ফুটপাত থেকে উচ্ছেদকৃত হকারদের পুনর্দখল রোধে চলা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) অভিযানে হামলা করেছে হকাররা। এ সময় অভিযানে অংশ নেয়া চসিকের একজন নির্বাহী ম্যজিস্ট্রেট, পাঁচ পুলিশ সদস্য, চসিকের স্ট্রাইকিং ফোর্সের এক সদস্য ও এক উচ্ছেদকর্মী আহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে পুলিশ ৪০ রাউন্ড টিয়ারসেল ও ফাঁকা গুলি ছোড়ে। এতে ছয় হকার আহত হওয়ার দাবি করেন হকার নেতৃবৃন্দ। সব মিলিয়ে উভয়পক্ষের ১৪/১৫ জন আহত হন। এছাড়া হকারদের ছোড়া ইটপাটকেলে বেশ কয়েকজন পথচারীও আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
গতকাল সোমবার বিকেল সোয়া চারটার দিকে নগরের কোতোয়ালী থানার স্টেশন রোড এলাকায় ঘটনার সূত্রপাত হয়। যা নিউ মার্কেট থেকে ফলমণ্ডিসহ আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় পুলিশ ও হকারদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। হকাররা চসিকের চারটি গাড়ি ভাঙচুর করে। এর মধ্যে দুটি ডাম্প ট্রাক, একটি পিকআপ ও চসিকের বিদ্যুৎ উপ–বিভাগের একটি এরিয়াল লিফট রয়েছে। এ ঘটনায় সাতজন হকার নেতার নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত ১২০০ জনকে আসামি করে কোতোয়ালী থানায় গত রাতে অভিযোগ দিয়েছে চসিক। এর বাদী হয়েছেন চসিকের স্পেশাল নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দপ্তরের পেশকার মো. আবু জাফর চৌধুরী।
জেনারেটর জব্দ নিয়ে ঘটনার সূত্রপাত : গত ৮ ফেব্রুয়রি আমতল থেকে নিউমার্কেট হয়ে ফলমণ্ডি পর্যন্ত অবৈধ হকার উচ্ছেদে অভিযান চালায় চসিক। ওইদিন সাড়ে চার হাজার হকার উচ্ছেদ করা হয়। ভেঙে দেয়া হয় অবৈধ দখলে নিয়ে হকারদের নির্মাণ করা বিভিন্ন স্থাপনা। উচ্ছেদ হওয়া ওসব জায়গা আবারো দখলে নেয় ভাসমান হকাররা। তাই পুনর্দখল রোধে গতকাল বিকেল সোয়া তিনটায় অভিযান শুরু করে চসিক। গতকালের অভিযানে অংশ নেন চসিকের তিন নির্বাহী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শাহরীন ফেরদৌসী, চৈতী সর্ববিদ্যা ও মো. সাব্বির রহমান সানি। অভিযানের এক পর্যায়ে সোয়া চারটার দিকে স্টেশন রোডের পাবলিক টয়লেটের পাশে হকারদের বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে স্থাপন করা একটি জেনারেটর জব্দ করা হয়। এসময় জেনারেটরের মালিক চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হকার সমিতি’র নেতা মাসুম উপস্থিত হলে তাকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এসময় মাসুম তাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে বলে হকারদের ‘উস্কানি’ দেয় বলে অভিযোগ করেন অভিযানে অংশ নেয়া চসিকের কর্মকর্তারা। এরপর অতর্কিতভাবে এসে হকাররা ইট–পাটকেল নিয়ে হামলা করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের উপর। হকাররা সিড়ি অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকে। এসময় আত্মরক্ষার্থে পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে লাটিচার্জ, টিয়ারসেল ও ফাঁকা গুলি ছুড়ে।
সংঘর্ষ চলাকালে নিউমার্কেট মোড় থেকে আমতল এবং কোতোয়ালি মোড় ও ফলমণ্ডির দিকে প্রায় আধাঘণ্টা যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। এ সময় পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। মার্কেটের ফটকও বন্ধ করে দেওয়া হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, চসিকের উচ্ছেদ অভিযান শুরু হওয়ার পর নিউমার্কেট মোড়ের উত্তরে মিউনিসিপ্যাল মডেল হাইস্কুলের সামনে পুনর্বাসন ছাড়া হকার উচ্ছেদের প্রতিবাদে সমাবেশ করছিল চট্টগ্রাম ফুটপাত হকার্স সমিতি। পুলিশের সাথে সংঘর্ষ শুরু হলে তারা গিয়ে হামলায় অংশ নেন। প্রায় ঘণ্টাব্যাপি সংঘর্ষের পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে পুলিশ। এ ছাড়া সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে প্রায় শতাধিক ভাসমান হকার উচ্ছেদ করে চসিক। এসময় হকারদের বিভিন্ন মালামালও জব্দ করা হয়।
আহতদের পরিচয় : কোতোয়ালী থানায় দেয়া চসিকের অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, ধাক্কাধাক্কি ও হুড়োহুড়িতে চসিকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট চৈতী সর্ববিদ্যা পায়ে আঘাত পান। এছাড়া চসিকের উচ্ছেদকর্মী রুহুল আমিন (৫০) ও স্ট্রাইকিং ফোর্সের সদস্য দীলিপ দাশ (৪৫) গুরুতর আহত হন। হামলাকারীদের নিক্ষিপ্ত ইট ও পাথরের টুকরো তাদের মাথা ও চোখেমুখে পড়ে। তাদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অভিযোগে বলা হয়, পরিকল্পিতভাবে দলবদ্ধ হয়ে হকাররা বিভিন্ন শ্লোগান ও চিৎকার চেঁচামেচি করে লাঠিসোঠা, হকিস্টিক ইত্যাদি দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটদের উপর হামলা চালায়। এ সময় সিটি কর্পোরেশনের মোবাইল কোর্টের সহযোগী টিম ও দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যগণ এসে ম্যাজিস্ট্রেটদের রেল স্টেশন সংলগ্ন কর্পোরেশনের গণ শৌচাগারে নিয়ে কোন রকমে রক্ষা করে। হামলাকারীদের ইট ও পাথরের আঘাতে পুলিশের ৭/৮ জন সদস্য গুরুতর জখম হয় বলেও এতে উল্লেখ করা হয়।
এদিকে হকার নেতারা জানিয়েছেন, মনির ও নজিমসহ তাদের ছয় সদস্য আহত হন। এর মধ্যে নাজিম নামে চোখে আঘাত পান। সিএমপির দায়িত্বশীল কর্মকর্তরা এক নারী কনস্টেবলসহ পাঁচ সদস্য আহত হন বলে জানায়।
দায়ী কারা : কোতোয়ালী থানায় দেয়া চসিকের অভিযোগপত্রে ঘটনার জন্য ৭ হকার নেতার নাম উল্লেখ করা হয়। এরা হচ্ছেন মেট্রোপলিটন হকার্স সমিতি’র সম্পাদক মাসুম, মেট্রোপলিটন হকার্স সমিতি’র সভাপতি মিরন হোসেন, যুগ্ম সম্পাদক শাহ আলম ভূঁইয়া, চট্টগ্রাম ফুটপাত হকার্স সমিতি’র সভাপতি নুরুল আলম লেদু, ফুটপাত হকার্স সমিতির সম্পাদক অসিম মিয়া, মেট্রোপলিটন হকার্স সমিতির সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য শাহীন আহমদ ও সংসংগঠনটির সদস্য নূর মোহাম্মদ।
চসিকের বক্তব্য : অভিযানে অংশ নেয়া সিটি মেয়রের একান্ত সচিব মোহাম্মদ আবুল হাশেম আজাদীকে বলেন, আমরা বৃহস্পতিবার হকার উচ্ছেদ করেছিলাম। তখন আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল উচ্ছেদকৃত জায়গায় যেন হকার আর বসতে না পারে সেজন্য মনিটরিং করা হবে। আমাদের কাছে খবর এসেছে বিকেলে অনেক হকার বসে গেছে। আজকে (গতকাল) আমরা ৫০ জন পুুলিশ ও ৩ জন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে মনিটরিং করতে যায়।
তিনি বলেন, একটা জেনারেটর দিয়ে পুরো এলাকায় হকারদের বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। আমরা যখন সেটা জব্দ করতে গেলাম তখন মাসুম নামে মেট্রোপলিটন হকার সমতির এক নেতা তাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে বলে উস্কে দেয়। যদিও তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি, শুধু জরিমানা করা হয়। মাসুমের উস্কানিতে হকাররা হঠাৎ করে ইটপাটকেল নিয়ে আমাদের উপর হামলা করে। তখন আত্মরক্ষার্থে ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুড়া হয়।
আবুল হাশেম বলেন, হকাররা আমাদের চারটি গাড়ি ভাঙচুর করে। আমাদের শ্রমিক ও স্ট্রাইকিং ফোর্সের চার–পাঁচজন আহত হয়। কয়েকজন পুলিশ সদস্যও আহত হন। হামলার ঘটনায় মামলা করা হবে। হকারদের হামলার পরও সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত অভিযান চলে বলে জানান তিনি। এতে শতাধিক ভাসমান হকার উচ্ছেদ করা হয়।
সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী আজাদীকে বলেন, কোনোভাবেই ফুটপাত অবৈধ দখলে নিয়ে হকারদের বসতে দেয়া হবে না। এক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান কঠোর। সেজন্যই তো আজকে (গতকাল) আমরা মনিটরিং করা হয়েছে। যত বাধাই আসুক না কেন ফুটপাত মানুষের হাঁটার উপযোগী করা হবে।
অভিযানে অংশ নেয়া নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট চৈতী সর্ববিদ্যার বরাত দিয়ে চসিকের জনসংযোগ কর্মকর্তা আজিজ আহমদ বলেন, রাস্তা, নালা ও ফুটপাত দখল করা প্রায় তিনশ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। এসময় অবৈধ দখলদাররা বাধা দিলে পুলিশের সহায়তায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। পুনর্দখল ঠেকাতে মনিটরিং চলমান থাকবে।
পুলিশের বক্তব্য : ঘটনার সূত্রপাত কীভাবে হয়েছে জানতে চাইলে নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ–কমিশনার (দক্ষিণ) নোবেল চাকমা আজাদীকে বলেন, ওখানে একটা জেনারেটর ছিল, এটা নিয়ে এক হকারকে জরিমানা করা হয়। পরবর্তীতে সিটি কর্পোরেশন জেনারেটরটির জব্দ করার সময় অতর্কিতভাবে লোকজন এসে হামলা করে। এতে পাঁচ পুলিশ সদস্য আহত হন।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশের ফাঁকা গুলি ছোড়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বলেন, ওটা ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে করেছে। আমরা তখন নিউমার্কেটের দিকে ছিলাম। হামলা হচ্ছে দেখে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করি। ফাঁকা গুলি কত রাউন্ড ছোড়া হয়েছে জানতে চাইলে বলেন, ৪০ রাউন্ডের মত ফাঁকা গুলি করা হয়।
এদিকে আহতদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি করা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চমেক পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ নুরুল আলম আশেক আজাদীকে বলেন, চন্দন চৌধুরী নামে সিটি কর্পোরশনের একজন কর্মচারী প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে ফিরে গেছেন। এছাড়া আহত চার পুলিশ সদস্যও প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে ফিরে গেছেন। গুলিবিদ্ধ কেউ হাসপাতালে আসেনি বলেও জানান তিনি।
হকারদের বক্তব্য : চট্টগ্রাম সম্মিলিত হকার ফেডারেশনের সভাপতি মো. মীরন হোসেন মিলন আজাদীকে বলেন, হকার উচ্ছেদের প্রতিবাদে বিকেল ৩টা থেকে আমাদের পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি ছিল। পৌনে ৩টায় হকাররা মিউসিপ্যাল স্কুলের সামনে জড়ো হন। একই সময়ে আবদুর রহমান, আবদুল হালিম, সুমন ও আনোয়ার নামে চারজন হকারকে সিটি কর্পোরেশনের ম্যাজিস্ট্রেট দণ্ড দেয়ার খবর আসে। তখন মেট্রোপলিটন হকার সমিতির সহ–ক্রীড়া সম্পাদক মো. মাসুম ঘটনাস্থলে যান। তখন ম্যাজিস্ট্রেট তাকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। হকাররা এর প্রতিবাদে শান্তিপূর্ণ মিছিল করে। এসময় ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে পুলিশ মিছিলে বাধা দেয়, লাটিচার্জ করে এবং গুলি ছোড়ে। এতে বেশ কয়েকজন হকার আহত হন। এর মধ্যে মনির নামে একজন গুলিবিদ্ধ হন। নাজিম উদ্দিন নামে আরেক হকার চোখে আঘাত পান। নাজিমকে প্রথমে চট্টগ্রাম মেডিকেল এবং পরে চক্ষু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কর্পোরেশনের যারা শ্রমিক ছিল তারাও এলোপাতাড়ি ইট–পাটকেল মেরেছে হকারদের।