হট্টগোলে সিদ্ধান্ত ছাড়া জাহাজ মালিকদের বৈঠক শেষ

বিডব্লিউটিসিসির কার্যক্রম শুরু হয়নি চট্টগ্রামের কয়েকজন আমদানিকারকের প্রতিনিধি ও কার্গো এজেন্টকে লাঞ্ছিত করার অভিযোগ

হাসান আকবর | শুক্রবার , ২৫ অক্টোবর, ২০২৪ at ৬:০৩ পূর্বাহ্ণ

ব্যাপক হট্টগোল এবং হৈ চৈ’র মধ্য দিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়েছে লাইটারেজ জাহাজ মালিকদের তিনটি সংগঠনের বৈঠক। একই সাথে সদ্য প্রণীত নীতিমালায় সিরিয়াল প্রথা প্রবর্তনসহ জাহাজ চলাচলে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে গঠন করা বাংলাদেশ ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কোঅর্ডিনেশন সেল বা বিডব্লিউটিসিসির কার্যক্রম শুরুর উদ্যোগও সফল হয়নি। জাহাজ ভাড়া দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে যাওয়াসহ নীতিমালার বেশ কিছু বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে চট্টগ্রামের জাহাজ মালিকেরা সংশোধিত নীতিমালা প্রণয়নের দাবি জানান। তারা সভাস্থল থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের আহ্বানে সভা শেষ হওয়া পর্যন্ত অবস্থান করলেও তারা পরবর্তী নির্ধারিত বৈঠক বয়কট করে চলে আসেন। চট্টগ্রামের কয়েকজন আমদানিকারকের প্রতিনিধি ও কার্গো এজেন্টকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করারও অভিযোগ করা হয়েছে। অপরদিকে ঢাকার জাহাজ মালিকদের অনেকেই সিরিয়াল প্রথায় নিজেদের জাহাজ তালিকাভুক্ত করছেন বলে জানিয়ে সূত্র বলেছে, আরো আলাপ আলোচনার পর বিভিন্ন বিষয় চূড়ান্ত করে বিডব্লিউটিসিসির কার্যক্রম শুরু করা হবে। সূত্র বলেছে, চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর থেকে বছরে অন্তত দশ কোটি টন পণ্য হ্যান্ডলিংয়ে নিয়োজিত প্রায় ১৮শ’ বেসরকারি লাইটারেজ জাহাজ চলাচলে সিরিয়াল প্রথা বাস্তবায়নের জন্য সম্প্রতি একটি নীতিমালা জারি করে সরকার। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল (ডব্লিউটিসি) বিলুপ্ত করে লাইটারেজ জাহাজ মালিকদের তিনটি সংগঠন যথা বাংলাদেশ কার্গো ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন (বিসিভোয়া), কোস্টাল ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন (কোয়াব) এবং ইনল্যান্ড ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন অব চিটাগাং (আইভোয়াক) এর সমন্বয়েই বিডব্লিউটিসিসি গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়। গতকাল উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকের মাধ্যমে নতুন এই সংগঠনের কার্যক্রম শুরুর কথা ছিল। শুরুতে বৈঠক অনুষ্ঠানের কথা ছিল সাবেক ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের আগ্রাবাদস্থ কার্যালয়ে। কিন্তু চট্টগ্রামের জাহাজ মালিকদের আপত্তির মুখে একদিন আগে সভাস্থল পরিবর্তন করে নিয়ে যাওয়া হয় সীম্যান্স হোস্টেলে। সেখানে গতকাল বিকেল ২টা নাগাদ শুরু হয় সভার কার্যক্রম। নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর মাকসুদ আলম সভায় সভাপতিত্ব করেন।

বৈঠকে জাহাজ মালিকদের নেতৃবৃন্দ ছাড়াও চট্টগ্রাম বন্দর এবং কাস্টমসের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সভায় বিডব্লিউটিসিসি গঠনের গুরুত্ব, প্রেক্ষাপট এবং প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ এবং বিভিন্ন বিষয়ের উপর আলোকপাত করে বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়। জাহাজ মালিকদের সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বৈঠকে বক্তব্য রাখেন।

বৈঠকে নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর মাকসুদ আলম সদ্য প্রণীত বিধিমালার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন এবং গতকাল থেকে বিডব্লিউটিসিসির কার্যক্রম শুরু করতে জাহাজ মালিকসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি জোরালো আহ্বান জানান। তিনি কাউকে কোনো ধরনের অনৈতিক কাজ না করার জন্যও আহ্বান জানান। বিশেষ করে শিল্প মালিকদের জাহাজ ভাড়া নিয়ে নিজেদের পণ্য পরিবহন করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান তিনি।

সভার এক পর্যায়ে কার্গো এজেন্টদের পক্ষ থেকে শেখ জাহাঙ্গীর আলম বিডব্লিউটিসিসি’র কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করা, পণ্য পরিবহন ভাড়া নির্ধারণ করা এবং ত্রিপক্ষীয় চুক্তি নামা সম্পাদন করার ব্যাপারে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, পণ্য পরিবহনের ভাড়া নির্ধারণ ব্যতিরেকে বিডব্লিউটিসিসির কার্যক্রম শুরু কিংবা সিরিয়াল প্রথা চালু করা সম্ভব হবে না। চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর থেকে প্রতি টন পণ্য পরিবহনে কোন দূরত্বের জন্য কত করে ভাড়া আদায় করা হবে তা আগেভাগে নির্ধারিত না হলে জাহাজ মালিক কিংবা আমদানিকারকেরা কিভাবে সিরিয়াল প্রথা অনুসরণ করবেন?

এ ব্যাপারে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর মাসকুদ আলম সভায় বলেন, সরকার কর্তৃক চট্টগ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জ সাইলো পর্যন্ত একটি রেট নির্ধারণ করা আছে। চট্টগ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জের ভাড়া ওই রেইটে নির্ধারণ করে ওই ভিত্তিতে অন্যান্য গন্তব্যের ভাড়া নির্ধারণ করা হবে। এই ব্যাপারে তিনি বিডব্লিউটিসিসির নেতৃবৃন্দকে পণ্য পরিবহন ভাড়া নির্ধারণ করতে বলেন। এই সময় পণ্যের এজেন্টদের পক্ষ থেকে বিস্ময় প্রকাশ করে বলা হয়, চট্টগ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত সরকারের গম পরিবহন রেইট এক হাজার ২৪ টাকা। এরমধ্যে ভ্যাট ট্যাঙ এবং তিনগুণ ক্ষতিপূরণসহ বিভিন্ন বিষয় জড়িত রয়েছে। পণ্যের এজেন্টেরা বলেন, বর্তমানে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার ভাড়া প্রতিটন ৪২০টাকা। ইতোপূর্বে ডব্লিউটিসি এই ভাড়া নির্ধারণ করেছিলো ৫৭৪ টাকা। সেই ৪২০ টাকার ভাড়া এক হাজার ২৪ টাকা করার কথা শুনে তারা বিস্ময় প্রকাশ করেন বলেও জানান। তারা তাদের বিস্ময়ের কথা উল্লেখ করে দেশের আমদানি বাণিজ্য যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য ভাড়ার ব্যাপারটি আগেভাগে ঠিক করার অনুরোধ জানালে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বিষয়টি ঠিকঠাক করে নেয়ার জন্য বিডব্লিউটিসিসি নেতৃবৃন্দকে অনুরোধ করেন।

সভায় আইভোয়াকের মুখপাত্র পারভেজ আহমেদ বিধিমালার বিভিন্ন অসংগতির কথা তুলে ধরেন। বিশেষ করে বাংলাদেশের যে সমস্ত মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি এবং বিদেশি সিমেন্ট কোম্পানি পরিচালনা করে তাদের পণ্য পরিবহনের বিষয়ে নীতিমালায় পরিষ্কারভাবে কিছু উল্লেখ না থাকার বিষয়টি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এর কারণে বিদেশি কোম্পানিগুলো বৈষম্যের শিকার হবে এবং তারা ব্যবসা করতে পারবে না।

নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বিষয়টি নিয়ে আলাদাভাবে মিটিং করবেন বলে মৌখিকভাবে আশ্বস্ত করেন।

সভায় ভাড়াসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যখন কিছুটা অস্বস্তি দেখা দেয় তখন জাহাজ মালিকদের সংগঠন বিসিভোয়া’র সভাপতি সাঈদ আহমেদ টেবিল চাপড়িয়ে আজকে থেকেই সিরিয়াল প্রথা চালু করা হবে বলে ঘোষণা দেন এবং আজকে থেকে সিরিয়াল প্রথা চালু করব এবং আপনাদেরকেও এটা মেনে নিতে হবে বলে ধমকের সুরে বক্তব্য রাখেন।

বিসিভোয়া সভাপতির বক্তব্যের পর সভার পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠে। এই সময় আইভোয়াক নেতৃবৃন্দ, চট্টগ্রামের জাহাজ মালিক, সদস্যবৃন্দ, পণ্যের এজেন্ট, লোকাল এজেন্টসহ সকলেই সভাস্থল ত্যাগ করে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হন। ওই সময় নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সকলকে সভায় থাকা এবং তার বক্তব্য শোনার আহ্বান জানালে চট্টগ্রামের জাহাজ মালিকসহ অন্যান্যরা সভাস্থলে অবস্থান করেন। সভা শেষে চলে আসার সময় হোস্টেলের সামনে চট্টগ্রামের জাহাজ মালিকদের সাথে পুনরায় হট্টগোল শুরু হয় এবং ওই সময় চট্টগ্রামের কয়েকজন কার্গো এজেন্ট নেতৃবৃন্দকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয় বলেও লিখিতভাবে অভিযোগ করা হয়েছে। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আইভোয়াক নেতৃবৃন্দ সিরিয়াল প্রথা বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন।

বিষয়টি নিয়ে আইভোয়াকের মুখপাত্র পারভেজ আহমেদ গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, বৈঠক হয়েছে। তবে আমরা পরবর্তী বৈঠক বয়কট করেছি। আমাদের সাথে ভালো আচরণ করা হয়নি। নীতিমালা সংশোধনের ব্যাপারেও আমরা সুস্পষ্ট কোনো ঘোষণা পাইনি। নীতিমালা সংশোধন ছাড়া বিডব্লিউটিসিসি চালু করা হলে কেউ সুফল পাবে না বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, আইভোয়াক পুরো বিষয়টি নিয়ে আজ সকাল ১১টায় জরুরি বৈঠক আহ্বান করেছে। ওই বৈঠকে আমরা পরবর্তী করণীয় নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবো।

বিষয়টি নিয়ে ডব্লিউটিসিসির অন্যতম নেতা এবং বাংলাদেশ কার্গো ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মেহবুব কবির গতকাল দৈনিক আজাদীর সাথে আলাপকালে বলেন, আজ (গতকাল) বৈঠক হয়েছে। আমরা সিরিয়াল নেয়া শুরু করেছি। আজ আমাদেরকে ৪২৩টি জাহাজের সিরিয়ালভুক্ত করা হয়েছে। তবে আমরা কোনো জাহাজ বরাদ্দ শুরু করিনি। বিডব্লিউটিসিসির কার্যক্রম শুরু করতে আরো একটু সময় লাগবে। তিনি বলেন, জাহাজ মালিকদের তিনটি সংগঠনের সমন্বয়ে বিডব্লিউটিসিসি গঠিত এবং পরিচালিত হবে। এরমধ্যে আইভোয়াকের সাথে কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এগুলো অচিরেই ঘুছে যাবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, কিছু ভুল বুঝাবুঝি আছে, এগুলো আমরা ঠিক করে নেবো। তবে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন রুটে পণ্য পরিবহন, জাহাজ মালিক এবং আমদানি বাণিজ্যের স্বার্থে এর কোনো বিকল্প নেই বলেও ইঞ্জিনিয়ার মেহবুব কবির মন্তব্য করেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমেয়র পদে শাহাদাতের শপথ ৩ নভেম্বর
পরবর্তী নিবন্ধকক্সবাজার স্পেশাল ট্রেনের লোকোমাস্টার বরখাস্ত