সড়কে অব্যবস্থাপনা : থামানো যাচ্ছে না মৃত্যুর মিছিল

নেছার আহমদ | মঙ্গলবার , ২২ জুলাই, ২০২৫ at ৫:২৩ পূর্বাহ্ণ

বর্তমানে সড়ক, মহাসড়ক যেন এক জীবন্ত বিভীষিকার নাম। প্রত্যহ বাড়ছে মৃত্যু। সড়কের নৈরাজ্য বর্তমানে ‘টক অব দা কান্ট্রি’। ঢাকাচট্টগ্রামখুলনা সহ বিভিন্ন মহাসড়কে আমাদের নিয়মিত চলাচল রয়েছে। বর্তমানে এপথে চলা যেন অনিশ্চয়তার অপর নাম। আমাদের চোখে নিয়মিত সড়ক ও মহাসড়কের যে অব্যবস্থাপনা চোখে পড়ে তা এখানে তুলে ধরা দরকার বলে মনে করছি।

সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের স্বাভাবিক জীবন যাপনের ক্ষেত্রে জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃত্ব এবং কর্মকর্তারা বার বার বলেছেন, ‘মহাসড়কে একের পর এক দুর্ঘটনা এখন সব চেয়ে বড় দুর্ভাবনার বিষয়।’ তাঁদের ভাষায়, অবকাঠামোগত প্রকল্পে যত অগ্রগতি সেই তুলনায় সড়ক পরিবহনে শৃঙ্খলতা অতটা হয়নি। যার জন্য দুর্ঘটনা বা যানজট প্রকটাকার ধারণ করেছে। ঢাকাচট্টগ্রাম মহাসড়কে চলাচলের ক্ষেত্রে কখন কোথায় কি জন্য যানজট লেগে যায় তা ধারণা করা মুশকিল, যানজট লাগলেই তা ৪/৫ কিলোমিটার হতে ১৫/২০ কিলোমিটার পর্যন্ত দীর্ঘ হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যামে আটকে থাকে মানুষ। অসহায় যাত্রীরোগী কারো যেন মাথা ব্যথা নেই। নিয়ন্ত্রণহীন মহাসড়ক যেন জীবনের দুর্দশার আরেক নাম।

স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর সড়ক পথের যথেষ্ট উন্নতি সাধিত হয়েছে। কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১১ হাজার কিলোমিটার পাকা রাস্তা রয়েছে যার মধ্যে মাত্র ৪০% হাইওয়ে সম্পন্ন এবং মোটরযানের সংখ্যা প্রায় ৪ লক্ষাধিক, রিকশা, ভ্যান, সাইকেল, ঠেলাগাড়ি, অটোরিকশা অগনিত এর কোন হিসেবে নেই। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে উন্নত দেশের তুলনায় যা প্রায় ৩০ গুণের বেশি।

বিশেষজ্ঞদের বিবেচনা করে দেখা যায় যে আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য এককভাবে কেউ দায়ী নয়। নানাবিধ কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। এখানে সড়ক দুর্ঘটনার অসংখ্য কারণের মধ্যে কিছু কিছু বিষয় এখানে তুলে ধরছি। যেমন, প্রতিযোগিতামূলকভাবে গাড়ি চালানো এবং ওভারটেকিং, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, সড়কেমহাসড়কে উল্টোপথ গাড়ি চালানো যা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে, চালকদের অসাবধানতা, অদক্ষতা ও লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ চালক, রাস্তার মধ্যে প্রয়োজনীয় ডিভাইডার না থাকা, সড়ক পরিবহনের সাথে সম্পৃক্ত এক ধরনের কর্মচারীদের দুর্নীতি। এছাড়াও আছে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ট্রাফিক পুলিশের অভাব ও ট্রাফিক নিয়ম ভঙ্গ করা এবং অনিয়ন্ত্রিত ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, ট্রাফিকপুলিশের সংখ্যা স্বল্পতা ও দায়িত্বহীনতা এবং সামান্য উৎকোচের বিনিময়ে অবৈধ চলাচলের ব্যবস্থা, সড়কের উপর অবৈধ হাটবাজার ও স্থাপনা, অতিরিক্ত মাল ও যাত্রী বোঝাই। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় পথ অবরোধ, পথসভা, হরতাল প্রভৃতি কারণে যানজট সৃষ্টির ফলে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়ে। এর ফলে অনেক সময় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে, ওভারব্রিজের স্বল্পতা, অসাবধানে রাস্তা পারাপার বা রাস্তা পারাপারের নিয়ম মেনে না চলা।

বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার সে চিত্র তা সত্যি ভয়াবহ এবং দুঃখজনক। দেশের কোথাও না কোথাও সড়ক দুর্ঘটনা মুহূর্তের মধ্যে ছিনিয়ে নিচ্ছে মানুষের অমূল্য জীবন। ভেঙে দিচ্ছে অসংখ্য সাজানো সংসার। স্বজন হারা মানুষের আহাজারি, পিতৃহারা সন্তানের আকুতি সত্যি হৃদয় বিদারক। সরকারের হিসেবে এ ধরনের দুর্ঘটনার সংখ্যা বছরে চারশো এর অধিক।

কোথাও বাসের সাথে বাস, কোথাও বাসেট্রাকে, কোথাও টেম্পুবাস, আবার কোথাও কাভার্ডভ্যানের সাথে মাইক্রোবাস। আবার কোথাও রিকশা বা নিরীহ পথচারীকে চাপা দেয় দ্রুতগামী বাস বা ট্রাক কেড়ে নেয় তা মূল্য মানব জীবন। সুতরাং সড়কের ভয়াবহ এ নৈরাজ্যজনক অবস্থা প্রতিকারের জন্য বিশেষজ্ঞদের মতামতের আলোকে কতিপয় সুপারিশমালা এখানে তুলে ধরা হলো :

অনির্ধারিত স্থানে গাড়ি পার্কিং বন্ধকরণ, প্রয়োজনে উচ্চহারে জরিমানা আদায়ের ব্যবস্থা, সাবধানে গাড়ি চালনার জন্য চালকগণকে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি মহাসড়কে অবৈধ রিকশা, থ্রি হুলার ভ্যানগাড়ি অনুপ্রেবেশ রোধ, মহানগর সমূহে রিকশা চলাচল সীমিত করতে হবে, প্রয়োজনে সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় ট্রাফিক ব্যবস্থা আধুনিকরণ মোটেই সম্ভব নয়, লাইসেন্স প্রদানের পূর্বে চালকের দক্ষতা ও যোগ্যতা ভালভাবে যাচাইবাছাই করতে হবে। লাইসেন্সবিহীন কেউ যেন গাড়ি চালাতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখাও আবশ্যক, মোটর যান অধ্যাদেশের ১৪৩, ১৪৬ ও ১৪৯ ধারায় যে আর্থিক ক্ষতিপূরণ এবং শাস্তির বিধান উল্লেখ করা হয়েছে তা বাড়ানো দরকার, সড়ক দুর্ঘটনার শাস্তি অর্থাৎ সিআরপিসির ৩০৪ বি ধারা পরিবর্তন করে সাজার পরিমাণ ০৭ বছর থেকে কমিয়ে তিন বছর করা হয়েছে। এ শাস্তির মেয়াদ আরও বাড়িয়ে ১০ বছর করা প্রয়োজন, গাড়ি রাস্তায় বের করার পূর্বে এর যান্ত্রিক কার্যকারিতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারলে দুর্ঘটনা অনেকাংশেই হ্রাস পাবে, বিআরটিএ এর কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারী প্রচলিত পদ্ধতিতে লাইসেন্স প্রদানে প্রতিবন্ধকতা ও লাইসেন্সের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে কম দামে জাল লাইসেন্স তৈরী ও বিক্রি করে বলে অভিযোগ রয়েছে। যা কাগজপত্রের প্রমাণের অভাবে প্রতিকার করা দুরূহ। এ ধরনের জাল সার্টিফিকেট দেয়া বন্ধ করা জরুরি, মহানগরকে রিঙামুক্ত এবং হাইওয়েতে রিকশা, থ্রি হুলার ও ভ্যান গাড়ি চলাচল বন্ধ করা খুবই জরুরি। রাস্তায় পরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা, হাইওয়েতে মানুষ বা মানুষ চালিত বাহন চলাচল বন্ধ করে তাদের জন্য বিকল্প রাস্তা তৈরী করা প্রয়োজন, সড়কে বা মহাসড়কে উল্টোপথে রিকশা, টেক্সী, থ্রিহুইলার, মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল সহ যে কোনো চলাচল কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে, ফুটপাত হকারদের দখলমুক্ত করে পথচারী চলাচলের উপযোগী করে তোলার বিষয়গুলো মাথায় রেখে গোটা ট্রাফিক ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও উন্নয়ন ঘটানো অপরিহার্য। অন্যথায় সড়ক দুর্ঘটনা দিনের পর দিন আরও বাড়তে থাকবে, যা দেশ ও জাতির জন্যে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। এমনকি পথচারীকেও ট্রাফিকের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।

বর্ণিত সুপারিশমালা বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনে ট্রাফিক ব্যবস্থা এবং হাইওয়ে পুলিশকে শক্তিশালী করে সড়কের নৈরাজ্য হতে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব বলে আমরা মনে করি।

লেখক: প্রাবন্ধিক, সম্পাদকশিল্পশৈলী

পূর্ববর্তী নিবন্ধজলবায়ু পরিবর্তন ও নির্মাণ শিল্প: সমাধান কি স্ল্যাগ সিমেন্টে
পরবর্তী নিবন্ধযে-জীবন কবিতার