাথে ট্রাম্পের সখ্য। অতএব, ন্যাটোকে দুর্বল করতে এদের চাইতে ভালো খুঁটি আর কোথায় পাওয়া যাবে। মাইনাস অথবা দুর্বল–ন্যাটো মানে রাশিয়ার পোয়াবারো। দেখা যাক আগামীতে কী হয়।
লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট