হল্যান্ড থেকে

মৃত্যু কি জীবনের সত্য? প্রিয় বন্ধু ইউনুসের মৃত্যুতে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ৬ এপ্রিল, ২০২৪ at ১০:২১ পূর্বাহ্ণ

হারুকি মুরাকামি সমসাময়িক এক জাপানী লেখক। তার লেখা উপন্যাস, প্রবন্ধ এবং ছোটগল্প জাপানে এবং আন্তর্জাতিকভাবে ‘বেস্ট সেলার’ হয়েছে। মৃত্যু প্রসঙ্গে এই লেখক বলেছিলেন, ‘মৃত্যু জীবনের উল্টো পিঠ নয়, এটি হচ্ছে জীবনের একটি অংশ।’ এ কথা আমরা অনেকেই জানি, কিন্তু জেনেও মানতে চাইনা বা পারি না। আর তাই প্রিয়জনের বিয়োগ ব্যথায় আমরা কষ্ট পাই, তাকে নিয়ে ভাবি, তার সাথে কাটানো স্মৃতিগুলি হাতড়িয়ে এক ধরনের কষ্টমেশানো আনন্দ খুঁজে পাবার চেষ্টা করি। সাধারণ মানুষের কষ্টের ব্যাপারটা অন্যের চোখে ধরা পড়ে। আবেগতাড়িত হয়ে কান্নাকাটি করে। কিন্তু একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, শ্রেণিভেদে এই শোকের বহিঃপ্রকাশ ভিন্ন। যেমন খেয়াল করবেন, অতি দরিদ্র যারা তারা কোন বিয়োগব্যথায় হাউমাউ করে বুক চাপড়িয়ে কান্নাকাটি করেন, মধ্যবিত্তদের মাঝে শোকের প্রকাশটা একটু রেখেঢেকে। ধনী শ্রেণির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এমন নয় যে, তাদের কষ্ট হয় না বা নিকটজনের বিয়োগব্যথায় অশ্রু ঝরে না। কিন্তু তারা কষ্টটাকে বুকের মধ্যে চেপে রাখেন। মৃত্যুর ক্ষেত্রে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন সব কিছুর উর্ধে। তার জীবনে মৃত্যু এসেছে বারবার। এর শুরু যখন তিনি তার মা সারদা দেবীকে হারান। তখন তার বয়স মাত্র ১৪ বছর। রবীন্দ্রনাথ বিখ্যাত ইংরেজ লেখক থমাস চেটারটনের লেখায় বেশ প্রভাবিত হয়েছিলেন। সেই কবি যখন মাত্র ১৭ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেন রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুকে নতুনভাবে উপলব্ধি করলেন। ভানুসিংহ ঠাকুর ছদ্মনামে কবিগুরু ব্রুজবলি ভাষায় বৈষ্ণব গান লিখলেন, ‘মরণ রে, তুহু মম শ্যাম সমান’ অর্থাৎ ‘হে মরণ তুমি আমার প্রভুর মতো’। পরবর্তীতে ১৮৮৪ সালে তার প্রিয় বৌঠাকুরণ আত্মহত্যা করার (তখন কবির বয়স ২৪) এক বছর আগে এই গানগুলি একটি বই আকারে প্রকাশ করার জন্যে তাকে উৎসাহিত করেন, যার ফসল ‘ভানুসিংহের পদাবলী। কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুতে তার মনে হলো তিনি তার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হারিয়ে ফেললেন। জীবন এগিয়ে যায়। কিন্তু মৃত্যু রবীন্দ্রনাথকে ছেড়ে যায়নি। উনিশ বছর সংসার করার পর কবি হারালেন তার স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে। তখন তার (মৃণালিনী) বয়স ছিল মাত্র ৩০। এরপর তিনি হারালেন তার ১৩ বছরের কন্যা রেনুকাকে। রেণুকার মৃত্যুর দুবছরের মাথায় মারা গেলেন তার বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। সে ছিল ১৯০৫ সাল। অবশেষে চিরদিনের জন্যে কবি হারালেন তার অতিপ্রিয় সন্তান, শমীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। তখন তার বয়স মাত্র ১৩। মৃত্যু যেন তার সঙ্গী হয়ে ওঠে। তিনি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে একটি চিঠিতে লিখেছেন, ‘মৃত্যু ছিল আমার জন্য আশীর্বাদ। এটি ছিল আমার কাছে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনের অনুভূতি, এটি ছিল পরিপূর্ণতা।’ তিনি মৃত্যুকে ‘জীবনের সত্য’ বলে মেনে নিয়েছিলেন। বোধকরি, কেবল কবিগুরুর পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল মৃত্যুকে ‘নান্দনিকভাবে উপলদ্ধি’ করা।

আমরা রবীন্দ্রনাথ নই। তাই এই উপলদ্ধি আমার তো বটেই, অনেকের মাঝে হয় না। এতকথা বলার পেছনের কারণ সমপ্রতি অতি কাছের এক প্রিয় বন্ধুর মৃত্যুকে অতি কাছ থেকে দেখা বলে। এবার দেশে এসে পৌঁছার দিন কয়েকের মধ্যে আমার আশৈশব প্রিয় বন্ধু ইউনুস চিরদিনের তরে বিদায় নিয়েছে। সেই কবে কিশোরতরুণ বয়সে আমাদের দুজনের মাঝে যে বন্ধুত্বের বন্ধন গড়ে উঠেছিল তার হঠাৎ ছন্দপতন হলো, অপ্রত্যাশিতভাবে। ইউনুস (মোহাম্মদ) এমন কোন বিশিষ্টজন না যে তাকে নিয়ে পত্রিকার পাতায় লিখতে হবে। কিন্তু সে ছিল আমার কাছে, আমার গোটা পরিবার এমন কী আমার নিকটজনদের কাছে অতি প্রিয় একটু মুখ, আমাদের বৃহৎ পরিবারের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সচ্ছল পরিবারে জন্ম নেয়া ইউনুস কলেজবিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় পা রাখেনি বটে, কিন্তু তার ঈর্ষণীয় শারীরিক গঠন, চেহারা, গায়ের বর্ণ সব মিলে সে ছিল আমাদের বন্ধু মহলে অন্যতম। সহজে মেয়েদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার মত ছিল তার সৌন্দর্য। তার বাবা ছিলেন সুপুরুষ, তার ইরানী মাও ছিলেন আকর্ষণীয়া। ইউনুসের সব চাইতে বড় যে গুণ ছিল তা হলো অন্যের বিপদে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও এগিয়ে আসা। কদমতলী বাসস্ট্যান্ডলাগোয়া তার নিজস্ব বাড়ি। যেহেতু তার বাবা, খয়রাতি সওদাগর কদমতলি মহল্লার কয়েক সর্দারের অন্যতম সে কারণে ইউনুসকে আশপাশের সবাই সমীহ করতো, বলা চলে ভয় পেতো। আর তার ‘বলে’ বলীয়ান হয়ে আমরা যে কয়েক অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলাম (আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু সাইফল, দীপক, হিরু) আমরা সবাই বুক ফলিয়ে তরুণ বয়সে পাড়ায় ঘুরে বেড়াতাম। আমার প্রথম কলকাতা দেখা হতো না যদি ইউনুস সঙ্গী না হতো। তখন আমি ঢাকায় সাংবাদিকতা করছি। রোজার মাসে তার দুপুরের খাবার হতো আমাদের বাসায়। তার বাসায় অলিখিত নিয়ম ছিলসবার রোজা রাখা চাই। রোজা রাখেনি বা পারেনিএই অজুহাতও দেয়া যাবে না। আমাদের সাথে বাসায় লাঞ্চ করে ইফতারির আগেআগে বাসায় গিয়ে সে সোজা ইফতারির টেবিলে অংশ নিতো।

ইউনুসের সাথে আমার অনেক স্মৃতি। তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। ইউনুস মরিয়া হয়ে উঠলো মধ্যপ্রাচ্যে যাবার জন্যে। দুবাই থেকে আসা তার এক পরিচিত বন্ধুর পেছনে সে লেগে রইলো। যেদিন ইউনুস দুবাইয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দেবে সেদিন আমরা কয়েক বন্ধু জড়ো হলাম তার বাসায়। এয়ারপোর্টে বিদায় নেবার সময় সে তার বাবাকে জানালো যে সে যাচ্ছে ‘গলাকাটা’ পাসপোর্ট নিয়ে। কথাটি আমাদের কাছেও লুকিয়েছিল সে। তার বাবার তো টেনশনের শেষ নেই। বছর কয়েকের মাথায় যখন ফিরলো তখন তার অনেক পরিবর্তন। পোশাকআশাক, কথাবার্তা এমন কী চলাফেরায়ও। এর বেশ কয়েক বছর পর, আমি তখন ঢাকায় বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি) ছেড়ে বাংলাদেশ টাইমসসে রিপোর্টার হিসাবে যোগ দিয়েছি। পিআইবিতে নিজস্ব কামরা, পিয়ন ছিল, কিন্তু বাংলাদেশ টাইমসসে আমরা এগারজন রিপোর্টার সারিবদ্ধ ছোট্ট একটি কামরায় বসতাম। দুবাই থেকে দেশে ফিরে ইউনুস এলো টাইমস অফিসে দেখা করতে। আমাকে এইভাবে কোর্ট বিল্ডিংএর টাইপিস্টদের মত কাজ করতে দেখে হতাশ হয়ে বলে, ‘একি, এখানে কেন?’ নিচু গলায় তাকে বলি, ‘এটি পত্রিকা অফিস, সরকারি অফিস নয়। আর পিআইবির চাকরি তো আমি নিজে ছেড়েছি। সেখানে সাংবাদিকতার চার্ম নেই।’ ইউনুস লক্ষ্য করি আমার উত্তরে সন্তুষ্ট হলো না।

যাই হোকএবার দেশে এসে শুনি সে খুব অসুস্থ। দিন কয়েক আগে হাসপাতাল থেকে কিছুটা সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছে। ফোন করে বলে, ‘দোস্ত, শরীর ভালো না, একবার আয়, তোকে দেখতে ইচ্ছে করছে।’ পরদিন যাবো বলে কথা দিলেও শেষতক যাওয়া হয়নি। সেদিন আবার ফোন করে বলে, আয়। পরদিন সন্ধ্যায় ইউনুসকে দেখতে গেলাম। তার ভার্সিটিপড়ুয়া ছোট মেয়ে, ইকরা আমাকে ও সুমনাকে ড্রয়িং রুমে বসিয়ে তার বাবাকে হাতে ধরে নিয়ে আসে। তার শারীরিক দশা দেখে ভীষণ কষ্ট হলো। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে, শ্বাস নিতেও। তাকে কথা না বলতে বলি। সে বলতে চাইছে, কিন্তু পারছে না। কিছুক্ষণ পরপর হাতে ধরা ‘ইনহেলার’ নিচ্ছে। তার হাতে একটি বড় সাইজের টাওয়েল দিলাম। কিছু না বলে সেটি সে তার পাশে বসা মেয়েকে দিলো। স্বাভাবিক সময় হলে সে খুশি হতো। এবার কোন প্রতিক্রিয়া দেখলাম না। চলে এলাম এক সময়। পরদিন আমার কেটে গেলো ব্যস্ততায়। তার একদিন পর ঘুম ভাঙলো দীপকের ফোনে। জানালো, ইউনুস আজ সকালে মারা গেছে। ইউনুস চলে যাবে, কিন্তু এতো সহসা! সুমনা বলে, ‘উনি মনে হয় তোমার অপেক্ষায় ছিলেন?’ সে তো কেবল আমার বন্ধুই ছিল না, সে ছিল আমার অতি আপন, আমার ভাই। আমার সাহস, ভরসার স্থল। আমি রবি ঠাকুর নই যে মৃত্যুকে ‘জীবনের সত্য’ বলে মেনে নেব, কিংবা ‘মৃত্যুকে নান্দনিকভাবে’ উপলদ্ধি করতে সক্ষম হবো। আমি যে অতি সাধারণ একজন। ইউনুসের মৃত্যু সংবাদ পাবার পর কিছুক্ষণ স্তব্ধ, বাকহীন বসে থাকার পর এক সময় চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। তারপর বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো কান্না।

লেখক

সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধআল্লাহ্‌র করুণাধারায় সিক্ত হবার অবারিত সুযোগ
পরবর্তী নিবন্ধশবে কদর হাজার মাসের শ্রেষ্ঠ রজনী