সড়ক-মহাসড়কে মৃত্যুর মিছিল থামানো যাচ্ছে না

প্রকৌশলগত ত্রুটি সরাতে হবে

| শুক্রবার , ২২ আগস্ট, ২০২৫ at ৭:২৫ পূর্বাহ্ণ

প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বছরের পর বছর ধরে দেশে যানপরিবহন দুর্ঘটনা যেভাবে প্রতিনিয়ত প্রাণ নিধনের দুর্বিষহ প্রতিযোগিতায় নেমেছে; পুরো জাতি এতে চরম বিচলিতআশঙ্কাগ্রস্ত। ঘর থেকে বেরোনোর সময় কেন যেন এক অজানা মৃত্যু ভয় ছায়ার মতো মনের অগোচরে বাসা বেঁধে চলছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও অন্যান্য সরকারিবেসরকারি সংস্থার প্রাণপণ প্রচেষ্টায়ও এর পরিত্রাণে কার্যকর কোনো সুফল দৃশ্যমান নয়। ফলশ্রুতিতে সড়কমহাসড়কে মৃত্যুর মিছিল থামানো যাচ্ছে না। দোষারোপের তর্জনী ইঙ্গিতে সঙ্কট দূরীভূত হওয়ার পরিবর্তে আরও যেন ভয়াবহতায় প্রতিফলিত হচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত গণমাধ্যমের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতিবছর ১৫ হাজার ছোটবড় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। বিআরটিএ’র হিসাবে প্রতিদিন সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৩০ জন প্রাণ হারায়। সে হিসাবেও বছরে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০ হাজার ৮০০ জন। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে বছরে ১২ হাজার এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ২০ হাজার মানুষ প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়।

গত ১৯ আগস্ট দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত হয়েছে তেমন এক দুর্ঘটনার খবর। এতে বলা হয়েছে, নগরীর আকবরশাহ থানাধীন সিটি গেট এলাকায় দাঁড়িয়ে থাকা একটি কাভার্ডভ্যানের পেছনে পিকআপের ধাক্কায় ৫ মাছ ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরো ৫ জন। নিহতদের মধ্যে তিনজন সীতাকুণ্ড উপজেলার ছলিমপুর ইউনিয়নের ফৌজদারহাট জেলেপাড়ার বাসিন্দা। গত সোমবার ভোর পৌনে ৫টার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত ও আহতরা সবাই মাছ ব্যবসায়ী। তারা ভোরে সীতাকুণ্ড থেকে পিকআপযোগে নগরের ফিশারিঘাটে মাছ আনতে যাচ্ছিলেন। দুর্ঘটনায় দুমড়ে মুচড়ে যায় পিকআপটি। নিহতরা সবাই সীতাকুণ্ড এলাকার বাসিন্দা। এ দুর্ঘটনায় একই পাড়ার গুরুতর আহত অবস্থায় আরও পাঁচজন চমেক হাসপাতালে ভর্তি আছেন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দুইজনের অবস্থা গুরুতর বলে জানা গেছে। পুলিশ জানায়, পিকআপ ভ্যানটির সামনে তিনজন ও পেছনে সাতজন যাত্রী ছিলেন। নগরের সিটি গেইট এলাকায় এটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটি কাভার্ডভ্যানের পেছনে ধাক্কা দেয়। এ সময় ঘটনাস্থলেই তিনজন নিহত হন। পরে আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার পর আরও দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। নিহত ও আহতরা সবাই মাছ ব্যবসায়ী বলে জানা গেছে। এদের তিনজনের বাড়ি একই পাড়ায়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পিকআপ ভ্যানটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কাভার্ডভ্যানের নিচে ঢুকে পড়ে। ফলে চালকসহ সামনে থাকা তিনজন ঘটনাস্থলেই মারা যান। পরে জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯এ ফোন করা হয়। এরপর ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ হতাহতদের উদ্ধার করে। সরেজমিনে নগরের সিটি গেইট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, দুর্ঘটনায় দুমড়ে মুচড়ে গেছে পিকআপটি। দুর্ঘটনাস্থল থেকে কিছুটা দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। পুলিশ জানায়, গাড়িটি জব্দ করে থানা এরিয়ায় নিয়ে রাখা হবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সড়ক দুর্ঘটনার মাধ্যমে ‘কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড’ হচ্ছে। আমাদের দেশের গণঅভ্যুত্থানের সুফল পরিবহন খাতে পড়েনি। সিঙ্গাপুর বছরে সড়ক দুর্ঘটনার হার এক শতাংশে নামিয়ে এনেছে উল্লেখ করে তাঁরা বলেন, রাস্তা ঠিক থাকলে, চালকের লাইসেন্স থাকলে, সিগন্যাল ঠিক থাকলে এবং সবাই নির্দেশনা মেনে চললে তারা দুর্ঘটনা শূন্যে নামিয়ে আনার কথা বলছে। তার অর্থ, মানুষ চাইলেই এগুলো দূর করতে পারে। সরকার তা চাইলেও বাসমালিকেরা তা চাইছেন না।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদন বলছে, গত বছর ২ হাজার ৩২৯টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে, যা মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৩৬ দশমিক ৬২ শতাংশ। এসব দুর্ঘটনায় ২ হাজার ৫৭০ জন নিহত এবং ৩ হাজার ১৫১ জন আহত হয়েছেন, যা মোট নিহতের ৩০ দশমিক ০৮ শতাংশ এবং মোট আহতের ২৪ দশমিক ৯৯ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, সরকার বদল হলেও পরিবহনের কাঠামোগত কোনো পরিবর্তন আসেনি। চাঁদাবাজির হাতবদল হয়েছে কেবল, ফিটনেসহীন যানবাহন সড়কে চলছে, আইনের অপপ্রয়োগ চলছে। বিআরটিএ রাজস্ব আদায়ে ব্যস্ত, ট্রাফিক বিভাগ জরিমানা আদায়ে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, দুর্ঘটনা সংঘটিত হওয়ার যাবতীয় উপাদান সড়কে বিছিয়ে রাখা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে কেবল সভাসমাবেশে, বক্তৃতাবিবৃতি আর পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তাঁদের মতে, সড়ক দুর্ঘটনা প্রকৌশলগত ত্রুটির কারণে ঘটে থাকে। সমাধানও প্রকৌশলগত হওয়া জরুরি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে