হল্যান্ড থেকে

ডাচ পার্লামেন্ট নির্বাচন - আবারো কি কোয়ালিশন সরকার গঠন

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ১১ নভেম্বর, ২০২৩ at ৫:৫৯ পূর্বাহ্ণ

আজ থেকে ৩২ বছর আগে মা এসেছিলেন হল্যান্ডে বেড়াতে। আমার এদেশে আসার ঠিক বছরের মাথায়। তখন তার শরীরের ডানদিকটা প্যারালাইজেড। টেনে টেনে হাঁটতে হতো তাকে। শরীরের ওই দশায় মা এসেছিলেন, তিনি ছিলেন ভীষণ সাহসী। সহজে রোগ তাকে কাবু করতে পারতো না। আমাদের সাথে মা ছিলেন মাস তিনেক। তখন প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। বত্রিশ বছর আগে বিশ্ব জলবায়ুর এত মন্দপরিবর্তন ঘটেনি। ইচ্ছে ছিল আরো কিছুদিন মাকে কাছে রাখবো। কিন্তু একদিকে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা অন্যদিকে দেশিয় খাবারের অভাব। তখন হল্যান্ডে আজকের মত কোন বাংলাদেশি দোকান ছিল না। তার চাইতে বড় অভাব ছিল পানের। মা পান খেতেন খুব। জর্দা মিশিয়ে। সব মিলিয়ে মা আর থাকতে চাইলেন না। দেশে ফিরে গিয়ে তিনি তার নাতিনাতনিদের প্রায়শঃ বলতেন, ‘এমন এক দেশে গেলাম, যেখানে না আছে মশা, না আছে মাছি কিংবা পিঁপড়া। কী অবাক কাণ্ড’। কথাটা মনে পড়লো এই কারণে দিন কয়েক আগে বাংলাদেশ থেকে পড়াশুনা করতে আসা এক ছাত্রের কথা শুনে। সে বলে, ‘ভাইয়া, একটা বিষয় আমার কাছে খুব অবাক লাগছে। মাত্র দুই সপ্তাহ বাদে হল্যান্ডে জাতীয় নির্বাচন। কিন্তু কোথায়ও কোন নির্বাচনী প্রচারণা, পোস্টার, দেয়ালে চিকা চোখে পড়লো না। মিছিল, স্লোগান, গাড়ি পোড়া, পুলিশ পিটিয়ে মারা তো দূরের কথা। একী আজব কারবার’। শুনে মৃদু হাসি, তাকে বলি, তোমার অনভ্যস্ত চোখে আজব লাগাটাই স্বাভাবিক।

আজবই বটে। এই লেখা যেদিন ছাপার অক্ষরে এই পত্রিকার পাতায় বেরোবে তার ঠিক দশদিন পর অর্থাৎ ২২ নভেম্বর হল্যান্ডের জাতীয় নির্বাচন। মোট ১৫০টি সংসদীয় আসনে ছোট বড় মাঝারি সব মিলিয়ে ২৬টি রাজনৈতিক দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে এবারের নির্বাচনে। বাংলাদেশের নির্বাচন আরো প্রায় মাস দুয়েক বাকি। কিন্তু তার অনেক আগ থেকেই রাজপথ উত্তপ্ত। আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে বিরোধী দলের আন্দোলন, পুলিশ হত্যা, যানবাহন, দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ গোটা দেশে এক ভীতিকর পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। সাধারণ জনগণের দুর্ভোগ বেড়েছে। নির্বাচনকে ঘিরে ঠিক এর সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র উত্তর সাগর পাড়ের অতি উন্নত ছোট্ট দেশ হল্যান্ডে। এখানে রাজনৈতিক দলের কোন মিছিল নেই, নেই সমাবেশ, বাংলাদেশের ভাঙচুরের তো প্রশ্নই আসেনা। সে চিন্তার অতীত। বিভিন্ন শহরে স্থানীয় প্রশাসন থেকে নির্দিষ্ট করে দেয়া ছোট্ট বিলবোর্ডে কোন কোন রাজনৈতিক দলের দলীয় প্রার্থীদের ছবি ও নীতিমালা সম্বলিত পোস্টার দেখা যায়। এর বাইরে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে রাজনৈতিক দলগুলির নেতাদের নিয়ে, কখনো বা বিশিষ্ট জনদের নিয়ে টকশো দেখা যায়। দেখা যায় বিভিন্ন দলীয় নেতাদের নিয়ে টিভিবিতর্ক। সেই বিতর্কে নেই বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর কোন কোন অনুষ্ঠানে উচ্চকণ্ঠে ও দৃষ্টিকটুভাবে তর্কবিতর্কের দৃশ্য। সভ্যতার চূড়ান্ত রূপ বললে এতটুকু বাড়িয়ে বলা হবেনা। হল্যান্ডে এক নাগাড়ে আছি প্রায় ৩৩ বছর। এই তিন যুগেরও বেশি সময়ে কখনো কোন রাজনৈতিক দলকে মিছিল করতে দেখিনি। মিছিল বা ডেমোন্সট্রেশন কেবল দেখা যায় যখন পরিবেশবাদীরা আন্দোলন করেন, ছাত্ররা তাদের দাবিদাওয়া নিয়ে রাস্তায় নামে তখন। নির্বাচনকে ঘিরে আমাদের দেশের মত এতো বাড়াবাড়ি, হইচই, অরাজকতা একেবারে নেই। এমন কী যেদিন নির্বাচন সেদিনও কোথাও কোন অস্বাভাবিকতা বা হৈহুল্লোড় চোখে পড়ে না। যে যার কাজ করছেন, কেউ অফিস যাচ্ছেন, কেউ বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, ট্রাম বাস ট্রেনের চালক যে যার কাজ করছেন অন্য দিনের মত। আপনি কেবল দিনের কোন একটা সময় ধারেকাছে কোন ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নিজের ভোটটি দেবেন। নিজ এলাকায় গিয়ে ভোট দিতে হবে এমন কোন নিয়ম নেই। নির্বাচনের সপ্তাহ কয়েক আগে ডাকযোগে আপনার বাসায় পাঠানো ভোটকার্ড ও পরিচয় পত্র (পাসপোর্ট কিংবা ড্রাইভিং লাইসেন্স) দেখিয়ে আপনি আপনার ভোট দিতে পারবেন। প্রতি চার বছর পর পর হল্যান্ডের জাতীয় নির্বাচন হয়ে থাকে। কখনো বা তারও আগে। নির্দিষ্ট সময়ের আগে সরকার পতন হবার কারণে। ভোটারদের পছন্দের দলও পরিবর্তন হয়। নির্দিষ্ট দলের প্রতি এখানকার জনগণের কোন অন্ধ ভালোলাগা বা ব্লাইন্ডসাপোর্ট নেই। দলের নীতিমালার ওপর নির্ভর করে জনগণ ভোট দেয়। কিছু অন্ধ সমর্থক আছেন বটে, কিন্তু তাদের সংখ্যা নিতান্ত হাতেগোনা। সেই নব্বই দশক থেকে ভোট দিয়ে আসছি। কিন্তু দেশে থাকাকালীন কোন নির্বাচনে ভোট দেয়ার সুযোগ হয়নি। কখনো ভোটকেন্দ্র অনিরাপদ মনে হয়েছে। লাইনে দাঁড়িয়ে একবার ভোট দিতে গিয়েছিলাম। বলা হলো, ‘আপনার ভোট তো দেয়া হয়ে গেছে’। প্রতিবাদ না করে চলে এসেছিলাম। জানি প্রতিবাদ করে কোন লাভ হবে না। সেই থেকে ওমুখো আর হইনি। যদিও ভোট দেয়া নাগরিক অধিকার।

যাই হোকহল্যান্ডে এবার যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে তা নির্দিষ্ট সময়ের প্রায় অর্ধ বছর আগে। ওলন্দাজ রাজনৈতিক ইতিহাসে কোন দল এককভাবে সরকার গঠন করতে পারেনি। বরাবর গঠিত হয়েছে কোয়ালিশন সরকার। বর্তমানে ক্ষমতায় রয়েছে তিন দলীয় কেয়ারটেকার সরকার। প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুতের নেতৃত্বে এই সরকারের পতন ঘটে চলতি সালের ৭ জুলাই। ক্রমবর্ধমান মাইগ্রেন্টস সমস্যাকে ঘিরে কোয়ালিশন পার্টির মধ্যে অনৈক্য দেখা দিলে মার্ক রুতে তার সরকারের পদত্যাগ ঘোষণা করেন। চার চারবার নির্বাচিত প্রধান মন্ত্রী মার্ক রুতে তীব্র সমালোচনার মুখে ঘোষণা দেন তিনি কেবল দলীয় নেতৃত্ব থেকে নয়, দেশের রাজনীতি থেকে পদত্যাগ করবেন এবং আসন্ন নির্বাচনে প্রার্থী হবেন না। যেমন ঘোষণা তেমন কাজ। আগামী নির্বাচনে তিনি দলীয় মনোনয়ন চাননি। আমাদের দেশে যে সমস্ত রাজনৈতিক নেতার ‘ডিগবাজি’ খাওয়ার অভ্যেস তাদের জন্যে এ শিক্ষণীয় বটে। তবে তারা সে থেকে কোন শিক্ষা যে নেবেন না তা সবার জানা।

ইতিমধ্যে কোন দল আগামী নির্বাচনে সর্বাধিক ভোট পেয়ে বিজয়ী হবে কিংবা কে হবেন পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী এই নিয়ে জল্পনাকল্পনার শেষ নেই। আগেই বলেছি কোন দলই এর আগে এককভাবে বিজয়ী হতে পারেনি এবং এবারও তার অনিয়ম হবেনা বলে ধরে নেয়া হচ্ছে এবং কোন দলই দেশের ১৫০ আসনে প্রার্থী দিতে সক্ষম হয়নি। মোট ২৬টি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করলেও লড়াই হবে মূলতঃ তিনটি দলের মধ্যে। এই তিনটি দল হলো, কেয়ারটেকার সরকারের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পিপলস পার্টি ফর ফ্রিডম এন্ড ডেমোক্রেসি (ফেই ফেই ডে), লেবার পার্টি ও গ্রীন পার্টির মোর্চা এবং নবগঠিত দল ফোরাম ফর ডেমোক্রেসি। প্রধান মন্ত্রী মার্ক রুতে দলীয় প্রধানের পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর পর ফেই ফেই ডের হাল ধরেছেন তুর্কিকুর্দী বংশোদ্ভূত মহিলা ৪৬ বছরের দিলান ইসিলোগোস। সরকার পতনের আগে তিনি ছিলেন বিচার ও নিরাপত্তা মন্ত্রী। তার দল যদি আসনের দিক থেকে এগিয়ে থাকে তাহলে তিনিই হবেন হল্যান্ডের ইতিহাসে প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী। কেবল তাই নয় ডাচ পলিটিক্যাল ইতিহাসে তিনি হবেন প্রথম বিদেশি বংশোদ্ভূত প্রধানমন্ত্রী। আমেরিকার জনগণ বারাক ওবামাকে প্রেসিডেন্ট হিসাবে নির্বাচিত করেছিলেন। কিন্তু বৃহত্তর ডাচ জনগোষ্ঠী বোধকরি এখনো ভিন দেশ থেকে আসা কাউকে তাদের দেশের সর্বোচ্চ আসনে দেখতে প্রস্তুত নন।

ইতিমধ্যে যে কটি নির্বাচনী জরিপ হয়েছে তার একটিতে দেখা যায়, সদ্য আত্মপ্রকাশ করা দল, নিউ সোশ্যাল কন্ট্রাক্টের নেতা ৪৯ বছরের ড. পিটার ওমজিট অন্যদের ডিঙিয়ে কিছুটা এগিয়ে আছেন। অপেক্ষাকৃত তরুণ ও স্মার্ট এই রাজনীতিবিদ ২০০৩ থেকে ডাচ পার্লামেন্টের নির্বাচিত সদস্য এবং ডাচ ভোটারদের মাঝে বেশ জনপ্রিয়। তবে পিছিয়ে নেই দুই দলের (লেবার পার্টি ও গ্রিন পার্টি) মোর্চার নেতা, ডাচ রাজনীতিবিদ ও প্রাক্তন কূটনীতিবিদ ফ্রান্স টিমারমান্স। টিমারমান্স ২০১৪ থেকে ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত ইউরোপীয় কমিশনার ছিলেন এবং ইউরোপীয় কমিশনের প্রথম সহসভাপতি ছিলেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, অবাক হবার কিছু নেই যদি টিমারমান্স হল্যান্ডের নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। অন্যদিকে, ডাচ রাজনীতিতে ডান চরম দল হিসাবে পরিচিত, পার্টি ফর ফ্রিডম এবং এর নেতা খিয়ের্ট বিল্ডার্স এবং অনেকটা একই ধারার রাজনীতিবিদ সুদর্শন ও সুবক্তা চেরী বোঁর্দে আসন্ন নির্বাচনে খুব একটা সুবিধা হয়তো করতে সক্ষম হবেন না বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা। এরা দুইজনেই চরমভাবে অভিবাসনবিরোধী। তারপরও রাজনীতিতে শেষ মুহূর্তে অনেক কিছুই ঘটতে পারে। ভোটারের মন, চিন্তাভাবনার পরিবর্তন হতে পারে। তবে ফলাফল যাই হোক না কেন এটি অনেকটা নিশ্চিত করে বলা যায় যে আগামী নির্বাচনেও কোন দল এককভাবে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে সক্ষম হবেনা। নির্বাচনের পর কোয়ালিশন সরকার গঠন প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ। কখনো ছয় মাস পার হয়ে গেছে অথচ কোয়ালিশন সরকার গঠন সম্ভব হয়নি, তেমন ইতিহাসও আছে ওলন্দাজেদের এই দেশটিতে। দেখা যাক শেষতক কী হয়। আমরা সে দিনের অপেক্ষায়।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট, সাহিত্যিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধশৈশব : ‘পেছনে তাকালে বুক হুহু করে ওঠে’
পরবর্তী নিবন্ধপ্রীতিময় জীবনের জন্য চাই সুসম্পর্ক