হল্যান্ডে প্রতি বছর ইংরেজি নতুন বছরকে ঘিরে উৎসবের নামে সন্ধ্যা থেকে ভোর রাত অবধি যে ঘটনা–দুর্ঘটনাগুলি ঘটে থাকে, তাকে স্রেফ উচ্ছৃঙ্খলতা ও অসভ্যতা ছাড়া আর কোন নামেই আখ্যায়িত করা যায়না। এক শ্রেণি অতি উৎসাহী নাগরিক, বিশেষ করে তরুণ শ্রেণির কাছে নতুন বছর উদযাপন মানে রাস্তা ও বাড়ির সামনে পার্ক করা গাড়িগুলি জ্বালিয়ে দেয়া, বাড়ির দরোজায় চিঠি–বাক্সের ফাঁক দিয়ে বাড়ির ভেতর জ্বলন্ত বাজি ছুঁড়ে মারা, টহলদার পুলিশকে কোন উস্কানি ছাড়াই আক্রমণ করা, তাদের প্রতি জ্বলন্ত বাজি ছুঁড়ে মারা, সরকারি নিষেধ সত্বেও নির্দিষ্ট সময়ের আগে কান–ফাটা– শব্দে বাজি পোড়ানো, হইচই করে চলমান গাড়ির দিকে বাজি ছুঁড়ে মারা, মাতাল হওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। এ বছরও এর কোন ব্যতিক্রম ঘটেনি। বাজি পোড়াতে গিয়ে এ বছর উত্তর সাগর পাড়ের এই দেশটিতে মারা গেছে দুই জন, চোখে বাজির আঘাতে হত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে ১৮ জন, এছাড়া ছোটখাট দুর্ঘটনা তো ঘটেছে যা অজানা রয়ে গেছে। হারলেম শহরে বাজির কারণে ১৯ বছরের এক তরুণ মৃত্যুবরণ করে। পরদিন শনিবার ২৬ বছরের আর এক তরুণ বাজি পোড়াতে গিয়ে মারা যায়। দেনবস নামক আর এক শহরে বাড়ির বেলকনিতে মারাত্মক ভাবে আহত হয়েছে ২–বছরের এক শিশু। বিভিন্ন শহরের হাসপাতালগুলিকে সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ব্যস্ত থাকতে হয়েছে বাজিতে আহতদের চিকিৎসা ও দেখভাল করার জন্যে। পুলিশদের ব্যস্ততা ছিল বছরের অন্য সময়ের চাইতে অনেক বেশি। বিশেষ করে রাজধানী আমস্টারডাম, হেগ, খেলডারল্যান্ড, হেডেল শহরে পুলিশের উপর আক্রমণ হয়েছে সব চাইতে বেশি। নতুন বছর এলেই পুলিশদের বাড়তি মাথাব্যথা ও সতর্কতা অবস্থান। গাড়ি ভাঙচুর, গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়া, রাস্তা ও বাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ি ও দর্শকদের দিকে বাজি ছুঁড়ে মারার কারণে পুলিশ ২০০ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে। কয়েক ডজন পুলিশ সদস্যও এই সমস্ত অতি উৎসাহীদের আক্রমণে আহত হয়েছেন বলে জানা যায়। কাপেলা আন দ্য আইজেল নামক এক শহরে গুলিতে নিহত হয়েছে এক ব্যক্তি। এক অনুষ্ঠানে কথা কাটাকাটির পরিপ্রেক্ষিতে এই ঘটনা ঘটে। ডাচ পুলিশ সমন্বয়কারী পেইয়ি দ্য মেইজ বলেন, ‘নতুন বছর উদযাপন সবার জন্যে। কিন্তু কোন কোন এলাকায় যারা শান্তিপূর্ণ ভাবে নতুন বছরকে উদযাপন করছিলেন তাদের দিকে বাঁজি ছুঁড়ে মারা হয়েছে। ফি–বছর এই সমস্ত অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটে বিধায় আমস্টারডাম, রটরডাম এবং আইন্দহোভেন সহ মোট ১৬টি শহরে নতুন বছর উদযাপন মুহূর্তে বাজি পোড়ানো নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু সেই নিষেধ অনেকেই মানে নি।’ উদেন নামে আর একটি শহরে ১৭ বছরের এক তরুণ ১ জানুয়ারির ভোরে বাজি ফোঁটাতে গিয়ে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। তার মানে বাজি পোড়ানোর মচ্ছব জিরো–আওয়ারে সীমাবদ্ধ থাকেনি। এক জরিপে দেখা গেছে, শিশুরা বাজি পুড়িয়ে নতুন বর্ষ উদযাপনকে ‘না’ বলছে। তাদের মতে, বিকট শব্দ তাদের ভীতির কারণ এবং পত্র–পত্রিকা ও টেলিভিশন নিউজে যে সমস্ত দুর্ঘটনার সংবাদ দেখা যায় তা তাদের এইভাবে নতুন বছরকে উদযাপন করা থেকে নিরুৎসাহিত করে তুলে। বাজির কারণে যে হারে ফি–বছর চোখে আঘাতপ্রাপ্ত হয়, চোখ হারায়, তাকে হল্যান্ডের চক্ষু হাসপাতালের এক ডাক্তার ‘ওল্ড ফ্যাশনড হরর নাইট’ বা ‘পুরাতন দিনের ভৌতিক রাত’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। ফারা নামের এক মহিলা সামাজিক মিডিয়ায় এই বলে মন্তব্য করেছেন, ‘সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত এই ব্যাপারে সিরিয়াস ব্যবস্থা নেয়া। আমার ছেলে–মেয়েরা নতুন বছর উদযাপনকে ঘৃণা করতে শুরু করেছে। তারা রাতে শুতে পারে না। কেন না পরদিন তারা বাজির কারণে ঘটা ভয়াবহ দুর্ঘটনার সংবাদগুলি জানতে পারে। আমার মনে হয় এটি ‘আউট অফ কন্ট্রোল’। ছোটছোট ছেলেমেয়েরা আহত হচ্ছে, মানুষ মারা যাচ্ছে। এটি আর কোনভাবেই আনন্দের মধ্যে থাকছে না।’
তারপরও ইংরেজি নববর্ষ উদযাপিত হয়েছে হল্যান্ডের প্রায় প্রতিঘরে নিকটজন, বন্ধু–বান্ধব, আত্মীয়–স্বজনদের ঘিরে। এর আগে ডিসেম্বর আগমনের সাথে সাথে খ্রিস্টান ধর্মালম্বিদের বড়দিন ‘ক্রিস্টমাস’ ঘিরে গোটা দেশ, শপিং মল, শপিং সেন্টার আলোয় আলোয় নেচে উঠেছিল। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে প্রায় বাড়ি, বাগান বাড়তি আলোয় সাজানো হয়েছিল। উৎসবের আমেজ চলতে থাকে ডিসেম্বর থেকে শুরু করে নতুন বছরকে আহবান করার শেষ মুহূর্ত পর্যন্তু। হল্যান্ডের বিভিন্ন শহরে বসবাসকারী বাংলাদেশিরা নতুন বছরকে আহবান জানায় দল বেঁধে বাজি পুড়িয়ে, টেবিল ভর্তি খাবার আর রাতভর আড্ডা দিয়ে। তারা একে অন্যকে দেয় নতুন বছরের উপহার। গোটা দিন ছিল ঝিরঝির পড়া বৃষ্টি। সাথে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। কিন্তু কোনকিছুই দিনটি উদযাপনে বাধা হতে পারেনি। মানুষের পাগলামিরও শেষ নেই। হল্যান্ডে ‘নিউ ইয়ার্স ডাইভ‘ বলে একটি বড় উৎসব আছে। বরফ–ঠাণ্ডা সমুদ্রের পানিতে ১ জানুয়ারি ভোরবেলায় খালি গায়ে দল বেঁধে ডুব দেয়া। প্রতি বছর এটি পালন করা হয় ঘটা করে। হল্যান্ডের বিভিন্ন শহরে যেখানে সমুদ্র বা নদী আছে সেখানে নারী–পুরুষ, শিশু–কিশোর, সকল বয়েসী লোকজন দল বেঁধে হইচই করতে করতে দৌড় দেয় সমুদ্রের দিকে, ডুব দেয় জলে, তারপর ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে ফিরে আসে সৈকতে। সেখানে তাদের জন্যে ব্যবস্থা থাকে গরম স্যুপ, কফির। ১৯৬০ সালে সান্ডভোর্ট নামক একটি শহরে এই ‘নিউ ইয়ার্স ডাইভ’–এর শুরু। সবচাইতে দর্শনীয় সমুদ্রে ডুব দেয়ার অনুষ্ঠান হয়ে থাকে হেগ শহরের উত্তর সাগর পাড়ে স্কাইভেনিংএন এর সী–বীচে। প্রায় ১০ হাজার লোক এতে অংশ গ্রহণ করে থাকে। এছাড়া ফ্লেভল্যান্ড, সেইল্যান্ড এলাকায় আয়োজন করা হয়ে থাকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে সমুদ্রে ঝাঁপ দেয়া।
এমনি মুহূর্তে সব চাইতে খাবার লাগার বিষয় হলো– গোটা বিশ্ব যখন এই দিনটিকে, এই মুহূর্তকে ঘিরে উৎসবে মেতে, তখন নিজ বাড়ি, নিজ স্থানচ্যুত সদ্য জন্ম নেয়া শিশু থেকে শুরু করে লক্ষ লক্ষ সকল বয়েসী প্যালেস্টাইনী জীবনের অনিশ্চয়তা নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছিল খোলা আকাশের নিচে। এই লেখায় উল্লেখ করেছিলাম হল্যান্ডে এক মহিলার কথা, যিনি বাজির শব্দে বিরক্ত হয়ে বলছেন, বাজির শব্দে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ভীত ও আতঙ্কগ্রস্ত। এতো কেবল শব্দ! কী দশা সেই সব লক্ষ লক্ষ শিশুদের যারা প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত এর চাইতে ভয়াবহ বোমার শব্দের মধ্যে দিয়ে চলেছে। আমরা কি একবারও তাদের কথা ভেবেছি নতুন বছরকে উদযাপন করতে গিয়ে? না, করিনি। করলেও সে ক্ষণিকের তরে। মানুষ বুঝি মানুষের তরে নয়। প্রচণ্ড হতাশা আর ক্ষোভ থেকে এই ধরনের কথা বের হয়। তারপরও বলি, ইংরেজি নতুন বছর সবার জীবনে আনন্দ, সুখ, সাফল্য বয়ে আনুক। কবিগুরুর লেখা দিয়েই শেষ করি আজকের এই লেখা–
‘বন্ধু হও, শত্রু হও, / যেখানে যে কেহ রও,/ ক্ষমা করো আজিকার মতো / পুরাতন বরষের সাথে পুরাতন অপরাধ যত।’
লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট