হল্যান্ড থেকে

শ্রদ্ধাঞ্জলি : রোমান্টিক ও ভাবুক কবি বন্ধু জাহিদুল হক

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ২০ জানুয়ারি, ২০২৪ at ১০:৩৫ পূর্বাহ্ণ

আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয় তবু কেন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়,

কখনো নদীর মত তোমার পথের পানে বয়ে বয়ে যায়।

আমি তো বাগান নই, তবু কেন ফোঁটে ফুল,

ফাগুনের তীরে আসে ভ্রমরের মতো হুল’

কালজয়ী এই গানটির রচয়িতা কবি জাহিদুল হক। তিনি আর নেই। গত ১৫ জানুয়ারি অনেকটা হঠাৎ করে চলে গেলেন, চিরদিনের তরে। কত সুখকর স্মৃতি তার সাথে, জার্মানির কোলন শহরে তার বাসায়, জার্মান রেডিও ডয়েচে ভেলে অফিসে, জার্মানি ও হল্যান্ডের বিভিন্ন স্থানে একসাথে ঘুরে বেড়ানো, আমার বাসায় দিন কয়েক রাতভর ধুমসে আড্ডা দেয়া, আমাদের ড্রয়িং রুমের সোফায় শুয়ে তার পুরানো দিনের বাংলা সিনেমা দেখা। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, পুরানো দিনের ছবি দেখতে ভালো লাগে? ‘নষ্টালজিক বলতে পারেন। ফেলে আসা দিনগুলিতে নিয়ে যায়, সেদিনকার কত স্মৃতি’, উত্তরে বলেন মৃদুভাষী জাহিদ ভাই। মুক্তিযোদ্ধা জাহিদুল হক কেবল দেশের প্রথম সারির কবি ছিলেন না, ছিলেন সাংবাদিক, কথা সাহিত্যিক, গীতিকার, সরকারি কর্মকর্তা (বাংলাদেশ বেতারের উপ পরিচালক)। তার কবিপরিচয়কে ছাড়িয়ে যে গান (আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয় তবু কেন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়) তাকে গীতিকার হিসাবে অমর করে রেখেছে, সেটি তার লেখার কথা ছিলনা। তিনি চাননি গীতিকারখ্যাতি তার কবিখ্যাতিকে ছাড়িয়ে যায়। তিনি ছিলেন আগাগোড়া এক রোমান্টিক কবি। তার মাঝে যে রোমান্টিসিজম সেটি তার সাথে আড্ডায় বসলে টের পাওয়া যেত। এই অমর অজেয় গানটি রচনা থেকে শুরু করে ১৯৮৫ সালে মুক্তি পাওয়া বুলবুল আহমদের জনপ্রিয় ‘মহানায়ক’ ছায়াছবিতে এই গানকে সংযোগ করার পেছনে রয়েছে মজার কাহিনী। সেই কাহিনী আমার এদ্দিন জানা ছিলনা। কানাডায় বসবাসরত আমার সহকর্মী (বাংলাদেশ টাইমস) সাংবাদিক বন্ধু সৈকত রুশদী ফেইস বুকে জাহিদ ভাইকে নিয়ে একটি পোস্ট দিয়েছেন। তাতে তিনি ২০২৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ‘বাংলা ট্রিবিউনে’ কবি জাহিদুল হকের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে মাহমুদ মানজুরের একটি লেখা যোগ করেছেন। তাতে জানতে পারি এই গান তৈরির পেছনের কাহিনী। কাহিনীটি এতই মজাদার যে পাঠকদের জন্যে তা ভাগাভাগি না করে পারলাম না।

‘“একদিন সকালবেলা শেখ সাদী খান (সুরকার) এসে বললেন, ‘আপনার লেখা একটা গান চাই। আমার জন্য তো বটেই, বিশেষ করে একজন নতুন শিল্পীর জন্য। তিনি মূলত নজরুল গীতির শিল্পী। আমাদের সিলেট বেতার কেন্দ্রের। নাম সুবীর নন্দী। তার খুব ইচ্ছা, আপনার লেখা একটি গান গাওয়ার।’ সাদীর কাছে জানতে চাইলাম, ‘আমি কি সেই শিল্পীর কণ্ঠে একটা গান শুনতে পারি?’ সাদী বললেন, ‘হ্যাঁ, সুবীর ঢাকায় এসেছে। কালই আমি নিয়ে আসবো।’ তিনি নিয়ে এলেন। শাহবাগ বেতার অফিসে, আমার রুমে। স্টুডিও থেকে হারমোনিয়াম এনে দিলাম। একটি নজরুল আর আধুনিক গান শোনালেন তরুণ সুবীর। পরে আরেকটি নজরুল শোনাতে বললাম। শোনালেন। ভারী মিষ্টি কণ্ঠ। মুগ্ধ হলাম। এটা ১৯৭৭ সালের কথা। গান শুনে বললাম, আমি গান দেবো।’ তারপর আমার খাতার ওই কবিতা থেকে প্রথম দুটি স্তবক ধরে গানটি সাজালাম। মাসখানেক লাগলো গানটি তৈরিতে। খুব খুঁতখুঁতে ছিলাম এসব বিষয়ে। লিখি ঠিকই, কিন্তু পছন্দ হয় না। সুর করলে পছন্দ হয় না। রেকর্ডিং পছন্দ হয় না। এই গানটি করেছি বাংলাদেশ বেতারের ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসের জন্য। গানটির প্রথম সুর শোনালো সাদী, পছন্দ হলো না। আবার করলো, পছন্দ হলো। সাদী অসম্ভব প্রতিভাবান, এতে সন্দেহ নাই। তারপর ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসে গানটি রেকর্ড হলো ১৯৭৮ সালে। তখন রেডিওর স্টুডিওতে অনেক চাপ ছিল। প্রচুর কাজ হতো। শিডিউল পাওয়া কঠিন ছিল। সেই হিসেবে গানটি লেখা থেকে রেকর্ড পর্যন্ত একবছর সময় লাগলো।”

এরপর গানটি কী করে রেডিও থেকে সিনেমায় এলো তার বর্ণনা দিয়েছেন কবি জাহিদুল হক ওই সাক্ষাৎকারে। তিনি বলেন, “১৯৭১ সাল থেকে আমি রেডিওতে কর্মরত। নায়ক বুলবুল আহমেদ তখন প্রায়ই রেডিওতে আসতেন। দারুণ কণ্ঠ ছিল তার। আবৃত্তি করতেন। আমার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন। তিনি এমন একটি অনুষ্ঠানে এসে আমাকে বললেন, ‘জাহিদ আমি তো একটা সিনেমা করছি। নাম ‘মহানায়ক’। ছবিটার জন্য এই গানটা দরকার।’ আমি একটু অবাক হলাম। রেডিওর পুরানো গানও সিনেমায় ব্যবহার করে কেউ! জানতে চাইলাম, গানটি আপনার ভালো লেগেছে? বুলবুল বললেন, ‘ভালো লেগেছে মানে! আপনি যদি অনুমতি না দেন, তাহলে আমার ভীষণ মন খারাপ হবে।’ তার আগ্রহ দেখে আর না করলাম না। এরপর তিনি গানটি আবারও রেকর্ড করান। কলকাতায় নিয়ে যান শিল্পীসুরকারকে। সাদী সুর ঠিক রেখেই সুবীর নন্দীকে দিয়ে আবারও রেকর্ড করেন গানটি। এরপর সেটি সিনেমায় যায়।” এরপর জাহিদুল হক সিনেমা থেকে গান লেখার অনেক অনুরোধ পেয়েছেন। কিন্তু বেশির ভাগ অনুরোধ তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন বলে জানা যায়। তার কথা হলো, ১গান হতে হবে কাব্যময়। গান হতে হবে দৃশ্যের সূত্র ধরে। গানের ক্ষেত্রে আগে লিরিক হতে হবে, পরে সুর। কেউ সুর করে আনলে তাতে লিরিক বসাতে পারবো না। আর আমার লিরিকে হাত দেওয়া যাবে না। যা দেবো সেটাই রাখতে হবে। এসব শর্ত অনেকেই মেনে নিতে পারেনি। ফলে অনেক গানই করিনি বা করতে পারিনি।”

জাহিদ ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয়, পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব সময়ের বিচার্যে প্রায় ৩২ বছর। তখন আমি হল্যান্ডে সদ্য এসেছি (১৯৯০)। তিনি সে সময় জার্মানির কোলন শহরে ডয়েচে ভেলেতে বাংলা বিভাগে সম্পাদকীয় দায়িত্বে আছেন। আমাদের দুজনের আর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সাংবাদিক ও টিভি ব্যক্তিত্ব, লেখক মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর তার সাথে আমার যোগাযোগ ঘটিয়ে দিয়েছিলেন। ঢাকায় ১৯৮৪১৯৮৭ সাল এই তিন বছর ঢাকায় সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশএ পাশাপাশি দুটো কামরায় বসে এক সাথে কাজ করেছি। এরপর ঢাকায় বাংলাদেশ টাইমসসে যোগ দিলেও জাহাঙ্গীর ভাইয়ের সাথে নিত্য যোগাযোগ ছিল। মূলত লেখালেখির কারণে। যাই হোক, ঠিক হলো, কোলন যাব বেড়াতে। সাথে সহধর্মিনী সুমনা। জাহিদ ভাইয়ের সাথে তখনও আমার সম্মুখ সাক্ষাৎ হয়নি। তিনি দেখতে কেমন তাও জানা ছিলনা, তার কোন ছবিও দেখিনি। ল্যান্ড ফোনে (তখন মোবাইল ফোন ছিল না) কথা হলো। বললেন, তিনি কোলন সেন্ট্রাল রেলওয়ে স্টেশনে অপেক্ষা করবেন। এখনো মনে আছে, দিনটি ছিল মেঘলা। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছিলো। রেল স্টেশনে নেমে এদিকওদিক তাকাই। দেখি একটু দূরে বেঁটেখাটো শ্যামলা বর্ণের এক লোক দাঁড়িয়ে, গায়ে গরম ওভারকোট। হাতে ছাতা। হাত বাড়িয়ে শুভেচ্ছা বিনিময়, বললেন, ‘আমাদের একটু হেঁটে যেতে হবে, ধারেকাছেই বাসা।’ প্রথম দেখাতেই মনে হলো অনেক দিনের চেনাজানা। চলতে চলতে কথাবার্তা হয়, জাহাঙ্গীর ভাইয়ের কথা উঠে আসে। ছোটখাট স্টুডিও টাইপের বাসা। সুমনা ব্যাগ থেকে বের করে জাহিদ ভাইয়ের জন্যে ‘সারপ্রাইজ’বাংলাদেশের ইলিশ মাছ। ইলিশ দেখে জাহিদ ভাই কী খুশীই না হয়েছিলেন। কেননা সে সময় ইউরোপে খুব একটা বাংলাদেশী দোকান ছিলনা। হল্যান্ডেও না। আমরা সে সময় বেলজিয়ামে তনু মিয়ার দোকান থেকে বাংলাদেশী সবজি, মাছ ইত্যাদি কিনতাম। এই ইলিশ মাছ বেলজিয়াম থেকে হল্যান্ড হয়ে অবশেষে এলো জার্মানির কোলন শহরে। একেবারে ডাইনিং টেবিলে। সুমনা সে সন্ধ্যেয় লেগে গেলো ইলিশ রান্নায়। আড্ডা আর গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিঝরা সন্ধ্যায় ভাতের সাথে ইলিশদুটোই ছিল এক কথাটা অপূর্ব। দিন কয়েক ছিলাম জাহিদ ভাইয়ের বাসায়। একদিন তার সাথে গেলাম ডয়েচে ভেলে অফিসে। ঘুরে ঘুরে দেখালেন। এক বিকেলে রাইন নদীর পাড় ধরে আমরা তিনজন হাঁটছি, লক্ষ্যহীন। কিছুদূর যেতেই এক ইউরোপীয় ভিক্ষুক হাত পেতে কিছু চাইলো। আমরা তাকে পাশ কেটে সামনের দিকে হেঁটে চলি। হঠাৎ জাহিদ ভাই কিছু না বলে পিছু ফিরে লোকটির দিকে দৌড় দিলো। আমরা কিছু বুঝে উঠার আগেই তিনি ফিরে এসে বিজয়ের হাসি হেসে বললেন, ‘ওই ব্যাটাকে কয়েকটা জার্মান কয়েন দিলাম। ভালো লাগছে এই ভেবে যে আমি এক ইউরোপীয়কে ভিক্ষা দিলাম।’ আমাদের কোলন যাবার কিছুদিন পর তিনি এলেন হল্যান্ড। বার কয়েক এসেছিলেন। প্রতিবারই দিন কয়েক থেকেছিলেন। উইকডেতে দিনের বেলায় তাকে বাসায় একা থাকতে হতো। তিনি তখন ড্রয়িং রুমের সোফায় হেলান দিয়ে শুয়ে শুয়ে পুরানো দিনের বাংলা ছায়াছবি দেখতেন। অন্য সময় আমরা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম। পরবর্তীতে সমাপ্য।

লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমরা কীসে ভয় করি?
পরবর্তী নিবন্ধপ্রযুক্তির শিক্ষা-শিক্ষায় প্রযুক্তি : চট্টগ্রাম বিজিএমইএ এর উদ্যোগ