‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’– মান্না দে’র অতি জনপ্রিয় এই গানটি শুনেননি তেমন বাঙালি বোধকরি এপার–ওপার দু–বাংলায় খুঁজে পাওয়া যাবে না। কেবল দু–বাংলায় বলি কেন, প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। ‘আড্ডা’ প্রসঙ্গ এলে প্রথমেই মনে পড়ে এই গানের কথা, কলকাতার বিখ্যাত ‘কফি হাউজের’ কথা। কলকাতায় বেড়াতে গেছেন কিন্তু কফি হাউস গিয়ে কফি বা চায়ের সাথে কিছু খেয়ে আসেননি তেমন বাংলাদেশি খুব কমই পাওয়া যাবে। কলকাতায় বার কয়েক যাওয়া হয়েছে কিন্তু কফি হাউজে গেছি কেবল একবার। বছর কয়েক আগে। সেখানে গিয়ে দেখি সে কী আড্ডা। টেবিল গোল করে চা–কফির কাপে ধুঁয়ো তুলে জম্পেশ আড্ডা দিয়ে চলেছেন তরুণ বয়েসী থেকে শুরু করে বয়স্করা। এক সময় সেখানে আড্ডা দিতেন কলকাতার কবি, সাহিত্যিক, ছাত্র নেতা, বাম রাজনীতিবিদরা। শুনেছি সেই ধরনের আড্ডা আর অনেক দিন ধরে খুব একটা জমছে না। এখন কফি হাউজে তরুণ–তরুণীদের সমাগম বেশি। আড্ডার ধরনও অনুমান করি বদলেছে। বোধকরি সে কারণে গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার লিখেছিলেন– ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই / কোথায় হারিয়ে গেল সোনালী বিকেলগুলো সেই আজ আর নেই…:/ একটা টেবিলে সেই তিন চার ঘন্টা, চারমিনারটা ঠোঁঠে জ্বলতো / কখনো বিষ্ণু দে কখনো যামিনী রায়, এই নিয়ে তর্কটা চলতো / রোদ ঝড় বৃষ্টিতে যেখানেই যে থাকুক, কাজ সেরে ঠিক এসে জুটতাম /চারটেতে শুরু হয়ে জমিয়ে আড্ডা মেরে, সাড়ে সাতটায় ঠিক উঠতাম।’ (সুরকার : সুপর্ণ কান্তি ঘোষ, নচিকেতা ঘোষের ছেলে)
আড্ডাবাজ হিসাবে বাঙালিদের একটা নাম আছে। যদিও বা আড্ডার শুরু কখন এই নিয়ে কোন স্পষ্ট তথ্য নেই, তবে ধরে নেয়া হয় ইংরেজদের হাত ধরে বাংলায় আড্ডার গোড়াপত্তন। সেই ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি জয়ী হলে বাংলার অধিকাংশ রাজ্য তারা নিজ দখলে নেয়। সে সময় কলকাতার হুগলি নদীর তীরে কেবল কিছু স্থাপনা ছিল, যা দ্রুত ইংরেজদের আমলে এক সময় নগরীর রূপ ধারণ করে। ১৭৭২ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত বৃটিশ ইন্ডিয়ার রাজধানী হিসাবে কলকাতার বিবিধ উন্নতি সাধন ঘটে। আর এই সময়ের মধ্যে কলকাতার বাঙালিদের মধ্যে বিশেষ করে ‘অভিজাত শ্রেণি’ বাঙালিদের মাঝে ইংরেজদের কারণে সংস্কৃতি, ভাষা, খাদ্য, সাহিত্য, ফিলোসফি, শিল্পকলা ইত্যাদি বিষয়ে প্রচুর প্রভাব বিস্তার করে। এমন কী কথাবার্তায়, পোশাক–আশাক, আচরণেও। দেশ–বিদেশের ধনী সমপ্রদায়কে আকর্ষণ করতে শুরু করে এই নগরী। গড়ে উঠে এক নব্য বাঙালি শ্রেণি। যারা ইংরেজদের অধীনে প্রশাসক, ব্যবসায়ী ও কেরানি হিসাবে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে কাজ করতে থাকেন। এর ফলে বেশ কিছু সম্ভ্রান্ত বাঙালি পরিবার ইংরেজদের ড্রয়িং রুমে প্রবেশের সুযোগ পান। হয়ে উঠেন ইংরেজদের পারিবারিক ও ব্যবসায়িক বন্ধু। এর মধ্যে অন্যতম জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবার। গোটা বাঙালি সমাজে জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে এই পরিবারের কী প্রচণ্ড প্রভাব তা আমরা দেখতে পাই। ঠাকুর পরিবারেও আড্ডার আসর বসতো ইংরেজদের নিয়ে, সাথে পানীয়। সেই আড্ডা চলতো দীর্ঘ সময় ধরে। তারপর সেই আড্ডা– ধীরে ধীরে চলে এলো মধ্যবিক্ত ও নিন্ম মধ্যবিক্ত বাঙালি পরিবারে। দিন দিন এই আড্ডা বাঙালিদের মধ্যে জনপ্রিয় হতে লাগলো। এরপরও লেখক নিরোদ চৌধুরীর এই নিয়ে আক্ষেপ ছিল। তিনি লিখেছিলেন, ‘বাঙালিদের মধ্যে ইংরেজদের মত নাচ, গান, আড্ডা হয় না। তিনি বলেছিলেন, ‘ No afternoon or evening parties, no dinners no at-homes. And of course, no dances’. ইংরেজদের লাইফ–স্টাইলের সাথে তুলনা প্রসঙ্গে তিনি এই কথাগুলি বলেছিলেন। নিরোদ চৌধুরী মারা গেছেন ১৯৯৯ সালে, ইংল্যান্ডে। আরো কিছু তথ্য এখানে উল্লেখ করা বাহুল্য হবে না বলে ধারণা। কলকাতায় ১৮১৭ সালে প্রথম পশ্চিমী ধাঁচে স্থাপিত হয় হিন্দু কলেজ (যা বর্তমানে প্রেসিডেন্সি কলেজ হিসাবে পরিচিত), এরপর ১৮৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হলো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। এই দুই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে গড়ে উঠে অনেক বইয়ের দোকান, যা কলেজ স্ট্রিট নামে খ্যাত। ছাত্র–ছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে, আশপাশের বইয়ের দোকানে, চায়ের দোকানে ক্লাসের অবসর সময়ে জড়ো হতে থাকে। তারপর ১৯৪২ সালে সেখানে খোলা হলো কফির দোকান, যা ১৯৪৭ নতুন নাম ধারণ করলো, ‘কফি হাউজ‘। তারপর তো ইতিহাস। এই কফি হাউজে আড্ডা এমনই জমে উঠতো যে বাইরে রাস্তা থেকে সেই শব্দ শোনা যেত।
তবে আড্ডা কেবল ক্লাব, ঘরের ড্রয়িং রুম কিংবা রেস্তোরাঁয় হয় তা ভাবার কোন কারণ নেই। আড্ডা চলে রাস্তার ধারে ‘রকে’, চায়ের দোকানে, রেস্তোরাঁয়, ফুটপাতের ধারে, পার্কে। মোদ্দা কথা কোথা নয়। আড্ডার বিষয়ের কোন ঠিক–ঠিকানা নেই। দেশের, বিশ্বের রাজনীতি থেকে শুরু করে সাহিত্য, সংস্কৃতি, সংগীত এমন কী পরচর্চা, পরনিন্দা কোনোটাই বাদ পড়েনা বাঙালিদের আড্ডায়। যে বিষয়টা আমার এখনো বোধগম্য নয় তা হলো, প্রায়শঃ লক্ষ্য করি দেশে–বিদেশে এই ধরনের আড্ডায় অংশগ্রহণকারীদের গলার স্বর হয় এতো উঁচু, যা একটু আগে বললাম, কফি হাউসের চার দেয়াল পেরিয়ে সড়কে গিয়ে পৌঁছায় ঠিক তেমনি। বুঝে পাইনে স্বর উঁচু করে কথা বলতে হবে কেন। একটি কারণ হতে পারে, তা হলো অন্যদের বক্তব্যকে চাপা দিয়ে নিজের বক্তব্য বা মতামতকে নিজের অজান্তে প্রাধান্য দেয়ার একটি প্রবণতা। ঠিক যেন বৃটিশ পার্লামেন্ট। আড্ডা সব শ্রেণির জনগণের মাঝে জনপ্রিয়। গরিবের মাঝেও। এমন কী পথ চলতেও অনেক সময় রাস্তার ধারে টোকাইদের জটলা হয়ে আড্ডা মারতে দেখা যায়। তবে তাদের আড্ডা ঘটা করে কোন আয়োজন করা হয়না। ঘটা করে আড্ডার আয়োজন করেন ধনী শ্রেণির লোকজন, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত শ্রেণির লোকজনও। প্রবাসে বাঙালিদের মধ্যে এমনটি প্রায়শ হয়। দেশের মত সেখানেও আড্ডার এক পর্যায়ে আসে দেশের–রাজনীতি। আড্ডা হবে আর তর্ক–বিতর্ক হবে না তেমনটি হবার হয়। আড্ডা জমে উঠে, আড্ডার শুরুটা প্রায় ক্ষেত্রে ধীরে–সুস্থে হলেও অনেক সময় তা উত্তপ্ত হয়ে উঠে, এমন কী একমত হতে না পেরে রাগ করে স্থান কিংবা আড্ডা ত্যাগ করার ঘটনাও অনেক সময় ঘটতে দেখা যায়। দেখা যায় হাতাহাতিও। আড্ডা নিয়ে এতো কথার পেছনে যে কারণ সেটি হলো দেশে আসার সপ্তাহ খানেক পর বন্ধুপ্রতিম ড. সেলিম চৌধুরীর দৃষ্টিনন্দন ড্রয়িং রুমের আড্ডা। তাতে যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের দু–একজনের সাথে আগ থেকে জানাশোনা। তাদের পেশায় কেউ ডাক্তার, কেউ ব্যবসায়ী, শিক্ষক, কেউ উকিল। এর বাইরে একজন হল্যান্ড থেকে আসা, ডাচ, পেশায় একাউন্টেন্ট, তার সাথে প্রবাসী এক বাংলাদেশি ব্যবসায়ী। আমাদের আড্ডায় ছিলেন দুই মহিলা, তবে তারা আমাদের আড্ডায় খুব একটা অংশ গ্রহণ করেননি। না করে বুদ্ধিমানের কাজ করেছেন বলে মনে করি। এদের একজন ড. সেলিম চৌধুরীর পত্নী জেবুননেসা চৌধুরী লিজা, অন্যজন হল্যান্ড থেকে আসা লেখকের স্ত্রী, সুমনা। বিদেশে এই প্রজন্মের ছেলে–মেয়েরা বিদেশ–মুখী হয়ে পড়েছে, সেটি ভালো না মন্দ এই নিয়ে নানা মুনির নানা মত। একজনের মন্তব্য, দেশে অগাধ সম্পত্তি ফেলে এরা বিদেশে গিয়ে কষ্টের জীবন যাপন করবে কেন। অন্যজনের অভিমত, দেশে অনেক কিছুর অভাব, অভাব নিরাপত্তার, সব ক্ষেত্রে। ইউরোপীয় পাসপোর্ট থাকলে কী বাড়তি সুবিধা এই নিয়ে চলে আলোচনা। পক্ষের এক জনের মন্তব্য, তাতে সুবিধা এই, ভিসার জন্যে কোন অনিশ্চয়তায় থাকতে হয়না। ইউরোপীয় পাসপোর্টধারী হলে ভিসা ছাড়াই পৃথিবীর সব দেশ ভ্রমণ করা যায়। সেটিই বা কম সুবিধা কি? এতো হই চইয়ের মাঝেও এক ফাঁকে আলাপ হলো কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের এক প্রাক্তন শিক্ষকের সাথে। দেশের শিক্ষাঙ্গনে বিরাজমান হতাশজনক পরিস্থিতি নিয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের যোগ্যতা নিয়ে তিনি তার হতাশা প্রকাশ করেন। এক ভাইস চ্যান্সেলরের নামোল্লেখ করে তিনি বলেন, তার একমাত্র যোগ্যতা সরকারের তোষামোদ করা, দৃষ্টিকটুভাবে পত্রিকার পাতায় নিয়মিতভাবে ব্যক্তি বন্দনা করে লেখালেখি করা। আড্ডায় উপস্থিত আর এক অতিথি সমাজের পরিচিত দুই ব্যক্তিকে তার ভাষায় ‘বিপদ‘ থেকে উদ্ধার করতে গিয়ে নিজের পকেট থেকে লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ের কাহিনী বললেন গর্বভরে। আরো অনেক বিষয় উঠে এসেছিল এই নন–স্টপ আড্ডায়। এই আড্ডা শেষ হতোনা যদি না আড্ডায়, হইচইয়ে কিছুটা ক্লান্ত লিজা ভাবি টেবিল ভর্তি নানা পদের খাবারে অংশ নিতে না ডাকতেন। প্রতিবারের মত টেবিলে ছিল গো–মাংসের কালা ভুনা (অনেকে বলেন হালা ভুনা), সীমের বিচি, শুঁটকি দিয়ে তরকারি, লইট্যা, টেবিল–ভর্তি আরো অনেক মুখরোচক খাবার। ডাইনিং টেবিল শেষে আবারো সোফায় ফিরে আসা। ডেজার্ট খেতে খেতে চলে আবারো আড্ডা। আড্ডার বিষয়েরও অভাব নেই। হল্যান্ড থেকে আসা বেচারা ডাচ এরবান আড্ডার বিষয়বস্তু, ভাষা কোনোটাই না বুঝে কেবল তাকিয়ে থাকে যেন বাকযুদ্ধে অবতীর্ণ কয়েক বাঙালির দিকে। আর মাঝে মধ্যে বোকার মত শুকনো হাসির হাসার চেষ্টা করে। আড্ডা বুঝি আরো চলতো, যদি না লেখক গাত্রোত্থান করে আয়োজক ড. সেলিম চৌধুরীকে লক্ষ্য করে বলে উঠতো, ‘এবার তাহলে উঠতে হয়’। তখন রাত বার পেরিয়ে গেছে। নীরব খুলশী ভিআইপি এলাকা তখন আরো নীরব। সেলিম ভাই আমাদের নিয়ে নিচে নেমে আসেন মূল গেইট পর্যন্ত। বাইরে আমাদের বাহন অপেক্ষমান। ততক্ষণে বন্দর নগরীর অগোছাল রাস্তায় যানবাহনের ভীড় অনেকটা কমে এসেছে।
লেখক
সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট