হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ ছিরিকোটি

জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়ার প্রতিষ্ঠাতা

অধ্যাপক কাজী সামশুর রহমান | রবিবার , ১২ জুন, ২০২২ at ৮:২৬ পূর্বাহ্ণ

পাকিস্তানের হাজারা প্রদেশের হরিপুর জেলার (শেতালুশরীফ) ছিরিকোটি’র নবী বংশের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১৮৫৬ সালে আওলাদে রাসুল হযরত সৈয়্যদ মুহাম্মদ ছদর শাহ’র ঔরসে জন্ম নেন জমানার গাউস হযরতুল আল্লামা আলহাজ্ব হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ আহমদ শাহ। পিতামাতা উভয়েই ছিলেন আমাদের প্রাণপ্রিয় নবীয়ে পাক হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলায়াহি ওয়াসাল্লাম এর বংশধর। স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কুরআনে হিফজ্‌ সমাপ্ত করে ভারতবর্ষের বিভিন্ন মাদ্‌রাসায় কুরআনহাদিসএর শিক্ষা গ্রহণ করেন। ১২৯৭ হিজরি মোতাবেক ১৮৮০ সালে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপনান্তে ব্যবসার উদ্দেশ্যে সুদূর দক্ষিণ আফ্রিকায় পাড়ি জমান। দীর্ঘ ১৬ বছর তিনি সেখানে অতিবাহিত করেন। এ সময় একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন এবং দেশে তিনি ‘আফ্রিকাওয়ালা’ নামে অভিহিত হন। ড: ইব্রাহিম মাহ্‌দি লিখিত A Short History of Muslims in South Africa  নামক ঐতিহাসিক গ্রন্থে দেখা যায় তিনি শুধু সফল ব্যবসায়ীই ছিলেন না, উপরন্তু, সেখানকার কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে একজন সফল ইসলাম প্রচারক ও প্রথম জামে মসজিদ নির্মাণকারী হিসেবেও প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। তাঁর বিদূষী সহধর্মিনী হযরত সৈয়্যদা খাতুনের অনুপ্রেরণায় ও উৎসাহে হরিপুরের বাসিন্দা তখনকার যুগের গাউসেজমান এল্‌মে লুদুন্নীর প্রস্রবণ হযরত খাজা আবদুর রহমান চৌহরভীর নিকট যেতে রাজি হলেন। এ মহান সাধকের সান্নিধ্য লাভের আশায় হরিপুর গমন করলেন। হরিপুর বাজারে তিনি একটি কাপড়ের দোকান খুলে ব্যবসা শুরু করেন। এক সময় হযরত চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হির সাক্ষাত লাভের উদ্দেশ্যে যান। পীর মুরীদ সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়ে গেল। ফয়ুজাত পাওয়া শুরু হলো, পীরের মাদ্রাসায় কয়েক বছর পাঠদান করলেন। পীরের সোহবতে আসার অল্প দিনের মধ্যেই পীরের আদেশ হল “লঙ্গরখানার জন্য কাঠ যোগাড় করে আনতে’’। শুরু হলো সিরিকোটি হুজুরের রিয়াজতের পালা। সকলেই কানাঘুষা করতে লাগল এরকম একজন মৌলানা, ব্যবসায়ী, পণ্ডিত ব্যক্তিকে হুজুর কেবলা কাঠ সংগ্রহের কাজে লাগালেন। নির্দেশদাতা ও নির্দেশ পালনকারী এর গুঢ় রহস্য বুঝতে পেরেছেন। তাই বিনা বাক্য ব্যয়ে পীরের আদেশে লঙ্গরখানার জন্য কাঠ সংগ্রহের কাজে লেগে গেলেন হুজুর সৈয়্যদ আহমদ শাহ্‌। দীর্ঘ সময় যাবৎ বহু দূর থেকে মাথায় কাঠের বোঝা নিয়ে লঙ্গরখানায় কাঠ সরবরাহ করেছেন এক নাগাড়ে। এভাবে কঠোর সাধনার কারণে পীরের নিকট হতে ‘তাওয়াজ্জুহ্‌’ লাভ করেন। পীর ছাহেব চার হাজার মাইল দূরে অবস্থিত বার্মার রাজধানী রেঙ্গুনে গিয়ে দ্বীন ইসলাম এর প্রচার করার নির্দেশ দিলেন। যে কথা সে কাজ। কোন অজুহাতে বা কোন রকম সুবিধা অসুবিধা বা পরিবার পরিজনের কথা তাঁর মনে কোন রকম দাগ কাটেনি। বিনা বাক্যব্যয়ে পুনরায় দেশান্তরিত হলেন পীরের ইচ্ছে বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে। ১৯২০ সালে তিনি রেঙ্গুন গমন করে সেখানকার বাঙালি মসজিদ নামে খ্যাত মসজিদে ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব নেন। তাঁর আকর্ষণীয় নূরানী চেহারা শরীয়ত তরীকত হাকীকত মারেফত প্রভৃতি বিষয়ে পাণ্ডিত্যপূর্ণ জ্ঞান লক্ষ্য করে মুসল্লীরা ক্রমশঃ হুজুর ক্বিবলার সান্নিধ্যে আসা শুরু করলো। স্থানীয় মুসল্লীরা তাঁকে বাইয়াত করানোর জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করে দিলে তিনি তাঁর মুর্শিদের নিকট এর একটা সমাধান চাইলেন। হযরত খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী তাঁর নিকট একটি রুমাল পাঠান। কিছুকাল পর তাঁকে খেলাফত ও ইজাজত দিয়ে বাইয়াত করানোর অনুমতি দান করা হয়। দলে দলে নবী অলি প্রেমিকরা বাইয়াত হতে থাকল। এ সময় চট্টগ্রামের বহু লোক জীবিকার সন্ধানে রেঙ্গুন তথা সমগ্র বার্মায় অবস্থান করছিল। দৈনিক আজাদী ও কোহিনূর ইলেক্ট্রিক প্রেসের প্রতিষ্ঠাতা ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবদুল খালেক, সুফী আবদুল গফুর, ডা. মোজাফফরুল ইসলাম, আবদুল মজিদ সওদাগর, মাস্টার আবদুল জলিলসহ বেশ কিছু চট্টগ্রামের লোক হুজুর ক্বিবলার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। গাউসে জমান হযরত খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী (রাহমাতুল্লাহি আলায়হি)’র একটি অলৌকিক অদ্বিতীয় ৩০ পারা দুরূদ শরীফ সম্বলিত ‘মাজমুয়ায়ে সালাওয়াতে রাসূল’ (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) রচনা করেন। এই অদ্বিতীয় কিতাবখানা ছাপিয়ে প্রচার করার জন্য এবং দারুল উলুম ইসলামিয়া রহমানিয়া মাদ্‌রাসার উন্নতিকল্পে অর্থ সংগ্রহের নির্দেশ দিলেন। আরো বললেন, যতদিন এ কাজ সমাধা না হয় ততদিন রেঙ্গুন ত্যাগ করে কোথাও যাবে না। আপন পীরের নির্দেশ শিরোধার্য এ কথা অনুধাবন ও বিশ্বাস করতেন বলে হুজুর ক্বিবলা সৈয়্যদ আহমদ শাহ দীর্ঘ ১৬ বছর দেশে যাননি। ১৯২৫ সালে তিনি পীরের নামে ‘আন্‌জুমানে শুরায়ে রহমানিয়া’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। আন্‌জুমানের যাবতীয় কার্যাদি এর মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়। ১৯৩৬ সালে তিনি ১৬ বছর পর স্বদেশে যান। ইতোমধ্যে হযরত খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী (রাহমাতুল্লাহি আলায়হি) ইন্তেকাল করেন (ইন্না….রাজেউন)

১৯৪৯ সালে হুজুর বাঁশখালী থানার শেখের খীল এলাকায় একটি মাহফিলে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে যোগদান করেন। মরহুম মৌলানা ইজহারুল হক ছাহেব ও মরহুম বজলুল করিম (দু’জনই হুজুরের খলীফা) এর ব্যবস্থাপনায় ছিলেন। ওয়াজ নসিহত শুরু করার প্রাক্কালে হুজুর ক্বিবলার সফর সাথীগণ ব্যতীত উপস্থিত জনতার কেউ দরুদ পাঠ করলেন না। এটা প্রত্যক্ষ করে তিনি গভীরভাবে মর্মাহত হন। ক্রোধান্বিত হয়ে সফর সংক্ষিপ্ত করে তিনি শহরে ফিরে আসেন। তিনি উপলব্ধি করেন যে এখানকার সরলপ্রাণ মুসলমানদের ঈমানআক্বীদা রক্ষা করার জন্য সুন্নীয়ত ভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। এ সময় তিনি বললেন, ‘কাম করো দ্বীনকো বাঁচাও, ইসলামকো বাঁচাও’। তিনি ভক্ত অনুরক্তদের মাদ্‌রাসা প্রতিষ্ঠার জন্য জমি খোঁজ করতে নির্দেশ দিলেন, বললেন এমন জমি দেখ শহর ভি না হো, গাঁও ভি না হো, সাথ মসজিদ ভি হো আওর তালা ভি হো, অর্থাৎ শহর ও না গ্রাম ও না, সাথে মসজিদ থাকবে, পুকুরও থাকবে। অনেক জমি দেখা হলো হুজুরের পছন্দ হয় না। শেষে ষোলশহরের নাজিরপাড়ার বর্তমান স্থানটি (যেখানে জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া অবস্থিত) দেখানো হলে হজুর বলেন যে হ্যাঁ এখান থেকে আমি দ্বীনি শিক্ষার খুশবু পাচ্ছি। এখানেই ১৯৫৪ সালে নবী পাকের ৩৮তম বংশধর আলেমে দ্বীন শরীয়ত ত্বরীকতের কাণ্ডারী গোমরাহীর অন্ধকার থেকে আলোর পথের দিশারী কুতুবুল আউলিয়া গাউসে জমান হযরতুল আল্লামা আলহাজ্ব হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ আহমদ শাহ্‌ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি পবিত্র হস্ত মুবারক দ্বারা ঐতিহাসিক জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়ার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। পরিচালনার দায়িত্ব আনজুমানএ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টএর উপর ন্যস্ত, তথাপি এর পিছনে প্রিয় নবী ও আওলাদে রাসূলগণের জাহেরী বাতেনী শক্তিই মূল পরিচালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে আসছে। হুজুর মাদ্‌রাসা প্রতিষ্ঠালগ্নে কয়েকটি অতি মূল্যবান নসিহত করেন। প্রিয় নবী বলেছেন এ মাদ্‌রাসার ভার তিনি নিজেই নিয়েছেন। সোবহানাল্লাহ, ইয়ে কিস্‌তিয়ে নুহ (.) হ্যায়। হযরত নূহ আলায়হিস্‌ সালামএর কিসতি সদৃশ, এ মাদ্‌রাসার খেদমত যারা করবে তারা ঐ কিসতির যাত্রীদের মতো মুক্তি পাবে। হুজুর আরো বলেন ‘মুঝে দেখনা হ্যায়তো, মাদ্‌রাসাকো দেখো’ ‘মুঝছে মহব্বত হ্যায়তো মাদ্‌রাসাকো মহব্বত করো’ ‘মাদরাসা কি লিয়ে মান্নত করো, মান্নাত পুরো হোনেছে ওয়াদা পুরো করো।’ ‘চেনাঅচেনা হাজার হাজার নবী অলী প্রেমিক আল্লাহর বান্দা লক্ষ লক্ষ টাকা দান খয়রাত করে যাচ্ছে এবং তাদের মনোবাঞ্ছা পূরণ করছে।’ মসলকে আলা হযরত এর আক্বীদার উপর এই মাদ্‌রাসার কার্যক্রম বিস্তৃত। এখানকার শিক্ষার্থীরা একজন খাঁটি নবী অলী প্রেমিক হয়ে দেশ দেশান্তরে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত এর পক্ষে জেহাদ করে যাচ্ছে।

প্রিয় দৌহিত্র্য আওলাদে রসুল গাউসে জমান হযরতুল আল্লামা আলহাজ্ব সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্‌ (মাদ্দাজিল্লুহুল আলী)কে সাথে নিয়ে হুজুর ১৯৫৮ সালে চট্টগ্রাম সফরে আসেন (এটা ছিল হুজুরের শেস সফর)। প্রায় সাত মাস চট্টগ্রামে অবস্থান করে ৩০/৩৫ জন মুরীদান সঙ্গে করে হুজুর প্রিয় নাতিসহ জাহাজযোগে হজ্ব পালনার্থে জেদ্দার উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম ত্যাগ করেন। বহু বছর পর হুজুর পুনর্বার হজ্বে গেলেন। এটাই ছিল হুজুরের শেষ সফর।

১৯৬০ সালে ইঞ্জিনিয়ার আলহাজ্ব মুহাম্মদ আবদুল খালেক, আলহাজ্ব নুর মুহাম্মদ সওদাগর আলকাদেরী, আলহাজ্ব ডা. টি হোসেন, হাজী আবুল বশর, আলহাজ্ব আমিনুর রহমান সওদাগর, আলহাজ্ব আকরাম আলী খান, আলহাজ্ব নুরুল ইসলাম সওদাগর, ফজলুর রহমান হুজুরকে আনতে সিরিকোট শরীফ যান। শারীরিক দুর্বলতার কারণে হুজুর আসতে পারেননি। হুজুর ভাইদের বলেছিলেন ‘ওপরওয়ালাকো হুকুম মিলনে ছে জরুর জাউঙ্গা’, লেকিন যানে কো হুকুম নেহী হ্যায়।’’ অনেক কান্নাকাটি করে ভাইয়েরা চট্টগ্রাম ফিরে আসেন। হুজুর ১৯৬১ সালের ২২ মে মোতাবেক ১১ই জিলক্বদ লক্ষ লক্ষ পীর ভাইদের শোক সাগরে ভাসিয়ে অন্তিম শয়ানে অবগাহন করেন। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন)

হুজুর ক্বিবলার সবচেয়ে বড় কারামত এই জামেয়া। হুজুর ক্বিবলার সালানা ওরস মোবারকের প্রাক্কালে গভীর প্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি এ মহান রাহবার আমাদের সকলের প্রাণপ্রিয় মুর্শিদকে, আমরা তাঁর নেগাহকরম কামনা করছি, করুণাময়ের দরবারে প্রার্থনা, তিনি যেন আমাদের হুজুর ক্বিবলার নির্দেশিত পথে চলার তওফিক দিন।

লেখক:প্রেস এণ্ড পাবলিকেশন

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধশত্রুর মুখে ছাই ঢেলে পদ্মা সেতু : শেখ হাসিনার ঐতিহাসিক সাফল্য