হল্যান্ড থেকে

কট্টর অভিবাসী ও ইসলাম-বিরোধী দলের ভূমিধস বিজয় : গণতন্ত্রের জন্যে অশনি সংকেত

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ২ ডিসেম্বর, ২০২৩ at ১০:৪৩ পূর্বাহ্ণ

চরম ইসলামবিদ্বেষী ডাচ রাজনৈতিক নেতা খিয়ের্ট বিল্ডারস গেল মাসে অনুষ্ঠিত হল্যান্ডের পার্লামেন্টনির্বাচনে তার হাতে গড়া দল, ফ্রিডম পার্টির জন্যে চূড়ান্ত বিজয় ছিনিয়ে আনলেন। নির্বাচনে তার দল ভালো ফলাফল করবে তেমনটি অনুমান করা গেলেও এমন ‘ল্যান্ডস্লাইড’ বা ভূমিধস বিজয় ছিনিয়ে আনবেন তা বোধকরি বোদ্ধা রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও অনুধাবন করতে পারেননি। দেশের মূলধারার সব রাজনৈতিক দলকে পিছু ফেলে তার দল দেড়শ পার্লামেন্টআসনের ৩৭টিতে জয়ী হয়ে আগামী সরকার গঠনের সুযোগ পেলো। সরকার গঠনে সক্ষম হলে তিনি হবেন আগামী দিনের ডাচ প্রধানমন্ত্রী। তবে এককভাবে সরকার গঠনের জন্যে প্রয়োজনীয় আসন না পাওয়াতে তাকে অন্য রাজনৈতিক দলের সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে হবে। কিন্তু তাতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তার চরম উগ্র ডাননীতি। তিনি কট্টর ইসলামবিরোধী এবং ঘোষণা দিয়েছিলেন, নির্বাচিত হলে হল্যান্ডে সকল মসজিদ ও কোরান নিষিদ্ধ করবেন, বিদেশিদের (অভিবাসী) জন্যে সকল দরজা বন্ধ করবেন, বৃটেনের মত ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে আসার লক্ষ্যে রেফারেন্ডাম দেবেন এবং জলবায়ু চুক্তি থেকে সরে আসবেন। হল্যান্ডের বাকি দলগুলি ‘অভিবাসী’ ইস্যুতে সহমত পোষণ করলেও তার চরম উগ্রবাদী নীতির সাথে একমত নয় বিধায় তারা তার দলের সাথে সরকার গঠনে এখনো পর্যন্ত কোন আগ্রহ প্রকাশ করেনি এবং আগামী দিনগুলিতে করবেন তেমনটি মনে হয় না। সে ক্ষেত্রে খিয়ের্ট বিল্ডারসকে তার ঘোষিত কর্মসূচি, বিশেষ করে মসজিদ ও কোরান নিষিদ্ধ করাথেকে সরে আসতে হবে। নির্বাচনী ঘোষণার আগ মুহূর্তে যখন দেখা গেল বিল্ডাসের্র দল এগিয়ে রয়েছে তখন তত্বাবধায়ক সরকার প্রধান মার্ক রুতের দলের (ফেই ফেই ডে) নতুন নেত্রী, মিস দিলেন ইয়াসিলগজ এই বলে ঘোষণা দেন যে, তার দল বিল্ডার্সের সাথে সরকার গঠন করবে। কিন্তু পরক্ষণেই তুর্কিকুর্দী বংশোদ্ভুত এই মহিলা নেত্রী তার ঘোষণা থেকে সরে এসে বলেন, তার দল বিলডার্সের সাথে সরকার গঠনে কোন আলোচনায় যাবে না। সিদ্ধান্তের এই পরিবর্তনে বিল্ডারস তার সমালোচনা করে বলেন, ‘মুহূর্তের জন্যে কোন আলোচনা না করে এই সিদ্ধান্ত নেয়া সঠিক হয়নি।’ এখন দেখার বিষয় ফ্রিডম পার্টি নেতা বিলডার্স কোন দলকে খুঁজে পান তার সাথে কোয়ালিশনসরকার গঠন প্রক্রিয়ায়।

উত্তর সাগর পাড়ের আপাত শান্ত হল্যান্ড ‘লিবারেল ও সহনশীল’ দেশ হিসাবে পরিচিত। এখন প্রশ্নকী এমন হলো যে সহনশীল জাতি হিসাবে পরিচিত ডাচ জনগোষ্ঠী খিয়ের্ট বিলডার্সের মত উগ্র ডান নেতা ও তার দলের প্রতি ঝুঁকে পড়লো? উল্লেখ্য, বিগত বছরগুলিতে হল্যান্ড ও বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশে সংঘটিত নানা সহিংস ঘটনায় ডাচদের মধ্যে বিদেশিদের প্রতি, বিশেষ করে মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রতি নেতিবাচক মনোভাবে গড়ে উঠে। কেননা দেখা গেছে ওই সমস্ত সন্ত্রাসী ঘটনায় ধর্মীয় উগ্রবাদীরা জড়িত ছিল। এছাড়া ২০০৪ সালে জনপ্রিয় ডাচ চলচিত্র নির্মাতা থিও ভ্যান গগ মরক্কীয় এক মুসলিম যুবক কর্তৃক প্রকাশ্যে দিবালোকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে নিহত হলে গোটা দেশে মুসলিমবিরোধী মনোভাব আরো বেড়ে যায়। ‘সাবমিশন’ নামের ওই চলচ্চিত্রে ইসলামকে এমন এক ধর্ম হিসাবে দেখানো হয়েছে, যা নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতাকে উৎসাহিত করে। সে সময় ‘দ্য গার্ডিয়ান’ এই ঘটনাকে ‘হত্যা যা হল্যান্ডের উদারস্বপ্নকে ভেঙে দিয়েছে’ বলে অভিহিত করে। এরপর ধর্মের দোহাই দিয়ে হল্যান্ডে আরো কিছু সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ঘটে যা ডাচদের পাশাপাশি অন্যান্য জনগোষ্ঠীকে খেপিয়ে তোলে। সেই থেকে হল্যান্ডে এন্টিইসলাম সেন্টিমেন্ট মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। উত্থান ঘটে খিয়ের্ট বিলডার্সের মত উগ্র ডান নেতার। কেবল যে হল্যান্ডেই উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তা নয়। এন্টিঅভিবাসী ও এন্টিইসলাম মনোভাব সমানভাবে বেড়ে উঠেছে বেলজিয়াম, ফ্রান্স, সুইডেন সহ বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশে। ইতিমধ্যে হাঙ্গেরি, সুইডেন এবং সমপ্রতি ফিনল্যান্ডে উগ্র ডানপন্থী দলগুলো শাসন করতে শুরু করেছে। স্পেনেও কনজারভেটিভ পিপলস পার্টিকে সে দেশের আঞ্চলিক ও স্থানীয় পর্যায়ে রেডিকাল জনগণের পার্টির সাথে কোয়ালিশন গঠন করতে হয়েছে। চরম উগ্রবাদী ডান দলগুলির এই উত্থানে উদ্বিগ্ন ইউরোপীয় ইউনিয়ন। কেননা এই সমস্ত দলগুলি ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে আসার পক্ষে। ব্রেক্সিটের মত ডাচ নেতা বিল্ডারস ‘নেক্সিট’ এর উদ্যোগ নিলে অবাক হবার কিছু নেই। আর সে কারণে হল্যান্ডে খিয়ের্ট বিল্ডার্সের উত্থান ইউরোপকে উদ্বিগ্নে ফেলে দিয়েছে।

খিয়ের্ট বিল্ডার্সের এই ভূমিধস বিজয়ের পেছনে গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের সশস্ত্র হামলা, হত্যাযজ্ঞ এবং পরবর্তীতে হল্যান্ড সহ গোটা ইউরোপ জুড়ে হামাসের সমর্থনে মুসলিম অভিবাসীদের গণবিক্ষোভেরও ভূমিকা রয়েছে বলে স্থানীয় রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। তারা মনে করেন, ডাচ জনগণের একটি বৃহৎ অংশ এই গণবিক্ষোভের মধ্যে আগামী দিনে তাদের অস্তিত্বের জন্যে এক ‘অশনি সংকেত’ দেখতে পেয়ে ঝুঁকে পড়েন বিল্ডার্সের ফ্রিডম পার্টির দিকে এবং দলটিকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেন। এছাড়া রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ন্ত্রিতভাবে ‘সুনামির’ মত ইউরোপের দিকে ছুটে আসা অভিবাসী, যা ঠেকাতে চরমভাবে ব্যর্থ হয় বিগত সরকার। উল্লেখ্য, এই অভিবাসী ইস্যুকে ঘিরে বিগত কোয়ালিশন সরকারের পতন ঘটে। ইউরোপের ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি সাধারণ নাগরিকদের মাথায় আর একটি বিষয় সফলভাবে ঢুকাতে সক্ষম হয়েছেন যে ইউরোপে অভিবাসী হয়ে আসা মুসলিমরা ইউরোপীয়দের জন্যে আগামীতে হুমকি হয়ে উঠবে। ইসরায়েলে হামাসের হামলার আগে খিয়ের্ট বিল্ডারস এক জরিপে মোট ভোটের মাত্র ১০ শতাংশ আসন পেয়েছিলেন। কিন্তু গোটা ইউরোপ জুড়ে হামাসসমর্থনে বিক্ষোভের পর তিনি ৩৫ শতাংশ আসন জেতেন। আর সে কারণে দিন যত যাচ্ছে গণতন্ত্রের জন্যে হুমকি এই সমস্ত উগ্র ডানপন্থী দলগুলির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। হল্যান্ডের মত বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশে ইতিমধ্যে অভিবাসন ও মুসলিমবিরোধী দলগুলি ক্ষমতায় রয়েছে, যারা আগেই উল্লেখ করেছি, বৃটেনের মত ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। বিল্ডার্সের দল ক্ষমতায় বসলে এই ইউরোপবিরোধী জোটের শক্তি যে আরো বাড়বে তা বলা বাহুল্য। যে বিষয়টি নির্বাচনপরবর্তী সময়ে আলোচনায় উঠে এসেছে তা হলো, খিয়ের্ট বিল্ডার্স নির্বাচনে যে চমক দেখালেন তা মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলি দেখাতে ব্যর্থ হলো কেন? রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, খিয়ের্ট বিল্ডার্স ডাচ ভোটারদের ব্রেনওয়াশ করেছেন এই দেখিয়ে ‘মুসলিম দেশ থেকে আসা জনগোষ্ঠী দেশের জন্যে, দেশের সংস্কৃতি ও চিন্তাধারার জন্যে বড় বাধা ও সমস্যা।’ আর সে কারণে তিনি বলেছিলেন, ক্ষমতায় গেলে তিনি হল্যান্ডে কোরান নিষিদ্ধ করবেন এবং মসজিদ বন্ধ করবেন। তবে বলা যত সহজ বাস্তবে রূপ দেয়া অত সহজ নয়। সে ক্ষেত্রে দেশের শাসনতন্ত্র পরিবর্তন সহ নানা আইনি জটিলতা রয়েছে। আর সে কারণে এগুলি যত না তার নীতিগত বক্তব্য, তার চাইতে বেশি হলো রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর। আর বিষয়টি বোধকরি বিল্ডার্স নিজেও জানেন। জানেন বলেই নির্বাচনের আগে এই ব্যাপারে তাকে তেমন সোচ্চার হতে দেখা যায়নি। তবে অভিবাসীর জন্যে সকল দরজা বন্ধ করার ব্যাপারে কোন আপস করতে রাজি নন বলে পুনরায় তিনি তার নির্বাচনী ওয়াদা ব্যক্ত করেন। রাজনীতির মাঠে রাজনীতিবিদরা বিশেষ করে যখন তাদের অবস্থান বেঞ্চের উল্টো দিকে হয়, তখন তাদের ‘ক্ষমতায় গেলে আমরা হেন্‌ করেগা, তেন করেগা’, এমনি অনেক কিছু বলতে দেখা যায়। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে টের পান যে ‘করাটা’ অত সহজ নয়। দেখা যাক, চরম ডানপন্থী অভিবাসী ও মুলসিমবিরোধী ডাচ রাজনীতিবিদ খিয়ের্ট বিল্ডার্স ক্ষমতায় গিয়ে কী পরিবর্তন আনেন। আর তা দেখতে আমাদের আরো মাস কয়েক অপেক্ষা করতে হবে। কেননা কোয়ালিশন সরকার গঠনে বিল্ডার্সকে অনেক বেগ পেতে হবে, অনেক ছাড়দিতে হবে। তবেই না তিনি বসতে পারবেন কাংখিত প্রধান মন্ত্রীর আসনে।

লেখক : সাহিত্যিকসাংবাদিককলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকটি সুবর্ণ কার্ড ও প্রতিবন্ধীদের বিড়ম্বনা
পরবর্তী নিবন্ধবিজয় মাসের পটভূমি তরুণদের মাঝে সঞ্চারিত করতে হবে