দেশে এসেছি প্রায় সপ্তাহ দুয়েক হয়ে গেছে। এখন ফিরে যাবার পালা। কথা ছিল অক্টোবরে সপ্তাহ তিনেকের জন্যে দেশে আসবো। কিন্তু আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে হঠাৎ দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে কেনা–টিকেট বাতিল করি। ঠিক করি পরিস্থিতির উন্নতি হলে জানুয়ারির শেষের দিকে দেশে আসবো। কিন্তু কথায় আছে– ‘ম্যান প্রোপোজেস, গড ডিস্পোজেস’, মানুষ চায় এক, কিন্তু উপরওয়ালা লিখে রাখেন অন্যকিছু। টিকেট বাতিল করার দিন কয়েকের মাথায় আবার নতুন করে টিকেট করতে হয়। দেশ থেকে এলো মাথায় বাজ পড়ার মত দুঃসংবাদ– মেজবৌদি আর নেই। সুস্থ মেজবৌদি পরদিন মেজদা সহ স্রেফ বেড়ানোর জন্যে ব্যাংকক যাবার কথা। প্লেনের টিকেট, হোটেল থেকে শুরু করে সমস্ত আয়োজন প্রস্তুত। মেজবৌদি নিজ হাতে ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছে। কিন্তু ব্যাংকক তার আর যাওয়া হলো না। গেলেন না–ফেরার দেশে। বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে বেহুস হলে তড়িঘড়ি করে তাকে কাছের এক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তার বললেন, রক্ত চাই। খবর পেয়ে পরিচিত–অপরিচিত অনেকেই এগিয়ে এলো। প্রয়োজনের চাইতেও বেশি রক্ত পাওয়া গেল। কিন্তু অবস্থার কোন উন্নতি হলো না। সেদিন ছিল শুক্রবার। পরে জানতে পারি, জরুরি ভিত্তিতে অপারেশন করার জন্যে স্পেশালিস্ট (ডাক্তার) পাওয়া যাচ্ছে না। মেজবৌদির আপন ছোটভাই ঢাকার এক হাসপাতালের সিনিয়র ডাক্তার। সে তার সিনিয়রদের সাথে যোগাযোগ করেও অপারেশন করার জন্যে নিদেনপক্ষে যে তিন বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন তাদের ‘এক’ করতে পারলো না। যোগাযোগ করা হলো ঢাকার এক নামকরা হাসপাতালের সাথে। ঠিক হলো পরদিন শনিবার সকালে সেখানে অপারেশন করা হবে। ইতিমধ্যে মেজবৌদি আইসিইউতে। মেজদা কিছুটা আশা নিয়ে চলে গেল কাছেই এক নিকট আত্মীয়ের বাসায়। তাকে অকেনটা জোর করেই সেখান নিয়ে যাওয়া হয়েছিল একটু বিশ্রামের জন্যে। রাত দুটোর দিকে সবাইকে কাঁদিয়ে মেজবৌদি চলে গেল না– ফেরার দেশে। মেজদাকে রাতে জানানো হলো না। মেজদা জানতে পারলো পরদিন, যখন সে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দেবে তার ঠিক আগ মুহূর্তে।
আমি তখন হল্যান্ডে ড্রয়িং রুমের সোফায় আঁধশোয়া অবস্থায় টিভি নিউজ দেখছিলাম। সুমনা বাসায় এসে যখন দুঃসংবাদটি দিলো তখন কিছুতেই অশ্রুকে আর আঁটকে রাখতে পারলাম না। বুকের ভেতর থেকে চাপা কান্না এক সময় শব্দ করে বেরুলো। মুখ থেকে বেরুলো কেবল ক’টি শব্দ– ‘একী করে সম্ভব’! মাস কয়েক আগে আমেরিকা থেকে আসা তাদের একমাত্র পুত্র সন্তান, অভির বিয়েতে সবাই মিলে কী হইচই না করলাম। হল্যান্ড থেকে আমরা সবাই দলবেঁধে দেশে গিয়েছিলাম অভির ‘বিয়ে খেতে’। রাত তিনটের দিকে ঢাকায় ট্রাভেল এজেন্টকে ফোন করে দ্বিগুণ ভাড়া দিয়ে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের টিকেট কেটে পরদিন বিকেলে রওনা দিলাম। শোকটা অনেকটা ক্ষোভে পরিণত হলো যখন দেশে এসে জানলাম অপারেশনের জন্যে যে তিন বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন তাদের কিছুতেই এক করা সম্ভব হয়নি। তার কারণ যখন জানতে পারলাম তখন আমার প্রতিক্রিয়া এ কী করে সম্ভব। শুনলাম দেশে প্রায় হাসপাতালে, সরকারি তো বটেই এমন কী বেসরকারি নামি–দামি হাসপাতালেও শুক্রবারে ডাক্তারদের পাওয়া যায় না। ওনারা শুক্রবার নাকি হাসপাতালে আসেন না। সে সময় প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলি চলে মূলত নতুন ও ইন্টার্নি ডাক্তারদের দিয়ে। অবাক করা ব্যাপার। আমার এই জন্মে শুনিনি বাংলাদেশ ছাড়া আর কোন দেশে এই ধরনের অলিখিত নিয়ম আছে কিনা যে শুক্রবার ডাক্তার পাওয়া যায় না, কিছু হাতে গোনা ব্যতিক্রম ছাড়া। বিশেষ বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জন্যে বিশেষ ব্যবস্থা হয়তো আছে, কিন্তু আমজনতার ভাগ্যে ঐটিই অলিখিত নিয়ম। তার মানে কী দাঁড়ালো? রোগ যদি আসে তাকে বলে–কয়ে আসতে হবে যে ‘তুমি এসো, তবে সপ্তাহের অন্যদিন, শুক্রবার নয়’। শুনে আমি যত আমার বিস্ময় প্রকাশ করি ততই শুনি– এতো নতুন কিছু নয়, দীর্ঘদিন ধরে এমনটি হয়ে আসছে। তারপরও আমার বিশ্বাস হতে চায় না। বিশ্বাস হতো না, যদি মেজবৌদির ক্ষেত্রে এমনটি না ঘটতো। শুক্রবার সন্ধ্যার পর কোন স্পেশালিস্ট পাওয়া গেল না বলেই তার (মেজবৌদি) এই অকাল পরিণতি বলে অনেকে মনে করছে।
বন্ধুসম ডাক্তার সেলিম আকতার চৌধুরীর সাথে এই নিয়ে তার মতামত জানতে চাই। তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান। সমপ্রতি আগ–বাড়িয়ে পেনশনে গেছেন। এখন চট্টগ্রামের অতি আধুনিক ‘বেলভিউ হাসপাতালের’ ম্যানেজিং ডিরেক্টর। চমৎকার দৃষ্টিনন্দন এই হাসপাতালে তার চেম্বারে আজ কথা হয় এই নিয়ে। তিনি বলেন, সরকারি হাসপাতালে ইমার্জেন্সি পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্যে পৃথক ব্যবস্থা থাকে। আর বেসরকারি হাসপাতালে যখনই সিরিয়াস রোগী আসে তখন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাইরের ডাক্তারকে কল করা হয়। তারা রোগী এটেন্ড করবেন এবং চিকিৎসা সেবা দেবেন। উত্তরে বলি, এটি তো খাতা–কলমের নিয়ম, কিন্তু বাস্তব চিত্র কী বলে? উত্তরে ডা. সেলিম চৌধুরী বলেন, সরকারি হাসপাতালের ক্ষেত্রে সরকারি যে রুলস আছে তা অনুসরণ করা হয়, আর বেসরকারি হাসপাতালে রোগী চব্বিশ ঘন্টা চিকিৎসা সেবা পান। তিনজনের একটি টিম থাকে অপারেশন করার জন্যে একজন মূল সার্জেনের নেতৃত্বে। ওনার অধীনে থাকবেন আরো দু’জন বিশেষজ্ঞ, এছাড়া রয়েছে নার্সসহ আরো সাপোর্টিং হ্যান্ডস। জানতে চাই, শুক্রবার তো এই চিত্র ভিন্ন। বিষয়টি অস্বীকার করেননি ডাক্তার সেলিম চৌধুরী। তিনি বলেন, শুক্রবার তারা নিজের কাজে, পরিবারকে নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। জন্ম–মৃত্যু সৃষ্টিকর্তার ওপর। কিন্তু মেজ বৌদির ক্ষেত্রে শুক্রবার তিন বিশেষজ্ঞকে এক করা গেলে হয়তো তাকে বাঁচানো যেত। তখন তিনি স্বীকার করে বললেন, যে হাসপাতালের কথা বললেন তারা প্রাইভেট সার্ভিস দেয়, তাদের উচিত ছিল অল্টারনেট এরেঞ্জমেন্ট রাখা।
বিষয়টি নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। পৃথিবীর আর কোন দেশে এমন সিস্টেম চালু আছে কিনা আমার জানা নেই। রোগ তো আর ‘বার‘ দেখে রোগীকে ধরা দেয় না। ডাক্তার হচ্ছেন রোগীর আস্থার স্থল। সৃষ্টিকর্তার পর তাদের ওপরই বাঁচা–মরা নির্ভর বলে আমার ধারণা। অনেক প্রবল–পরাক্রমশীল মানুষকেও দেখেছি রোগে আক্রান্ত হয়ে অসহায়ের মত ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে। দেশে রোগী কিংবা রোগীর এটেন্ডেন্টের সাথে ডাক্তারদের রূঢ় আচরণের কথাও প্রায়শ শুনি পত্র–পত্রিকার পাতায়। রোগীর সমস্যা ডাক্তার ভালোভাবে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন আছে বলে অনেক ডাক্তার মনে করেন না– এমন অভিযোগও রয়েছে। কথা প্রসঙ্গে দিন কয়েক আগে ভুক্তভোগী এক রোগী ক্ষোভের সাথে বলেন, বাংলাদেশে চিকিৎসা–সেবা এখন চিকিৎসা–বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। দেশে আধুনিক হাসপাতাল, ক্লিনিকের কমতি নেই, কমতি কেবল ভালো চিকিৎসা সেবার। যারা অর্থবান দেশের চিকিৎসা সেবায় তাদের আস্থা শূন্য পর্যায়ে। তারা যান আমেরিকা–কানাডা–ইউরোপ। আবার কেউবা যান ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর। যাদের সে সামর্থ নেই তারা যান পাশের দেশ ভারতে। কেবল বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসার জন্যে যাবার কারণে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ‘মেডিকেল ট্যুরিজম’ একটি জমজমাট কারবার। অথচ বাংলাদেশে যে একেবারে ভালো চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই তা মনে করার কোন কারণ নেই। বেশ কিছু হাসপাতাল আছে যা অত্যাধুনিক। অনেকেই সেখানে যান। কিন্তু আরো অনেকেই সেখানে যেতেন যদি এই সমস্ত প্রাইভেট চিকিৎসা কেন্দ্রগুলো (হাসপাতাল) রোগীদের আস্থা অর্জন করতে পারতো। দিন বদলেছে। বদলেছে বাংলাদেশ, বদলাচ্ছে বন্দর নগরী চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামের বুকে সামপ্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি অতি আধুনিক হাসপাতাল স্থাপিত হয়েছে। দৃষ্টিনন্দন এই হাসপাতালগুলো আশাকরি তাদের সেরা–সেবা দিতে সচেষ্ট থাকবেন বলে আশা করি। এও আশা করি যে তারা প্রত্যেকে যেন বড় গলায় দাবি করতে পারেন, ‘ইউ আর বেটার অফ দি বেস্ট’।
লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট