শীত এলে কেবল দেশে নয় প্রবাসেও বাংলাদেশিদের মধ্যে পিঠা বানানোর হিড়িক পড়ে। তবে তা কেবল বাংলাদেশের বাঙালিদের মধ্যে সীমিত। ওপারের প্রবাসী বাঙালিরা এই ধরনের উৎসবের আয়োজন করেন না বলে জানি। বাংলাদেশিদের মধ্যে সপ্তাহ কয়েক ধরে এর বাড়ি, ওর বাড়ি– এমনি করে আয়োজন করা হয় পিঠার। তাতে কাছের জন, বন্ধুদের, পিঠা খাবারের নিমন্ত্রণ দেয়া হয়। পিঠার সাথে চলে গান–বাজনা, আড্ডা, টেবিল ভর্তি খাবার। সে প্রসঙ্গে বিস্তারিত একটু পর আসছি। তার আগে ফিরে যাই ফেলে আসা দিনগুলিতে, যখন শীতের সময় গ্রামে মামার বাড়ি যেতাম বেড়াতে ও পিঠা খেতে। তবে কেবল পিঠাই যে মামা বাড়ি যাবার একমাত্র আকর্ষণ তা মোটেও নয়। স্কুল–কলেজ ছুটি। কোথায় যাব? তখন তো আর আজকের মতো বাঙালিরা ঘর থেকে বাইরে বেরোনোর খুব একটা চিন্তা ভাবনা করতো না। তেমন সামর্থ্যও অনেকের ছিলনা। ফলে আমাদের ছুটিতে বেড়াতে যাওয়া মানে মামার বাড়ি যাওয়া। নিজ গ্রামের বাড়িতে খুব একটা যাওয়া হতোনা, এই কারণে সেই সময় আমার যে দুই জেঠা–জেঠিমা, তাদের সন্তানাদি ছিল তারা সবাই শহরে থাকতেন। গ্রামে থাকতেন কেবল বড় জেঠা ও জেঠিমা। তাদের কোন সন্তানাদি ছিল না। বড় জেঠা চাকরি করতেন রেলওয়েতে, অবসর নিয়ে চলে যান গ্রামে। মামার বাড়ি যখনই গেছি তখন কোন না কোন পিঠা খেতাম। সকাল, দুপুর, সন্ধ্যায়– খাবারের নির্দিষ্ট কোন সময় ছিলনা। রান্না ঘরে মাটিতে চাটাই পেতে তাতে বসে খেতাম। সামনে এক পাশে মাটির চুলা। গাছের পাতা, ডাল দিয়ে জ্বাল দিচ্ছেন মামী আর বানিয়ে চলেন পিঠা। বেশির ভাগ খেতাম ‘ভাপা পিঠা’, যা আমরা বলতাম ‘ধুঁয়া–পিডা’। খাঁটি খেজুর রস আর গরম–গরম পিঠা তার মজাই ছিল আলাদা। শহরে আমাদের বাসায় মাঝে মধ্যে মা বানাতেন ভাপা পিঠা। তবে সব সময় তার পক্ষে পিঠা বানানো সম্ভব হয়ে উঠতো না। বড় সংসার, এক হাতে সব সামলানো। তার ওপর পিঠার ব্যাপারে আমাদের ছয় ভাই দু বোনের সবার সমান উৎসাহ ছিলনা। আমার তো একেবারেই না। কেবল চিতই পিঠা (আমরা বলতাম চিতল পিঠা) ছিল আমার ফেভারিট। মজার ব্যাপার হলো, বাবার সরকারি বাসার সামনে বড় খোলা মাঠে, দরোজা থেকে হাত তিনেক দূরত্বে ছিল একটি বড় খেঁজুর গাছ। শীতকালে লুঙ্গি পড়া গাছ কাটার এক লোক আসতো। সেই কাটায় ছিল বিশেষ মুন্সিয়ানা। কোমড়ে রশি পেঁচিয়ে তরতর করে উঠে যেত ওই রসওয়ালা। রসওয়ালা বটে তবে রসিক ছিল কিনা জানা নেই। তার কোমরে রশির সাথে বাঁধা ধারালো ছুরি আর রসের হাঁড়ি। আমাদের খেঁজুর গাছটিও ছিল বেশ বাড়ন্ত। শীতকাল। আমরা পড়ছি। রাত দশটা/এগারোটা নাগাদ ভুপালকা গাছে উঠে খেঁজুরের হাঁড়িটি নামিয়ে আনতো। ততক্ষণে হাঁড়িটি রসে টইটুম্বুর। ভিন গ্রামের ছেলে ভুপাল আমাদের বাসায় অনেকদিন ধরে আছে। মাকে রান্না–বান্নায় সাহায্য করে। মাঝে মধ্যে বাজার–সাজারও। বুদ্ধি বয়স থেকে তাকে দেখে আসছি। তাকে ঠিক কাজের লোক হিসাবে ট্রিট করা হতোনা। কেবল আমরা যারা ছোট তারাই না, আমার বড়দেরও তাকে ‘ভূপালকা’ বলে ডাকতে শুনেছি। পরে বাবা তাকে তার অফিসে (পাকিস্তান রেলওয়ে) পিয়নের চাকরি দেন। যাই হোক, কলস খালি করে ভূপালকা তরতর করে আবার উঠে যেত খেঁজুর গাছে। কলসী ঠিক আগের জায়গায় রেখে নেমে আসতো। ভোর হবার আগেই সেই কলসি আবার পূর্ণ হয়ে উঠতো। সেই ফ্রেস খেঁজুর রস খাবার স্বাদ ছিল আলাদা। এখনো ভাবলে জিহ্বায় পানি আসে।
কোভিড শুরু হবার ঠিক আগে আগে গিয়েছিলাম শান্তিনিকেতন, কলকাতা থেকে গাড়ি ভাড়া করে। কাজোপলক্ষে আমার কিছু দেশ দেখার সৌভাগ্য হয়েছে, দেখা হয়েছে কিছু স্থান। কিন্তু শান্তিনিকেতন এর সব ছাড়িয়ে। অনেকে বলেন, শান্তিনিকেতনে এখন অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে। কবিগুরুর শান্তিনিকেতন এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু একটু নিবিষ্ঠমনে এদিক–ওদিক গেলে, হেঁটে বেড়ালে দেখা মেলে তার, কল্পনায়, যেন হাত দুটো পেছনে দিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে চলেছেন কবি গুরু ছায়া–ঘেরা শান্তিনিকেতনে। শান্তিনিকেতনের কাছেই সাঁওতালদের গ্রাম। দু–দিন পর ফিরে আসবো কলকাতায়। সুমনা জিদ ধরলো, সে খেঁজুর গাছের কাছাকাছি যাবে, হাত দিয়ে স্পর্শ করবে গাছ। গাড়ির ড্রাইভার বাঙালি। তাকে জিজ্ঞেস করতেই বলে, শান্তিনিকেতন থেকে বেরিয়ে ডান দিকে কিছুদূর গেলেই দেখা মিলবে খেজুর গাছের। ঠিক তাই। ‘ওই তো সারি সারি খেঁজুর গাছ, পুকুরের চারিধার’, সুমনা বলে উঠে। গাছগুলি উচ্চতায় এতো ছোট যে তাতে বসানো রসের হাঁড়ি হাত দিয়ে ছোঁয়া যায়। সুমনার উৎসাহের শেষ নেই। গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে যায় পুকুরের দিকে। ছবি তোলে। আমারও ভালো লাগে। আগে খেজুর গাছ দেখেছি। আমাদের বাসার সামনে নিজেদের একটি তো ছিলই, নিজ গ্রামের বড় পুকুরের দু–ধাঁরে ছিল বেশ কটি খেজুর গাছ। কিন্তু এতগুলি খেঁজুর গাছ পাশাপাশি গা–ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকতে আর কখনো দেখিনি, দেখতে ভালো লাগে। এক সময় তাড়া দেই গাড়িতে ফেরার। একটু দূর আসতেই দেখি পাকা রাস্তার ঠিক পাশে বড় কড়াইয়ে রস জ্বাল দিচ্ছে এক আধ বয়েসী মহিলা। তাতে তৈরি হচ্ছে খেঁজুর গুড়। একেবারে টাটকা, খাঁটি। মহিলার পাশে সাত–আট বছরের একটি হ্যাংলা–পাতলা ছেলে। সে তার মাকে সাহায্য করছে। মহিলার কাছে যে কটি দলা–পাকানো খেঁজুর গুড় ছিল তা সব কিনে নিলো সুমনা। সেই গুড় এলো বাংলাদেশ হয়ে হল্যান্ড এবং গেল সপ্তাহে যে পিঠা উৎসব হয়ে গেল সেখানে তার কিয়দাংশ এলো। আর সবাই ঝাঁপিয়ে পড়লো ঘরে বানানো সুমনার ভাপা পিঠার ওপর। এবার শুরু করা যাক পিঠা উৎসবের গল্প।
গেল সপ্তাহে হল্যান্ডে বাংলাদেশিদের অনেকেই মিলে বেশ ঘটা করে পিঠা উৎসবের আয়োজন করে। আয়োজন করা হয় জসিমউদ্দিন লিটনের বাসায়। গার্মেন্টস ব্যবসায়ী জসিমউদ্দিন লিটনের আদিবাস মিরসরাই। দুপুর থেকে হল্যান্ডের বিভিন্ন শহর থেকে বাঙালিরা বিশেষ করে মহিলারা হরেক পদের পিঠা নিজ ঘরে বানিয়ে সাথে নিয়ে আসে। সেদিনের দিনটি ছিল কিছুটা মেঘলা, তবে বৃষ্টি ছিলনা। পিঠা উৎসবে মহিলাদের উৎসাহের অন্ত নেই। পুরুষদের কিছুটা কম। মহিলাদের উৎসাহের পেছনে আর একটি বিষয় যা ‘ড্রাইভিং ফ্যাক্টর’ হিসাবে কাজ করেছে তা হলো, ফেইস বুক। ‘চেহারা বই’ (ফেইস বুক)-এ ছবি দেয়া চাই। গোটা পিঠা উৎসবে লক্ষ্য করলাম, পিঠা ভক্ষণের চাইতে তাদের মনোযোগ ছিল বেশি ফটো তোলায়। দল বেঁধে, স্বামী–স্ত্রী অনেকটা নিবিড় হয়ে দাঁড়িয়ে বা বসে, ছেলে–মেয়েদের সাথে নিয়ে, বিভিন্ন পোজ দিয়ে ছবি তোলার হিড়িক অনুষ্ঠান শুরুর আগ থেকে শেষ হওয়া তক। মহিলাদের পরনেও বাহারি পোশাক, নিজেকে সাজিয়েছে ফুল দিয়ে, হাতে মাথায়। তাদের স্বামীদের অনেকেই স্ত্রীর পোশাকের সাথে ম্যাচ করে পড়েছিলেন বিভিন্ন রঙের পাঞ্জাবি। তবে সে পথে পা দেননি মনজু, এরশাদ, তানজির, নাহিদ ভাই, জাহিদ ও লেখক। প্রাণবন্ত চাটগাঁর তরুণ মনজু বলে, ‘বাসা থেকে বের হবার আগে ‘আমার উনি’ আমাকে বলেছিল পাঞ্জাবি পড়তে। আমি রাজি হইনি। বলেছি, নো, তুমি জোর করলে উৎসবেই যাবনা‘। এক পর্যায়ে উৎসবে অংশগ্রহণকারীরা দু–ভাগে ভাগ হয়ে যায়। মহিলারা ড্রয়িং রুম তাদের দখলে নেয়, পুরুষরা ড্রয়িং রুম লাগোয়া কাচের দেয়াল ঘেরা একটি এক্সটেন্ডেড ড্রয়িং রুমে।
সেদিন এত পিঠা জড়ো করা হয়েছে যে স্থান সংকুলান হচ্ছিল না টেবিলে। হরেক রকমের পিঠা। দু–একটি বাদে বাকিগুলির নাম আমার অজানা। আমি চিনি কেবল ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা আর তেলে পিঠা। এই ব্যাপারে সাহায্য করলো সুমনা। যে পিঠাগুলি সাজানো ছিল তা হলো ভাপা পিঠা, মুখ পাকন পিঠা, কুলি পিঠা, পাটি সাপ্টা পিঠা, তেলের পিঠা, ডিমের ঝাল পিঠা, ফুল পিঠা, বিবিখানা পিঠা, ডিম সুন্দরী পিঠা, বাজ দুলালী পিঠা, মাংস পুলি পিঠা ইত্যাদি। চিতই পিঠা অনুপস্থিত। যার বানানোর কথা ছিল তিনি অসুস্থ বলে পরে জেনেছি, অথচ সেটিই আমার প্রিয় পিঠা। সেদিনের অনুষ্ঠানে কেবল যে পিঠা ছিল তা নয়, পাশাপাশি ছিল লবঙ্গ, পায়েশ, কেক, মাছের চপ, ডিমের কোর্মা, গোলাপ জাম, পুডিং, গুড়ের পায়েস ইত্যাদি। ডিনারের কথা তো বাদ দিলাম।
লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট