গেলবার লেখাটা সম্পূর্ণ ছাপার অক্ষরে বের হয়নি। বোধকরি স্থান সংকুলান না হবার কারণে। ভেবেছিলাম এই সপ্তাহে লেখাটা শেষ করা সম্ভব হবেনা। কেননা সপ্তাহ খানেকের জন্যে হল্যান্ড থেকে বাইরে আছি। দিন তিনেক আগে সুইজারল্যান্ড এসেছি দমাইগ্রেশনদ বিষয়ক এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে। আজ সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন। সম্মেলন শেষে সন্ধ্যায় রিসেপশন, তারপর ডিনার। ডিনার শেষে হোটেল যখন এসে পৌঁছি তখন ঘড়ির কাঁটায় রাত দশ। জেনেভা শহরের মধ্যেই আমার হোটেল। হোটেলে ক্রিস্টাল। তার আট তলায় আমার কামরা। কাল সকালে আবার দৌড়াতে হবে সম্মেলনে। কামরায় এসে একবার ভাবলাম রেস্ট নেই। পরক্ষণেই মন পরিবর্তন করি। মনে মনে বলি, বিকাশ, আলস্য ত্যাগ করো। সারাটা জীবন তো এই আলসেমী করে এসেছো। যার কারণে জীবনে অনেক কিছু খুইয়েছো। মুহূর্তে ল্যাপটপ খুলে লিখতে বসা। বলছিলাম কবি বন্ধু জাহিদুল হকের কথা। কত কথাই তো লিখতে ইচ্ছে করে। তার সাথে সময়ের বিচার্যে দীর্ঘ ৩২ বছরের পরিচয়, বন্ধুত্ব। দুজনের মাঝে বয়সের ব্যবধান কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি কখনো। আমাদের দুজনের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ছিল বরাবর। তার জীবনে অর্জন বলতে আমরা সাধারণ অর্থে যা বুঝি তা অনেক ছিল। কিন্তু কোনদিন তা নিজ থেকে ঘুণাক্ষরেও জানতে দেননি কিংবা ঘটা করে, ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রকাশ করেননি মৃদুভাষী ও বিনয়ী এই কবি বন্ধু। কোনদিন বলেননি “আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়” গানটির রচয়িতা তিনি। সে জেনেছি অনেক পর, তবে তার কাছ থেকে নয়। আগের সংখ্যায় লিখেছিলাম, জাহিদুল হক গীতিকার হতে চাননি। তিনি ছিলেন আপাদমস্তক একজন কবি। কবি হিসাবে তার গর্বও ছিল, সে টের পাই কবিতা নিয়ে তিনি যখন আলাপ করতেন। গান–লেখা প্রসঙ্গে মাহমুদ মানজুরকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “গান লিখতে চাইনি একেবারে। সামান্য যে কটি গান রচনা করেছি, সেগুলোর অন্যতম কৃতিত্ব সুরকার কমল দাসগুপ্ত, আব্দুল আহাদ এবং খন্দকার নুরুল আলমের। তারাই আমাকে কবিতা থেকে গানে আসতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তারা প্রায়ই বলতেন, ‘কী মিষ্টি তোমার কবিতা, তুমি আমাদের জন্য গান লেখো না কেন? আমাদের এক–দুটো গান লিখে দিলে কী হয়!’ আমি বলতাম, দগানের বাণীর যে অবস্থা–এমন পরিবেশে গান লেখার আগ্রহ পেতাম না। এরকম নাক সিটকানো বিষয় আমার মধ্যে কাজ করতো। এতেই কবি জাহিদুল হকের মধ্যে কবি হিসাবে যে প্রচ্ছন্ন গর্ব ছিল তা টের পাওয়া যেত। তার এই যে অহংবোধ তা আমরা টের পাই তার এক স্বীকারোত্তিতে। তার ভাষায়, দআমি রেডিওতে চাকরি করি তখন। প্রভাবশালী ছিলাম বলা যায়। কবি হিসেবেও তো কম নাম ছিলনা। যেখানে গাজী ভাই (গাজী মাজহারুল আনোয়ার) ২০ হাজার গান লিখে ফেললেন, সেই হিসাবে তো আমার গান এক–দুই হাজারের কম হওয়ার কথা না। অথচ আমার গানের সংখ্যা সব মিলিয়ে শদখানেক হবে। তবে এসব নিয়ে আমার আফসোস নেই, বরং অহংকার আছে। কারণ গানের কবিতাকে সমৃদ্ধ করতে পেরেছি।দ জাহিদ ভাইয়ের সমসাময়িক কবিদের মধ্যে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান, গাজী মাজহারুল আনোয়ার ইত্যাদি।
লক্ষ্য করেছি বিদেশী সাহিত্যের প্রতি ছিল তার প্রচণ্ড আগ্রহ, ঝোঁক। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন কবি জাহিদুল হক। তার ভাষায়, ‘ইংরেজি সাহিত্যে পড়েছি বটে। অথচ শৈশবেই বাবার কাছ থেকে সেক্সপিয়র শিখে ফেলেছি মুখে মুখে। আমার বাবা অসম্ভব শিক্ষিত ছিলেন। চিকিৎসক ছিলেন রেলওয়ে হাসপাতালে।’ একবার বলেছিলেন, দুজনে মিলে ডাচ কবিতার বাংলা অনুবাদ বের করবেন। করবো করবো করে আর করা হয়নি। অনেকটা আমার আলসেমির কারণে। মনে পড়ে একবার আমার লেখা দীর্ঘ এক গল্প উনি দেখে দিযেছিলেন। লেখাটা যখন ফেরত পাঠালেন তখন তার ওপর একটু অভিমান হয়েছিল। দেখলাম কয়েকটি বানান আর একটা–দুটো জায়গায় সামান্য বদল ছাড়া কিছুই করেননি। ধরে নিয়েছিলাম, তেমন গুরুত্ব নিয়ে দেখেননি। ফোনে এই নিয়ে অনুযোগ করলে তিনি বলেন, দনা, পরিবর্তন করার কোন প্রয়োজন মনে করিনি।দ গল্পটি পরবর্তীতে আমার এক বইয়ে ঠাঁই পেয়েছিল। যাই হোক, জাহিদ ভাই বৈষয়িক একেবারেই ছিলেন না, ছিলেন অনেকটা বোহেমিয়ান টাইপের। সংসারও ঠিক মত করতে পারেননি। ভাই বোনদের সাথে নিয়ে ঢাকার বুকে পৈতৃক সূত্রে পাওয়া নিজেদের বাড়ীতে থাকতেন তিনি। সে বাড়ির নাম রেখেছিলেন, দশান্তিনিকেতন। সঠিক জানিনে তবে অনুমান করি নামটি তার দেয়া। তিনি ছিলেন রবীন্দ্র–ভক্ত। বাড়িটি নতুন করে তৈরি করতে তাকে বেশ ধার–দেনা করতে হয়েছিল। বিয়ের কথা বললে তেমন সদুত্তর পেতাম না। অথচ তিনি ছিলেন ভীষণ রোমান্টিক। তার কথায়, গানে, লেখায়, আচরণে টের পেতাম। অনেক বছর পর, যখন সাধারণ অর্থে আমরা যাকে বলি বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেছে সেই সময় ২০১৭ সালে তিনি বিয়ে করলেন। রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ছিলেন তার স্ত্রী রেবেকা সুলতানা। দুর্ভাগ্য বিয়ের পর পর তার স্ত্রী স্ট্রোক করেন এবং বিয়ের চার বছরের মাথায় তিনি মারা যান। বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়া এই কবি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘দুটো বাকি– একুশে আর স্বাধীনতা পদক। এগুলো আমি পাবো বিশ্বাস আছে। সমস্যা হচ্ছে আমিতো এগুলো পেতে যা যা করা লাগে কিংবা মানুষ করে, সে সব করতে পারি না। পরিতাপের বিষয় এই যে– এরমধ্যে যারা পেয়েছে তাদের অনেকেই এত নিম্নমানের লোকজন, যাদের নাম উল্লেখ করতে লজ্জা হয় আমার।” বড্ড অভিমানী ছিলেন জাহিদ ভাই, সবার কবি জাহিদুল হক। তিনি গল্প উপন্যাসসহ মোট ১৮টি বই লিখেছেন। আমাকে ও সুমনাকে অটোগ্রাফসহ তার লেখা কবিতার বই ‘তোমার হোমার‘ উপহার দিয়েছিলেন। দেশে ফিরে গিয়ে প্রায়শ ফোন করতেন। খুব ইচ্ছে ছিল আবার ইউরোপ আসবেন। সে ইচ্ছে আর পূরণ হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের স্নাতকোত্তর জাহিদুল হক ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। এই প্রসঙ্গে কিছু বলতে গেলে আমাকে ফিরে যেতে হয় মাহমুদ মানজারের লেখায়। তাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে কবি জাহিদুল হক বলেছিলেন, “১৯৭১–এর ১৮ জানুয়ারি যোগ দেই ঢাকা কেন্দ্রে। ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। তখন শাহবাগ কেন্দ্রের অফিসার ইনচার্জ ছিলাম। এটা তখন বিশাল বিষয়। অনেক ক্ষমতাধর। আমরা পরিকল্পনা করলাম বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি সমপ্রচার করবো। সব প্রস্তুত। কিন্তু শেষ মুহূর্তে করাচি থেকে বার্তা এলো ভাষণ প্রচার করা যাবে না। তাদের ভয় ছিল, বঙ্গবন্ধু যদি স্বাধীনতার ঘোষণা করে দেন! আমার তো মাথায় আগুন। ভাষণ প্রচারে বাধা আসায় আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, ঢাকা কেন্দ্র বন্ধ করে দেবো। আমি আর আশফাকুর রহমান খান, আমার সিনিয়র। চমৎকার মানুষ ছিলেন। তাকে নিয়ে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিলাম, চলো রেডিও বন্ধ করে দেই। সবাই তখনই মাস্টার কন্ট্রোল রুমে (এমসিআর) গেলাম। সন্ধ্যা ছয়টা–সাড়ে ছয়টা হবে। সেখানে গিয়ে একে অপরের হাতে হাত রেখে স্টেশন সুইচ অফ করে দিলাম। বঙ্গবন্ধু নিজেই তো সেদিন বললেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি…’। সেই মন্ত্র বলেই বন্ধ করে বেরিয়ে পড়লাম। এই কাজের মাধ্যমে আমিই তো স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করেছিলাম। এর আগে তো যুদ্ধটা শুরু হয়নি। এই গৌরব আমি করতেই চাই। এটা আমার আত্মজীবনীতেও লিখবো। আমি সহ সেদিন আরও যারা সহকর্মী ছিলেন, সবাই মিলেই মুক্তির যুদ্ধটা শুরু করেছি বেতার থেকে। পরদিন অবশ্য, সচিব–মন্ত্রী–সামরিক বাহিনী পর্যন্ত গড়ালো বিষয়টি। এরপর সিদ্ধান্ত হলো, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বেতার সমপ্রচার করবে। আমাদের আশ্বস্ত করলো। আমরা পরদিন আবারও কাজে ফিরলাম।” আমার ধারণা তিনি তার এই আত্মজীবনী লিখে যেতে পারেননি। সালাম জানাই এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে, শ্রদ্ধা জানাই ভাবুক ও আগাগোড়া এক প্রেমিক কবি বন্ধু জাহিদুল হককে।
লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট