হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ২ মার্চ, ২০২৪ at ৭:১২ পূর্বাহ্ণ

শুরু থেকেই বেশ টেনশনে ছিলাম। আমস্টারডাম থেকে ঢাকার পথে ট্রানজিট ইস্তানবুল, তুরস্কের রাজধানী। ইউরোপ আর এশিয়ার সংযোগস্থল ইস্তানবুল। দেড় কোটি লোকের বাস এই নগরীতে, যা গোটা দেশের জনসংখ্যার ১৫% ভাগ। ইস্তানবুলকে যদি ইউরোপীয় নগরী ধরি তাহলে বলতে হয় ইউরোপের মধ্যে এই নগরী হলো সব চাইতে বেশি জনবহুল নগরী, অন্যদিকে যদি একে এশীয় নগরী ধরি তাহলে বলতে হয় এশিয়ার সব চাইতে জনবহুল নগরী। নগরীর মত বড় এই ইস্তানবুল বিমানবন্দর। নূতন করে একে ঢেলে সাজানো হয়েছে। বড়সড় এই বিমানবন্দরে ঘন্টা দুয়েক সময়, ফ্লাইট বদল করার জন্যে। আমস্টারডাম থেকে আমাদের ফ্লাইট যখন এক ঘন্টা দেরিতে ছাড়লো তখন ধরে নিয়েছিলাম, কানেকটিং ফ্লাইট নির্ঘাত মিস। ফ্লাইট মিস হওয়া মানে লাগেজ সমস্যা। সময়মত পৌছুবে না। আমাদের ফ্লাইট ছাড়ার কথা আমস্টারডাম সময় দুপুর বারোটায়। বাসা থেকে এয়ারপোর্ট আসার পথে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। আমরা যাত্রী দুজন। আনএকমপেনিড লাগেজ অর্থাৎ পেছনে তিনটি বড় সাইজের ব্যাগ। চেকইন কাউন্টারে ওজনের সমস্যা হলো। ফলে সুমনাকে সেখানেই চকোলেট সহ কিছু লাগেজ বের করতে হলো। ভাগ্যিস সাথে আত্মজ অতীশ ছিল। সে এসেছিল আমাদের ড্রপ দিতে। তার হাতে গছিয়ে দেয়া হলো বাড়তি লাগেজ। শুরু হলো বিরক্তির পালা। নির্দিষ্ট সময়ে বোর্ডিং হলেও কোন ঘোষণা ছাড়াই যাত্রীদের প্লেনের ভেতর বসিয়ে রাখা হলো ঘন্টা খানেক। ওই সময়টুকুতে সার্ভ করা হলো না কোন ড্রিঙ্কস, টয়লেটে যাওয়া ছিল নিষেধ, টয়লেটের প্রবেশ মুখে জ্বলছে লাল বাতি। তার্কিশ এয়ারলাইনসসের এয়ার হোস্টেসদের আচরণও খুব একটা ‘বন্ধুসুলভ’ ছিল না। যেন দায়সারা গোছের। ততক্ষণে বাইরে বৃষ্টি থেমে গেছে। সূর্য দিয়েছে উঁকি। কবুতরের খুপরির মত প্লেনের জানালার পর্দাটা নিচে নামিয়ে দেই। পুরু কাচ ভেদ করে সূর্যের কড়া তাপ গায়ে এসে বিঁধছিল। অবশেষে অসুরের মত প্রচণ্ড শব্দে উড়াল দিলো উড়োজাহাজ। ঘন্টা খানেক আকাশে উড়াল দেবার পর সার্ভ করা হলো লাঞ্চ। তখন হল্যান্ডের সময় দুপুর দুটো। সার্ভডকরা খাবার আহামরি না হলেও খিদের কারণে ভালোই লাগলো। তার উপর গেল রাত একেবারে ঘুম হয়নি। সকাল সাতটায় উঠতে হবে, অথচ সকাল সাড়ে পাঁচটা অবধি দুচোখের পাতা এক করলেও ঘুম অধরাই থেকে যায়। অনেক কিছুর মত এই ঘুমও আমার কাছে অধরাই থেকে গেলো। অবশ্য তাতে খুব একটা অসুবিধে হয়নি। অসুবিধার শুরু একটু পর। আকাশবাহনের চালক দেরিহওয়া সময়টুকু অনেকটা ‘কাভার’ দিয়ে যখন আমাদের ইস্তানবুল পৌছিয়ে দিলো, তখন আমাদের হাতে কানেকটিং ফ্লাইটের সময় মাত্র এক ঘন্টা। প্লেন ইস্তানবুল টাচ করার পরও সম্পূর্ণ থামতে থামতে আরো অনেকটা সময় কেটে গেলো। তারপর নেমেই ভোঁদৌড়। শরীরে যতটুকু শক্তি আছে তাই নিয়ে সামনের দিকে এগুতে লাগলাম। ভাগ্যিস বাড়তি কোন চেক ছিলনা। গলা শুকিয়ে আসছিলো বারবার। বার কয়েক সাথে ক্যারি করা বোতল থেকে পানি খেয়ে আবার সামনের দিকে এগুনো। আমাদের লক্ষ্য ঢাকাগামী কানেকটিং ফ্লাইটের গেইট। ভাগ্য সুপ্রসন্ন। গেইট তখনও বন্ধ হয়নি। সেখানে থাকা কর্মচারীটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কি একটু দেখবে আমার সাথে আমার লাগেজ প্লেনে উঠেছে কিনা?’ সে কম্পিউটারে চোখ বুলিয়ে বললো, ‘তিনটা লাগেজ? হ্যাঁ, এসেছে।’ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কিন্তু বিধি বাম। কেন সে একটু পর বলছি।

আকাশ ভ্রমণে, সে যত দূরের কিংবা কাছের হোক, আমার আইল সিটচাই। তাতে মাঝপথে টয়লেট যেতে সুবিধে। বছর কয়েক ধরে সুমনাও এই সুবিধেটুকু ভোগ করা শুরু করে। ফলে যদি তিন কিংবা চার সিটের ‘রো’ হয় তাহলে আমরা দুজন দুই আইল সীটে। এর জন্যে প্রয়োজনে বাড়তি কড়ি গুনতে প্রস্তুত। কেবল দুসিটের ‘রো’ হলে পাশাপাশি বসা। প্লেনে উঠে দেখি আমার পাশে এক আধবয়সী মহিলা। অন্যদিকে সুমনার পাশে এক ভদ্রলোক। দুজনেই বাংলাদেশি। পরে জেনেছি মহিলা আসছেন ইতালি থেকে। সেখানেই স্থায়ীভাবে থাকেন। ছেলে থাকে দেশে, ছেলে ইতালিতে যেতে আগ্রহী নয়। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। মহিলা মাঝে মধ্যে একাই দেশে আসেন। বসুন্ধরাতে বাড়ি করেছেন। এই সব জেনেছি সুমনার কাছ থেকে। কেননা আমাকে পাশে দেখে টের পেলাম তিনি অস্বস্তি বোধ করছেন। সুমনাই প্রস্তাব করলো সিট বদলের। মহিলার অস্বস্তির কারণে, নাকি এই বেচারাকে পরমহিলার কাছ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা, জানিনে। যাই হোক, আমাদের সিট বদল হলো, (মালা বদল নয়) সুমনা গেল মহিলার পাশে, আমি অচেনা যাত্রীর পাশে। তিনি আসছেন কানাডা থেকে। কানাডা, আমেরিকা ইউরোপ থেকে যে সমস্ত ঢাকা গামী বাংলাদেশি যাত্রী, তাদের অনেকেই এই রুটটি বেছে নেন। তাতে সময়ের কিছুটা সাশ্রয় হয় বলে ধারণা। আমাদের জন্যে ভালো। হৈচৈ এড়ানো যায়। কেননা দুবাই হয়ে এলে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা বাংলাদেশী যাত্রীরা ফ্লাইটটিকে অনেকটা লোকালবাসে পরিণত করে। টয়লেটের দশা উড়াল দেবার খানিক বাদে পাবলিক টয়লেটে পরিণত হয়। ভেতরে এদিকওদিক পানি, প্রস্রাব, ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা টিস্যু পেপার। তারপর যেই না প্লেনের চাকা কেবল ঢাকা টাচ করলো, প্লেন দাঁড়ানোর অনেক আগেই তারা দাঁড়িয়ে পড়ে নিজ নিজ আসন থেকে। তাড়াহুড়ো করে ‘ওভারহেড বিন’ খুলে ব্যাগ নামিয়ে রাখার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। একদিকে শব্দ করে তাদের এই তাড়াহুড়া, অন্যদিকে বেচারা এয়ার হোস্টেসদের নিজ নিজ আসন থেকে গলা হাঁকিয়ে এই সমস্ত যাত্রীদের সিটে বসার অনুরোধ। এক পর্যায়ে অনুরোধ আদেশের পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায়। কিন্তু কে শোনে কার কথা। বাংলাদেশের এই সমস্ত ‘সোনার হরিণেরা’ ঘরে যাবার জন্যে অধৈর্য্য হয়ে উঠে। বিরক্তি লাগলেও আমার রাগ হয়না। লেখাপড়া কমজানা বা নাজানা এই সমস্ত খেটেখাওয়া শ্রমিকশ্রেণি আছে বলেই বাংলাদেশ আজ এই পর্যায়ে। মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের কিছু কিছু দেশে এক কামরায় দলাদলি করে থাকা এই সমস্ত বাংলাদেশি শ্রমিকদের পাঠানো ‘রেমিটেন্সে’ চলছে বাংলাদেশ। যখন রেমিটেন্স পাঠানো বন্ধ হয়ে যাবে বা ভয়ানক হারে তার পরিমান কমে যাবে, তখনই বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষ টের পাবে কী মূল্যবান সম্পদ এরা। বাংলাদেশ সরকার এদের সুন্দর, শ্রুতিমধুর একটি নাম দিয়েছে, ‘গোল্ডেন সন্স এন্ড ডটার্স’ অর্থাৎ ‘সোনার ছেলেমেয়ে’। ব্যাস, ওই পর্যন্ত! অথচ এরা দেশে এসে এয়ারপোর্টে হয়রানির শিকার হয়, অনেক সময় খোঁয়াতে হয় কষ্টার্জিত টাকায় নিকটজনের জন্যে কেনা উপহার সামগ্রী। অনেককে দেখা যায় বিমানবন্দরে নেমে লাগেজ গায়েব হওয়ার কারণে হাউমাউ করে কান্না করতে। সামপ্রতিক সময়ে পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। তবে আরো অনেক উদ্যোগ নেবার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করি। যেটি বেশি জরুরি তা হলো এদের ন্যায্য ও প্রাপ্য সম্মান।

যাই হোক, আকাশে আমরা। সময় কাটেনা। ঘুমও আসেনা। ভাবলাম সীটের স্ক্রিনে ফিল্ম দেখলে হয়তো কিছুটা সময় কেটে যাবে। কিন্তু যে তালিকা দেখলাম তাতে আকর্ষণীয় কিছু পেলাম না। ততক্ষণে ডিনার শেষ। আমার পাশে যে বাংলাদেশি যাত্রী ছিলেন তিনি বললেন, পেছনে অনেক সিট খালি, সেখানে যাই। শুয়ে শুয়ে যেতে পারবো। তাকে উৎসাহিত করলাম। কেননা উনি গেলে আমার সারির চারটি আসনই খালি হয়ে যাবে। হলো তাই। তা দেখে সুমনা দেরি করেনা। নিজের আসন ছেড়ে চলে আসে আমার পাশে, তারপর সোজা তিনটা সিট দখল করে গাটা এলিয়ে দেয়। বেশ কিছুক্ষণ সে আরামে ছিল, অনুমান করি কিছুটা ঘুমও পেয়েছিল। কিন্তু বিধি বাম। কথায় আছে– ‘ম্যান প্রোপোজেস, গড ডিসপোজেস’। শুরু হলো টার্বুলেন্স। প্লেনের লাল বাতির সংকেত জ্বলে উঠে, ককপিট থেকে পাইলটের সাবধানীবাণী, যাত্রীদের নিজ নিজ আসনে ফিরে যাবার অনুরোধ। টয়লেটের লাল বাতিও জ্বলে উঠে। ভেবেছিলাম, কয়েক মিনিটের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে। এই দীর্ঘ আকাশ পথ পাড়ি দেবার পথে বার কয়েক এমন ঝাঁকুনি হওয়াটা স্বাভাবিক। প্রায় ফিবার এমনটি ঘটে। কিন্তু দেখা গেলো এবারের ঝাঁকুনির তীব্রতা বাড়তে থাকে। সুমনা ধড়ফড় করে উঠে বেল্ট লাগায়। বোধকরি প্লেনের সমস্ত যাত্রী মনে মনে দোয়া দরুদ পড়তে থাকে। টার্বুলেন্স হয়, কিন্তু এত দীর্ঘ সময় ধরে, প্রায় আধ ঘন্টা পেরিয়ে গেছে, না কমাতে কিছুটা শংকিত হয়ে উঠি। তবে তার বহিঃপ্রকাশ যেন না ঘটে সেদিকে সচেষ্ট থাকি। আমার পাশের খালি সিটে তাড়াহুড়ো করে বসে পরা তরুণী এয়ার হোস্টেজের সাথে টুকটাক কথা শুরু করি। আতংক এড়ানোর জন্যে। তখন আমরা এশিয়ার আকাশে। সে দেখি স্ক্রিনে। সেই মুহূর্তে ভাবিএমনটি ঘটে, ঘটার সম্ভাবনা শতভাগ। তারপরও কেন প্রয়োজনে, কখনো বা অপ্রয়োজনে বা স্রেফ বেড়ানোর জন্যে এই দীর্ঘ আকাশ পথ পাড়ি দিয়ে, এতো ভয় নিয়ে দেশে আসার কোন অর্থ আছে কি? এমন ভাবনা কেবল এবার নয়। আগেও হয়েছে। কিন্তু দেশের টান, নিকটজনের টান, বন্ধুদের সংগ বোধকটি সব আতংক, ভয় ভুলিয়ে দেয়। এ যেন ঠিক মায়ের প্রসব যন্ত্রণার মত। প্রসব যন্ত্রনা কী যন্ত্রণাদায়ক সে আমি আমার দুই সন্তানের জন্মের সময় দেখেছি। ওদের নাড়ি কেটেছি আমি নিজ হাতে। আমার হাতে ডাচ ডাক্তার কাঁচি ধরিয়ে দিয়েছিলেন। প্রসব যন্ত্রণা এত কষ্টকর যে সে সময় অনেক মা মনে মনে বলেন, এরপর আর সন্তান নেবেন না। কিন্তু পরক্ষণেই সন্তানের মুখ দেখে মা ভুলে যান তার সীমাহীন কষ্টের কথা। আবারো প্রস্তুতি নেন পরবর্তী সন্তানের জন্যে। পৃথিবীর সমস্ত মায়ের জন্যে, এমন কী প্রাণীকুলের সমস্ত মায়ের প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা। যাই হোকঅবশেষে দীর্ঘ চল্লিশ মিনিট ঝড়ো আবহাওয়ার সাথে যুদ্ধ করে আমরা এসে পৌছুলাম দেশে। মনে মনে দেশের পড়ে ঠেকাই মাথা। তবে এখানেই শেষ নয় আমাদের এবারের যাত্রার ভোগান্তি। দেখা গেলো, পেছনের তিনটা বড় ব্যাগের দুটো এসে পৌঁছায়নি। সে লাগেজ দুটি পেলাম পরদিন সকালে। তারপর দুপুরে আকাশ পথে রওনা দিলাম চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। আমার বেড়েউঠার শহর। কেবল বেড়ে উঠা নয়, এই শহরেই আমার জন্ম, লেখাপড়া ও সাংবাদিকতার শুরু।

লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅটিজম শিশুর মা-বাবার ডিনাইল মুড বা অস্বীকারের ধাঁধা
পরবর্তী নিবন্ধমার্কিন নীতি পরিবর্তনে উন্নয়ন অংশীদারত্ব