হজরত শাহ সূফী আমানত খান (রহ.)

আমানউদ্দীন আবদুল্লাহ | শনিবার , ৮ জুন, ২০২৪ at ১০:৪৪ পূর্বাহ্ণ

সম্রাট আওরঙ্গজেব এর সময় বিভিন্ন ধর্মপ্রচারকগণ রাজনীতির প্রচ্ছায়ায় সমাজপতিদের তুষ্ট রেখে ধর্মীয় প্রচারণায় নেমে পড়েন। এতে ইসলামের বেঁচে থাকার প্রশ্ন দেখা দেয়। সূফী সাধকরা ইসলাম রক্ষায় বিচলিত হলেন। এহেন পরিস্থিতিতে সূফীগণ ভারতবর্ষের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লেন। মূলতঃ প্রায় মুসলমান রাজন্যবর্গ ইসলাম প্রচারের চাইতে রাজ্য দখলকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন।

কাশ্মীর, পাটনা, লক্ষ্ণৌ এবং মুর্শিদাবাদ তখন সূফীদের কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র ছিলো। এ সমস্ত এলাকা থেকে সূফীগণ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রেরিত হতেন। কোন এক সময় বড় পীর হজরত মহিউদ্দীন আবদুল কাদের জিলানী (কুঃ) এর বংশধররা বিহারে এসে বসতি স্থান করেছিলেন। মরমীবাদের ব্যাপক প্রচারণা খোদাপ্রেমিক পুরুষদের হৃদয়ে নাড়া দেয়। ফলে বড় পীর ছাহেবের বংশোদ্ভূত ত্যাগী পুরুষ হজরত শাহ্‌ সূফী আমানত (কুঃ) বিহার শরীফের নিজ পিত্রালয় ত্যাগ করে আধ্যাত্মিক জগতের আকুল ইশারায় আত্মিক জ্ঞানার্জনের জন্যে সুদূর কাশ্মীর চলে যান। উপযুক্ত মুর্শিদের খোঁজ করতে থাকলেন নীরবে। কাশ্মীরের জনৈক বুজর্গ ব্যক্তি তাঁকে হজরত আবদুর রহিম শহীদ (কুঃ) এর সন্ধান বলে দেন। তখন সূফী হাসান ওরফে হাবিবুল্লাহ (কুঃ) এর অন্যতম খলিফা হজরত আবদুর রহিম (কুঃ) এর নাম সর্বজন স্বীকৃতি পাচ্ছিলো। কোন এক ব্যক্তির কাছে জানতে পারলেন আবদুর রহিম শহীদ (কুঃ) লক্ষ্ণৌ অবস্থান করছেন। তাঁর এরূপ সুখ্যাতি শুনতে পেয়ে অথবা অন্তরের অনাবিল সুখনুসন্ধানের নিমিত্তে শাহ্‌ সূফী আমানত (কুঃ) কাশ্মীর ত্যাগ করলেন। লক্ষ্ণৌ এসে জানতে পারলেন মাত্র অল্পকাল হলো তিনি মুর্শিদাবাদ মকসুসাবাদ চলে গেছেন। মুর্শিদাবাদে তখন সূফীদের হাট বসেছে। এরপরে হজরত লক্ষ্ণৌ থেকে মুর্শিদাবাদে এসে পৌঁছলেন। অতঃপর প্রেমাস্পদ তাঁর প্রিয়তমের সন্ধান পেলেন। হজরত শহীদ (কুঃ) এর করুণা দৃষ্টি তাঁর’ পরে নিপতিত হলো। হজরত আবদুর রহিম শহীদ (কুঃ) এর কর চুম্বনের মাধ্যমে তিনি এলম মারিফাতে দীক্ষা গ্রহণ করলেন। সেই জ্যোতির্ময় পুরুষের সান্নিধ্য পেয়ে হজরত অত্যন্ত গৌরবান্বিত হলেন। মাত্র অল্পকাল মধ্যে তিনি মুর্শিদের সাহচর্যে থেকে এল্‌ম বাতেন শাস্ত্রে চরমোৎকর্ষতা লাভ করে অফুরন্ত নেয়ামত হাসিল করলেন। পীর ছাহেব বুঝতে পারলেন শাহ আমানতের অন্তর আল্লাহ প্রেমের জোয়ারে পরিপূর্ণ এবং রাব্বুল আলামিনের সাথে মিলনাকাঙ্ক্ষায় মন তাঁর উন্মুখ। এমন এক প্রেমাস্পদের সন্ধান পেয়ে মুর্শিদ অত্যন্ত আশান্বিত হলেন। একান্ত মনোযোগের সাথে তাঁকে আধ্যাত্মিক শিক্ষাদান করতে থাকেন। কথিত আছে যে, হজরত তদীয় মুর্শিদের খেদমতে প্রায় ১২ বৎসর অতিবাহিত করেছেন। হজরতের ঐশী ক্ষমতার ব্যাপকতা দর্শন করে মুর্শিদ তাঁকে কাদেরীয়া, চিশতীয়া, মাদারিয়া এবং নক্‌শবন্দীয়া মুজাদ্দেদীয়া তরীকার খেলাফত প্রদান করতঃ বিবাহিত জীবন যাপনের মাধ্যমে হালাল উপায়ে উপার্জন করার উপদেশ দিয়ে চট্টগ্রাম যেতে নির্দেশ দিলেন। ১৬৯৯ খ্রিস্টাব্দে হজরত শহীদ (কুঃ) নিজেও মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করে ঢাকা তশরিফ নিয়ে এলেন। চট্টগ্রামের আত্মিক জগতের কর্তৃত্বের ভার গ্রহণ করে শাহ্‌ সূফী আমানত খান (কুঃ) অত্যন্ত ধন্য হলেন। চট্টগ্রাম শহরে এসে তিনি আদালতে সামান্য একটি চাকরি জুটিয়ে নিলেন অতঃপর দিনের বেলায় তিনি আদালতের কাজে এবং রাত্রি বেলায় আধ্যাত্মিক সাধনায় ব্যাপৃত হলেন। পার্থিব জগতের মায়া মমতা তাঁকে আর গৃহাভিমুখী করতে পারলো না।

লালদীঘি অঞ্চলে ঘন অরণ্যরাজির ভিতর নীরবে প্রভুর আরাধনা করতেন হজরত শাহ সূফী আমানত খান (কুঃ)। কুঠিরে তখন নির্জন আঁধার ছিলো তাঁর সহচর। মৌনতা, সরলতা এবং বিশ্বস্ততার কারণে স্থানীয় জনসাধারণের কাছে তিনি ‘মিয়া ছাহেব’ নামে পরিচিত ছিলেন। কেউবা তাঁকে খান ছাহেব বলে সম্বোধন করতেন। উৎসাহী ব্যক্তিদের তিনি ক্ষুদ্র কুঠিরে আহ্বান করতেন এবং শরীয়তের শিক্ষা ছাড়াও তাঁদের এক প্রকার রহস্যপূর্ণ জ্ঞানের সন্ধান দান করতেন। এ জ্ঞানকে বলা হয় এলমে তাসাউফ। কর্মক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ এবং নিরলস কর্মী। কোন প্রকার শিথিলতা ব্যতীত প্রতিদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত তিনি আদালতে কাজ করতেন। আদালতের সামান্য চাকুরী গ্রহণ করে তিনি বড় ছোট ভেদাভেদ তুলে দিয়ে ইসলামের সাম্যতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন। আধ্যাত্মিক জগতের এতবড় সূফী হয়েও তিনি পার্থিব প্রতিপত্তির মোহে আচ্ছন্ন হননি। যদিও সহজ সরল অমায়িক লোক বলে তাঁর খ্যাতি ছিলো তথাপি ইসলামী ভাবধারার বিরুদ্ধে কোন মতামতকে তিনি প্রশ্রয় দিতেন না। উপরস্থ কর্তাব্যক্তি অনেক সময় তাঁর প্রতি অপ্রিয় ব্যবহার করতেন। কিন্তু পার্থিব জীবনের দুঃখ কষ্ট তাঁকে তেমন ভয় দেখাতে পারেনি যতদূর পেরেছে পরকালের শাস্তিচিন্তা। বস্তুতঃ শফিঈল মুজনেবীন হজরত মুহাম্মদ (দঃ) এর অনুসারীগণ সর্বদাই পার্থিব ভোগ বিলাসকে এড়িয়ে চলতে ভালো বাসতেন। অধিক রাত্রি পর্যন্ত জেগে থেকে তিনি বিশ্ব নিয়ন্তার কাছে মুনাজাতে মগ্ন থাকতেন। আদালতের কর্মজীবন তাঁকে সুন্নতের পায়রবী করতে সাহায্য করেছে। খেটে জীবিকার্জনের মাধ্যমে খোদার স্মরণে ব্যাপৃত থাকা পরবর্তীকালে অনেক সূফীর জন্যে শিক্ষণীয় হয়ে রইলো।

বাংলাদেশের মুসলমান হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, সকলেই তাঁর সমাধিতে মনের আকুতি নিবেদন করে। শাহ সূফী আমানত খান (.) তাই সাধারণ মিয়া ছাহেবের গন্ডি পেরিয়ে এখন একজন ঐশ্বরিক ত্রাণকর্তা। তাঁর সমাধিতে খুশবুদার রঙ্গিন গিলাফ মোড়ানো মকবরার সৌরভে মাতোয়ারা হয়েছে ভক্তকুল। যিনি যত বেশী প্রেমিক তিনি তত বেশী রূহানী ফয়েজ লাভ করতে পারেন। প্রিয়জনের মৃত্যুবার্ষিকীতে যেমন প্রেমিক প্রবর পাগল প্রায় দিশেহারা হয়ে পড়েন তেমনি হজরতের ভক্তরা তাঁর পবিত্র ওরশ শরীফে এসে অসীম শ্রদ্ধায় রোদন করতে থাকেন। এমন একদিন ছিলো যেদিন তিনি হাকিম ছাহেবের পাখা টেনে দিনাতিপাত করতেন। আজ তিনি অসহায় দুঃখপীড়িত ভক্তবৃন্দের পোড়ামনে শান্তির পাখা টেনে স্বর্গীয় সুখ দান করে চলেছেন।

জাগতিক ও আধ্যাত্মিক যে কোন পর্যায়ের মনস্কামনা পূরণের উছিলায় জাতি, ধর্ম, বর্ণ,নির্বিশেষে সকল শ্রেণির জনগোষ্ঠীর জন্যে অহোরাত্র অবারিত এই সর্বজনীন দরগাহ শরীফ। দেশিবিদেশি পর্যটকগণ চট্টগ্রাম সফরে এলে তাঁর সমাধি দর্শন করে আত্মতৃপ্তি লাভ করে থাকেন। শতাব্দীকাল ধরে এখানে হজরতের ভক্তদের জন্যে দু’বেলা লঙ্গর চালু রয়েছে। শহর চট্টগ্রাম এবং চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা তাঁর পূণ্যস্মৃতি বহন করে চলেছে। এর মধ্যে সবিশেষে উল্লেখযোগ্য হলো দক্ষিণ চট্টগ্রামমুখী সড়ক পথের গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ কর্ণফুলী নদীর উপর নির্মিত শাহ আমানত সেতু, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের জন্যে নির্মিত শাহ আমানত হল এবং আকাশ পথে চট্টগ্রামের প্রবেশদ্বার শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর।

হজরত শাহ সূফী আমানত খান (.) এর একমাত্র পুত্র শাহজাদা মুহাম্মদ আনোয়ার খান তদীয় পিতার স্মৃতি রক্ষার্থে এবং নিজ পরিবারের ভরণ পোষণের নিমিত্তে ১১ই বৈশাখ ১২০২ মঘী একখানা ব্যক্তিগত ওয়াক্‌ফ নামা সম্পাদন করেন। উক্ত ওয়াক্‌ফনামায় তিনি স্বীয় দুই পৌত্র যথাক্রমে আলিয়ার খান এবং আমানত খানকে উক্ত ওয়াক্‌ফ এস্টেটের মুতওয়াল্লী নিযুক্ত করেন। (আনোয়ার খানের একমাত্র পুত্র আলেফ খান পিতার জীবিত কালেই ইন্তেকাল করেন)। ওয়াক্‌ফ নামায় তিনি উল্লেখ করেছেন যে তাঁর পৌত্রদ্বয়ের ইন্তেকালের পরে তাঁদের পুত্রগণ এবং পরবর্তীকালে পৌত্র পৌত্রাদি পুরুষানুক্রমে বংশ পরম্পরায় মুতওয়াল্লী হিসাবে গণ্য হবেন। প্রতি বৎসর ১লা জিলহজ্ব হজরতের পবিত্র ওরশ শরীফ তাঁরই বংশধরগণের তত্ত্বাবধানে হজরতের রওজা শরীফ প্রাঙ্গণে অত্যন্ত ভাবগম্ভীর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

লেখক : প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধআনন্দে থাকুন, আনন্দে বাঁচুন
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে