আমরা জানি ইসলাম ধর্মের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে হজ্ব হচ্ছে শারীরিক ও আর্থিক ইবাদত। এখানে অর্থ ছাড়াও কঠোর পরিশ্রম এবং ধৈর্যের প্রয়োজন হয়। ঈমান, নামাজ ও রোজা শারীরিক ইবাদত হলেও এতে কোনো পরিশ্রম নেই বললেই চলে। কিন্তু মূল হজ্বের পাঁচ দিন হাজী সাহেবদের কী পরিমাণ পরিশ্রম করতে হয় তা ভাষায় বর্ণনাতীত। আমাদের দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বয়স্ক লোকেরাই হজ্ব করে থাকেন। এতে তাদের পক্ষে হজ্বের সমস্ত আরকান আহকাম যথার্থভাবে অনেকসময় পালন করা সম্ভব হয় না। তাই সামর্থ্য থাকলে আমাদের দেশের যুব সমপ্রদায়ের বয়স থাকতেই হজ্ব করা শ্রেয়।
বয়স সীমা তুলে দেয়ায় এ বছর প্রায় পঁচিশ লাখের বেশি লোক হজ্ব পালন করেছেন। মতান্তরে আরো কয়েক লক্ষ বেশি। কিন্তু সে তুলনায় মিনা ও আরাফাতের ময়দানে প্রদত্ত সুযোগ সুবিধা খুবই অপ্রতুল। ভালো দিক হলো আরাফাতের ময়দানে তাঁবুতে প্রচুর শীতাতপ যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছে। যদিওবা দিনের প্রচণ্ড তাপে এগুলো মনে হয়েছে অকার্যকর। তাছাড়া লক্ষ লক্ষ হাজী খোলা আকাশের নিচে প্রচণ্ড তাপদাহে দাঁড়িয়ে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল ছিলেন। বিকেলে আমরা অনেকেই তাবু থেকে বের হয়ে খোলা আকাশের নিচে যে যেভাবে পেরেছি মহান আল্লাহ তালার সন্তুষ্টির জন্য প্রার্থনায় নিমগ্ন ছিলাম। দশসালে যখন প্রথম হজ্ব করেছিলাম তখন আরাফাতে ছিল সাধারণ তাবু। শীতকাল থাকায় তখন তেমন গরম অনুভব হয় নি। আরাফাতে এবং মিনায় প্রথম সমস্যা হচ্ছে টয়লেট, অযু এবং গোসলের ব্যবস্থাপনায়। সৌদি কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করি।
উল্লেখযোগ্য যে তুরস্ক সহ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অর্থাৎ বাংলাদেশ, পাকিস্তান ভারত ইত্যাদি দেশের ক্যাম্পগুলো বরাদ্দ করা হয় মিনার সর্বশেষ পূর্ব প্রান্ত সারে জহর (জহর সড়ক) এলাকায়। মক্বা থেকে যেটার দূরত্ব প্রায় আট /নয় কিলোমিটার। আরাফাত থেকে বারো/তের কিলোমিটার। সাত তারিখ রাতে হাজীগণকে মক্বা থেকে বাসে করে মিনা ক্যাম্পে নেয়া হয় এবং আট তারিখ রাতে সেখান থেকে বাসে আরাফাতে নেয়া হয়। ঐদিন রাস্তায় বের হতে না পারায় হাজী সাহেবরা মিনায় রাস্তা ঘাট চেনার সুযোগ পান না। ওকুপে আরাফাহ শেষে সূর্য অস্তের পর খোলা আকাশের নিচে রাত্রি অবস্থানের জন্য হাজীগণকে মোজদালিফায় আসতে হয়। চুক্তি অনুযায়ী আরাফাত থেকেও কাফেলা কর্তৃপক্ষকে বাসের ব্যবস্থা করতে হয়। কিন্তু সে সময় বাস থাকে অপ্রতুল। গাদাগাদি করে বাসে উঠতে হয়। বাসে চড়লেও বাসের চাকা ঘুরে না। আমরা যেখান থেকে বাসে চেপেছিলাম সেখানেই রাত দশটা পর্যন্ত তিন ঘণ্টা একনাগাড়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। জ্যামের কারণে স্টেশন থেকে বাস ছাড়তে পারছিল না। এরপর প্রায় চার ঘণ্টায় আমরা মোজদালিফায় পৌঁছাই। মহিলা এবং তাদের মাহরামদের সিটে বসার সুযোগ দেয়ায় আমি সহ অনেক হাজীকে একনাগাড়ে সাত ঘণ্টা দাঁড়িয়ে মোজদালিফায় পৌঁছাতে হয়।
এই ব্যাপারে ভবিষ্যতে যে সমস্ত যুবক, মধ্য বয়স্ক বা শারীরিকভাবে শক্ত ষাটের কাছাকাছি বয়স্ক ব্যক্তি হজ্ব করতে আসবেন তাদেরকে বলব আরাফাত থেকে হেঁটে আসতে পারলে সবচেয়ে সহজ। লক্ষ লক্ষ হাজী হেঁটে আসেন। দশ সালে বাসের জন্য অপেক্ষা না করে আমিসহ আমাদের কাফেলার প্রায় পঁচিশ/ত্রিশ জন হাজী আড়াই ঘণ্টায় আরাফাত থেকে হেঁটে মোজদালিফায় পৌঁছেছিলাম। সেখানে মাগরিব ও এশার নামাজ আদায় করে খোলা আকাশের নিচে দীর্ঘক্ষণ ঘুমাতে পেরেছিলাম। মোজদালিফায় সকালে ফজরের নামাজ পড়ে আবার হাঁটা শুরু করে দু‘ঘণ্টায় আমরা জামারাতে পাথর নিক্ষেপ করে মিনার তাঁবুতে ফিরে এসেছিলাম। পরের দু‘দিনও আবার পায়ে হেঁটে জামারায় পাথর ছুড়ে তাওয়াফ সাই শেষে মিনায় ফিরে এসেছিলাম।
মিনায় চারদিকে হাজার হাজার ক্যাম্প। আগেই উল্লেখ করেছি মিনায় হাজীদের রোড সম্পর্কে ধারণা না থাকায় জামারাহ ও মক্বা থেকে ফিরার পথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটেও বেশির ভাগ হাজী নিজের তাবু খুঁজে পান না। সেখানে মোড়ে মোড়ে পাহারাদার/পুলিশ থাকলেও তারা কিছুই বুঝে না এবং ক্যাম্পের হদিস দিতে পারে না। দু‘জন মহিলাসহ আমরা পাঁচ জনের একটি গ্রুপ মক্বায় তাওয়াফ এবং সাই শেষে রাত একটায় একটি কারে রওনা দিয়ে অনেক ঘুরাঘুরি করে একটি নির্দিষ্ট স্থানে নেমে যাই। আমরা জানতাম সেখান থেকে আমাদের ক্যাম্প এক কিলোমিটারের মধ্যে। এদিক ওদিক দু‘ ঘণ্টা হেঁটেও আমরা ক্যাম্প খুঁজে পাইনি। পরে আল ওয়াদী নামক একটি হাসপাতালের সামনে বসে থেকে ফজরের নামাজ আদায় করে কাফেলার লোককে ফোন করলে তিনি এসে আমাদেরকে নিয়ে যান।একই অভিজ্ঞতা সব কাফেলার বেশিরভাগ হাজীর। অথচ পরের দু‘ দিন সোজা রাস্তায় মিনা থেকে জামারা এবং জামারা থেকে মিনায় পায়ে হেঁটে আসতে কোনো হাজীর অসুবিধা হয়নি। উল্লেখযোগ্য যে মিনায় হজ্বের সময় প্রাইভেট গাডড়ি ঢুকতে দেয়া হয় না। কেহ দূরে গিয়ে গাড়ি নিলে দুর্গতি আরো বেশি হয়। মিনায় কিছুদূর পরপর লম্বা খুঁটিতে নাম্বার দেয়া আছে। যেমন আমদের খুঁটি নাম্বার ৬৮/৮০। দ্বিতীয় দিন জামারাতে যাওয়ার সময় বুঝলাম ৬৮ মানে কিং ফাহাদ ৬৮ নং রোড যেটি জামারা থেকে শুরু হয়ে আমাদের ক্যাম্পের সামনে দিয়ে সোজা পূর্ব দিকে চলে গেছে। ৮০ মানে জোন অনুসারে ক্রমিক নাম্বার। প্রতিটি রাস্তায় জোন নাম্বার ও মোয়াল্লেম এর নাম্বার বাইরে লেখা থাকে। প্রতি মোয়াল্লেম এর অধীনে যতগুলো কাফেলা থাকে তাদের সবাইর সব ক্যাম্প সাধারণত এক জায়গায় হয়। কাফেলা কর্তৃপক্ষ প্রথম দিন মিনার তাঁবুতে পৌঁছে হাজীগণকে এই বিষয়ে পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিলে হাজীদের পথ হারানোর সম্ভাবনা বহুলাংশে হ্রাস পাবে এবং হাজীদের ভোগান্তি অনেক কম হবে।
বাংলাদেশের প্রয়াত প্রকৌশলী মো. ইব্রাহীম এর প্রণীত নকশায় চার তলা বিশিষ্ট জামারার নতুন নির্মাণশৈলী খুবই মনোমুগ্ধকর। প্রতিটি এলাকা থেকে সুশৃঙ্খলভাবে জামারায় এক পথে ঢুকে ভিন্ন পথে খুবই সহজে বের হওয়া যায়। কোনভাবেই একপথের হাজীকে ভুলক্রমে অন্য পথে যাওয়ার সুযোগ নেই। জামারায় নিয়োজিত পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা খুবই চৌকস। তারা হাজীদের ভীড় এড়িয়ে সুষ্ঠুভাবে প্রবেশ ও প্রস্থানে সার্বক্ষণিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন। আরো প্রশংসনীয় দিক হচ্ছে চলার পথে তারা বিভিন্ন স্থানে হাজীগণের গায়ে পানি ছিটিয়ে সিক্ত করছে এবং আল্লাহু আকবার মারহাবা ইত্যাদি ধ্বনি দিয়ে হাজীদের বরণ করছে।
এই লেখার প্রারম্ভে উল্লেখ করেছি বহু পরিচিত হাজী চট্টগ্রামের কাফেলাগুলোর অনেক গাফিলতি কার্যক্রম এবং মাত্রাতিরিক্ত টাকা আদায়ের ব্যাপারে চট্টগ্রামের পত্রিকাগুলোতে নিউজ করার জন্য আমাকে অনুরোধ জানিয়েছেন। আসলে যারা হজ্ব করতে আসেন সেখানে বিভিন্ন শ্রেণি ও বিভিন্ন পেশার লোক থাকে। তাদের রুচি ও মন মানসিকতা ভিন্ন হয়ে থাকে। স্বাভাবিক কারণে সবার চাহিদার সমন্নয় করতে কাফেলা কর্তৃপক্ষকে বেগ পেতে হয়।এ ছাড়া রয়েছে ভিন্ন দেশে পরিস্থিতি ও পরিবেশ এর কারণে সীমাবদ্ধতা। এরপরেও অতি মুনাফার লোভে কিছু কিছু কাফেলার ইচ্ছাকৃতভাবে গাফিলতি কার্যক্রম হাজীগণকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। যার কারণে বিভিন্ন কাফেলায় বিক্ষুব্ধ হাজীদের মধ্যে বচসায় লিপ্ত হতেও দেখা যায়। এক্ষেত্রে উভয় পক্ষকে অসীম ধৈর্য্য, সংযম ও সহনশীলতার পরিচয় দিতে হবে। মনে রাখতে হবে যারা হজ্ব করতে এসেছেন তাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর ইবাদত। অন্যগুলো গৌণ। আর কাফেলা কর্তৃপক্ষকে অতি ব্যবসায়িক মনোভাব পরিহার করে তাদের কমিটমেন্ট অনুযায়ী হাজী সাহেবদের আন্তরিক সেবা প্রদান করা ঈমানী দায়িত্ব।
চট্টগ্রামের কাফেলাগুলোর বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে তারা হাজীদের নিকট থেকে প্যাকেজ মূল্য খুব বেশি আদায় করেছে। চট্টগ্রামের স্বনামধন্য বেশ কিছু কাফেলার সাধারণ প্যাকেজ মূল্য ছিল কারো সাত লাখ, কারো সাত লাখ পঁচিশ, কারো সাড়ে সাত লাখ বা সাত লাখ ষাট/ সত্তর/আশি হাজার টাকা। পক্ষান্তরে একই স্থানে একই মানের বা একই হোটেলে অবস্থান করা বিভিন্ন হাজী সাহেবদের জিজ্ঞাসা করে জানা গেছে তাদের প্যাকেজ মূল্য কারো ছয় লাখ ষাট হাজার বা সত্তর হাজার। আমরা চল্লিশ/বিয়াল্লিশ দিন মক্বা ও মদিনায় অবস্থানের সময় প্রতিদিন বিভিন্ন জেলার গড়ে ২/৩জন হাজীর সাথে কথা বলেছি। তারা কে কোথায় কত টাকা প্যাকেজে এসেছেন তা থেকে জানা যায় সবাই ছয় লাখ ষাট হাজার টাকা প্যাকেজে এসেছেন। আমাদের হোটেলে একই সুযোগ সুবিধায় অবস্থানরত সিলেট এবং অন্যান্য জেলার হাজী সাহেবদের নিকট নেয়া হয়েছে ছয় লাখ ষাট হাজার টাকা। অথচ আমাদের নিকট থেকে নেয়া হয়েছে সাত লাখ পঁচিশ হাজার টাকা করে। তবে মক্বা ও মদিনায় তুলনামূলকভাবে আমাদের হোটেলের মান বেশ ভালো ছিল। চট্টগ্রামের এই কাফেলা সমূহ হাজীদের জিম্মি করে অন্যান্য জেলার তুলনায় প্রতিজন হাজী থেকে ৫০ থেকে ৮০ হাজার টাকা অতিরিক্ত আদায় করেছে। এই মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা আদায়ে চট্টগ্রামের হাজীগণ তাদের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তারা অনেকেই আদায়কৃত অতিরিক্ত টাকা ফেরত দাবী করেছেন।
পরিশেষে মহান আল্লাহতালার নিকট প্রার্থনা তিনি যেন এই বছর যারা হজ্ব পালন করেছেন তা মাবরুর হজ্ব হিসেবে কবুল করেন। যারা এখনো মক্বা ও মদিনায় অবস্থান করছেন তাদের সুস্বাস্থ্য ও নিরাপদ ফেরত কামনা করছি।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক, বাংলাদেশ রেলওয়ে।