রোড সাইড অবজারভেশনাল স্টাডি শীর্ষক এ গবেণার ফলাফলে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম শহরের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ক্ষেত্রে ৯৫ শতাংশ দায়ী তিনটি শ্রেণি, যাদের ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তা ব্যবহারকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই তিন শ্রেণি হচ্ছে পথচারী, মোটরসাইকেল চালক এবং সাইকেল চালক। জন্স হপকিন্স ইন্টারন্যাশনাল ইনজুরি রিসার্চ ইউনিটের সহযোগী বৈজ্ঞানিক ডা. শিরিন ওয়াধানিয়ার গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
এ গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে নগরে ৯৫ জন নিহতের মধ্যে ৮২ শতাংশই ছিলেন পথচারী। আর ১১ শতাংশ মোটরসাইকেল চালক, ২ শতাংশ সাইকেল আরোহী এবং বাকি ৫ শতাংশ যানবাহন ব্যবহারকারী। ডা. শিরিন ওয়াধানিয়া জানান, গবেষণামতে শতকরা ৪০ ভাগ ক্ষেত্রে যানবাহনগুলো গতিসীমা অতিক্রম করে। আর গতি সীমা অতিক্রম করার প্রবণতা সর্বোচ্চ ৪৮ শতাংশ দেখা যায় বাসের ক্ষেত্রে। মোটরসাইকেল চালকদের মধ্যে যথাযথ নিয়মে হেলমেট ব্যবহারের হার মাত্র ৬৮ শতাংশ এবং আরোহীদের মধ্যে যথাযথ নিয়মে হেলমেট ব্যবহারের হার মাত্র ২০ শতাংশ।
সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশের (সিআইপিআরবি) সহায়তায় চসিক এবং জন্স হপকিন্স ইন্টারন্যাশনাল ইনজুরি রিসার্চ ইউনিট যৌথভাবে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার অন্যতম শর্ত সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আর সড়ক–সংঘর্ষ প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য দুর্ঘটনার সঠিক তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহ করতে হবে। সংশ্লিষ্ট অংশীজনরা এসব তথ্য–উপাত্ত যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে পারবে। তিনি সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চসিকের গৃহীত উদ্যোগসমূহ ও চলমান কার্যক্রমের কথা উল্লেখ করেন। অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) ফয়সাল মাহমুদ বলেন, চট্টগ্রামের সড়ককে নিরাপদ ও সচল রাখতে সচেষ্ট রয়েছে। তবে ট্রাফিক বিভাগের একার পক্ষে নিরাপদ সড়ক গড়া সম্ভব নয়, পুলিশের পাশাপাশি সকল অংশীজনকে নিয়ে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। যানবাহন ব্যবহারকারীদের মধ্যে সিটবেল্ট ব্যবহারের হার মাত্র ১৫%। এছাড়া যাত্রী ও বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত যানবাহন ব্যবহারকারীদের মধ্যে সিটবেল্ট ব্যবহারের প্রবণতা নেই বললেই চলে। ভারী যানবাহনের চালকদের ক্ষেত্রে সিটবেল্ট ব্যবহারের হার মাত্র ৩ শতাংশ। যানবাহনে যাতায়াতকারী শিশুদের মধ্যে কাউকেই চাইল্ড–সিট তথা চাইল্ড রেস্ট্রিয়েন্ট ব্যবহার করতে দেখা যায়নি।
এর আগে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায়। আর বেসরকারি রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাব অনুযায়ী, গত এক বছরে বাংলাদেশে যত দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার ৩৯ শতাংশই মোটরসাইকেলের কারণে হয়েছে। এর পেছনে অবৈধভাবে লাইসেন্স পাওয়া, লাইসেন্স ও নিরাপত্তা সরঞ্জাম ছাড়া চালানো আর ঝুঁকিপূর্ণভাবে মোটরসাইকেল চালানোকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বেসরকারি রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশে দুই হাজার ৭৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। তার মধ্যে মৃত্যু হয়েছে দুই হাজার ২১৪ জনের। ২০২০ সালের তুলনায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ৫০ শতাংশ, মৃত্যু বেড়েছে ৫১ শতাংশ। নিহতদের বেশির ভাগের বয়স ৩০ বছরের নিচে।
বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মোটরসাইকেল ব্যবহৃত হয় এমন ১৬টি দেশের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট দেখতে পেয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার মোটরসাইকেলের বিপরীতে ২৮.৪ জন নিহত হচ্ছে, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। এদের ৪০ শতাংশের বয়স ২৪ থেকে ৩০ বছর।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘দেশে মোটরসাইকেলের উৎপাদন অনেক বেড়েছে। কম টাকায় মোটরসাইকেল কিনতে পাওয়া যায়, লোনে ও কিস্তিতে পাওয়া যায়। মানুষ সামান্য টাকা হলেই এটা কিনতে পারছে। কিন্তু তাতে যে মৃত্যুঝুঁকি কত বাড়ছে, সেটা কেউ চিন্তা করছে না।’ তাঁরা বলেন, সবচেয়ে বড় সমস্যা তৈরি করছে মহাসড়কগুলোয় মোটরসাইকেল চালানো। অভিযোগ রয়েছে, অতিরিক্ত যাত্রী ও নিরাপত্তা সরঞ্জাম ব্যবহার না করেই অনেকে মোটরসাইকেল চালান।
ডা. শিরিন ওয়াধানিয়ার গবেষণায় পথচারী আর সাইকেলের বিষয়টিও উঠে এসেছে। রাস্তা পারাপারে পথচারীর সতর্ক ভূমিকা খুব জরুরি। বেশিরভাগ পথচারী দুর্ঘটনায় পড়ে অসচেতনতার কারণে। তাছাড়া সাইকেল ও মোটর সাইকেল আরোহীদের অধিকাংশই কিশোর–তরুণ। তারা বেপরোয়াভাবে মোটরসাইকেল চালায়, হেলমেট পরে না, রাস্তার কোনো আইন মানে না। ফলে এরা নিজেরাও দুর্ঘটনায় পড়ে, অন্য যানবাহনের জন্যও বিপদ তৈরি করে। মোটরসাইকেল একটা ঝুঁকিপূর্ণ বাহন। নিরাপত্তার দিক চিন্তা করে চালকদের নিজেদেরই এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত। সাবধানে চালানো উচিত।