কথায় আছে ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’। গত ছয় মাস ধরে প্যালেস্টাইনের গাজা ও রাফা উপত্যাকায় বিরামহীন হত্যাযজ্ঞ চলছে। আকাশ, স্থলপথ, নৌপথ থেকে বোমার আঘাতে উড়িয়ে দেয়া হচ্ছে বসতবাড়ি, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, বাজার। কোন কিছুই রেহাই পাচ্ছে না এই আক্রমণ থেকে। অন্যদিকে বোমা পড়ছে ইরান, সিরিয়া, ইরাক, লেবাননে। নিরীহ মানুষ মারার এই খেলায় মেতেছে ইসরায়েল। তার শুরুটা যদিও বা করেছে হামাস বাহিনী, গত বছরের ৭ অক্টোবর। অতি ক্ষমতাধর যুক্তরাষ্ট্রের বলে বলীয়ান হয়ে যে দেশটি এই সমস্ত হত্যাযজ্ঞ নির্বিচারে ঘটিয়ে চলেছে, গোটা বিশ্বকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে, সেই ইসরায়েলের কোন দোষ দেখার কেউ নেই যেন। আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি ভঙ্গ করে গত ১ এপ্রিল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয় শীর্ষ কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ রেজা জাহেদী সহ ইরান ইসলামিক রেভলিউশনারী গার্ড কোরের কয়েক কর্মকর্তাকে। বিগত ছয় মাস ধরে ইসরায়েল গোটা গাজাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে, অস্ত্রের মুখে গাজা ও রাফাবাসীকে নিজ বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য করেছে। তবুও গণতন্ত্রের সূতিকাগার, গণতন্ত্রের লালন–পালন–কর্তা দাবিদার ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্র, এমন কী সৌদি আরবও মুখে কুলুপ এঁটেছে, চোখে লাগিয়েছে পর্দা। জর্ডানও যোগ দিয়েছে সমপ্রতি এই দলে। মাঝে মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র নিন্দা জানিয়েছে, ইসরায়েলকে সহনশীল হতে বলেছে, কিন্তু কে শোনে কার কথা। আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন ভঙ্গ করে ইসরায়েল যখন সিরিয়ায় ইরানি কনস্যুলেটে ইরান গার্ড কোরের কয়েক কর্মকর্তাকে হত্যা করলো, তখন একবারও কেউ এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করলো না। সবাই নিশ্চুপ, যেন কিছু ঘটেনি। কিন্তু যেই না এই আক্রমণের ঠিক এক সপ্তাহের মাথায় ইরান ইসরায়েলে পাল্টা আক্রমণ চালালো, তখন ইসরায়েল তো বটেই, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য সহ গোটা উন্নত বিশ্ব ও ইউরোপ নিন্দা ও প্রতিবাদে মুখর হলো। তাদের কথা– ইরানের এতো বড় দুঃসাহস! একে তো শায়েস্তা করতে হয়। ডাকা হলো জাতিসংঘের জরুরি অধিবেশন। যুক্তরাষ্ট্র জারি করলো নতুন নিষেধাজ্ঞা। এর আগে গাজায় ত্রাণ কর্মীদের হত্যার ঘটনার পর ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু কিছুটা বেকায়দায় পড়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য কিছুটা ‘গোস্সা’ হয়েছিল ইসরায়েলের এমন আচরণে। সে সময় একদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের চাপ, অন্যদিকে গাজা ও রাফায় আক্রমণ চালিয়ে যাবার জন্যে তার সরকারের মধ্যে উগ্র ডানপন্থীদের চাপ সব মিলিয়ে কিছুটা সমস্যায় ছিলেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। কিন্তু ইরানের ইসরায়েল আক্রমণ নেতানিয়াহুকে যেন নতুন ‘জীবন’ দিলো। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ ভুলে গেলো ত্রাণকর্মী হত্যার কথা, ভুলে গেলো গাজা ও রাফায় ইসরায়েলের হত্যাযজ্ঞের কথা। সব ভুলে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র দেশগুলি, এমন কী আরব দেশ জর্ডানও এগিয়ে এলো তাদের বন্ধু রাষ্ট্র ইসরায়েলকে রক্ষা করতে। জর্ডান সহ যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ছোড়া তিন শতাধিক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র রুখতে এগিয়ে এলো ইসরায়েলের পাশে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন ঘোষণা দিলেন, ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ‘লৌহবর্মের’ মত। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধ সত্ত্বেও ইসরায়েল হামলা চালালো ইরানের ওপর। না, এবারও কোন দিক থেকে কোন নিন্দার ঝড় তো দূরের কথা, নিন্দার বাতাসও উঠলো না। তাই জন্যে বলি, চলমান ঘটনা প্রবাহ দেখে মনে হয় ‘যত দোষ ওই ব্যাটা নন্দ ঘোষের’ অর্থাৎ প্যালেস্টাইন আর ইরানের।
২) বলছিনে ইরান ধোঁয়া তুলসীর পাতা। আমেরিকার দৃষ্টিতে তো নয়ই। ইরানের গণতন্ত্র প্রশ্নবিদ্ধ, সে দেশে গণতন্ত্র নেই, নারী–স্বাধীনতা নেই, নেই বাক স্বাধীনতাও। রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের মতে, ইরানের যে বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম বিশ্ব এবং ইসরায়েল খুব চিন্তিত ও উৎকণ্ঠিত তা হলো ‘এ নিউক্লেয়ার ইরান’ অর্থাৎ ‘একটি পারমাণবিক ইরান’। ২০১২ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারাভিযানে রিপাব্লিকান প্রার্থী মিট রমনিকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আমেরিকার জন্যে সব চাইতে বড় হুমকি কি? উত্তরে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘অ হঁপষবধৎ ওৎধহ’ হিজবুল্লাহ, হুতি, হামাস ইত্যাদি গোষ্ঠীর প্রতি ইরানের রয়েছে পূর্ণ সমর্থন। ইসরায়েলের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদিনের ঘুম হারাম হবার পেছনে এদের রয়েছে বড় ভূমিকা। গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাস সশস্ত্র বাহিনী সশস্ত্র হামলা চালিয়ে প্রায় ১২০০ ইসরায়েলি নাগরিক হত্যা ও ২৫৩ জনকে জিম্মি করে (যা সমর্থনযোগ্য নয়) গাজায় নিয়ে যাবার পর গত ছয় মাস ধরে ইসরায়েল এর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে ৩৫ হাজারের বেশি শিশু, নারীসহ প্যালেস্টাইনি নাগরিককে হত্যা করেছে বলে প্রকাশ। গাজা ও রাফাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে। ইতিমধ্যে এই হত্যাযজ্ঞকে ‘গণহত্যা’ হিসাবে বর্ণনা করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। হল্যান্ডে অবস্থিত আন্তর্জাতিক আদালতে গো ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে দক্ষিণ আফ্রিকা ‘গণহত্যা কনভেনশন’ আহবান করে এবং দখলকৃত ফিলিস্তিন অঞ্চল ও গাজা উপত্যকায় সংঘটিত ‘যুদ্ধাপরাধ’ এবং গণহত্যার জন্যে ইসরায়েলকে অভিযুক্ত করে। আদালতের প্রেসিডেন্ট জোয়ান ডনোগুয়ের দেয়া একটি অস্থায়ী আদেশে আদালত ইসরায়েলকে ‘অবিলম্বে কার্যকর’ ব্যবস্থা নিতে হবে বলে ঘোষণা দেয়, যাতে তার সেনাবাহিনী ‘জাতিসংঘ কনভেশন’ দ্বারা নিষিদ্ধ এমন কোন কাজ করা থেকে বিরত থাকে। কিন্তু ওই যে বললাম, কে শোনে কার কথা। বরাবরের মত ইসরায়েল এই সমস্ত ‘ডাক’ ও ‘হুশিঁয়ারিকে’ বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে চলেছে।
৩) মধ্যপ্রাচ্যের এই যে চলমান সংঘাত তার নেতিবাচক প্রভাব কিন্তু ভয়াবহ। এই প্রভাব যে কেবল দক্ষিণ এশিয়াতে পড়বে তা ভাবার কোন কারণ নেই। এর প্রভাব গোটা বিশ্বে পড়তে বাধ্য। এই সংঘাত বাড়তে থাকলে আশংকা করা হচ্ছে তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ১০০ ডলার বাড়তে পারে। ইরানে রয়েছে বিশাল তেল সম্পদ এবং বৈশ্বিক বাজারে সরবরাহ করতে গিয়ে কোন ব্যাঘাত ঘটলে দাম বাড়াটাই স্বাভাবিক। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রও খুব একটা চাইছে না ইরান চলমান সংকটে কোনভাবে জড়িয়ে পড়ুক। তাতে গাজা যুদ্ধকে কমিয়ে আনার মার্কিন লক্ষ্যের ক্ষতি করবে এবং বিশ্ব–অর্থনীতির জন্যে অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হবে যা ইতিমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মার্কিন–নির্বাচনের বছরে ইউক্রেন যুদ্ধের মূল্য ভোগ করছে। গাজা যুদ্ধের পরিধি যদি বাড়ে তার প্রভাব বাংলাদেশ, ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির জন্যে গুরুতর হতে বাধ্য। লক্ষ লক্ষ দক্ষিণ এশীয় অভিবাসী মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করে এবং এই যুদ্ধ বাড়লে তার নেতিবাচক প্রভাব তাদের আয় এবং নিরাপত্তার ওপর। কেবল তাই নয়, মধ্যপ্রাচ্য হলো দক্ষিণ এশীয় দেশগুলির রপ্তানির একটি বিরাট অংশের গন্তব্যের স্থল। ফলে রেমিটেন্সের প্রবাহ কমবে এবং পরিণতিতে প্রতিটি দক্ষিণ এশীয় রাষ্ট্রের অর্থনীতিতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এদিকে পাকিস্তানও রয়েছে বেশ বেকায়দায়। ইরানের সাথে পাকিস্তানের রয়েছে দীর্ঘ সীমান্ত। আর সীমান্তের দু–ধারে দীর্ঘদিন ধরে চলছে সংঘাত এবং এই সংঘাত কমানোর কোন লক্ষণ দু’দেশের কারো রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয় না।
সমপ্রতি পাকিস্তান–ভিক্তিক জঙ্গিরা ইরানি নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর আন্তঃসীমান্ত হামলা চালালে ইরান পাকিস্তানে বিমান হামলা চালায়। পাকিস্তানও ইরানে বিমান হামলা চালিয়ে পাল্টা জবাব দেয়। যাই হোক, পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হবার আগে চীন ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় উত্তেজনা প্রশমিত হয়। দু’দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক চালু করার ক্ষেত্রে উভয় পক্ষ এগিয়ে আসে। ইসরায়েল এবং ইরানের মধ্যে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ বিশেষ করে পাকিস্তানের অর্থনীতিকে আরো পঙ্গু করে দেবে। ভারতও ইতিমধ্যে তার নাগরিকদের পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত ইসরায়েল ও ইরান ভ্রমণ না করার পরামর্শ দিয়েছে। এই দুই দেশের সাথে ভারতের রয়েছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। যদি এই অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়ে তাহলে সেটিও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে ভারতের অর্থনীতিতে, কেননা ইসরায়েল ও ইরানে রয়েছে ভারতের বিশাল কর্মী বাহিনী।
বর্তমানে ইসরায়েলে ১৮ হাজার ভারতীয় কর্মী কাজ করেন, অন্যদিকে ইরানে রয়েছে ভারতের চার লক্ষ শ্রমিক। বাংলাদেশের সাথে ইরান ও সৌদি আরবের রয়েছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। দেশের অর্জিত রেমিটেন্সের বড় একটি অংশ আসে এই অঞ্চল থেকে। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের ভালোর জন্যে মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা প্রশমিত হওয়া নিতান্ত প্রয়োজন এবং তা যত তাড়াতাড়ি হয় তা সবার জন্যে মঙ্গল, প্যালেস্টাইনের জন্যে যেমন ঠিক তেমনি ইসরাইলের জন্যে, প্রয়োজন গোটা বিশ্বের জন্যে।
লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট