স্মৃতির মন্দিরে দৈনিক আজাদী

জামাল উদ্দিন বাবুল | মঙ্গলবার , ২৯ অক্টোবর, ২০২৪ at ৯:১৯ পূর্বাহ্ণ

ইংরেজিতে একটি কথা আছে – ‘Facts sometimes become more romantic than fictions’ অর্থাৎ সত্য ঘটনা কোন এক সময় রূপকথাকেও হার মানায়। স্মৃতির মিনার কখনও কখনও ধসে পড়ে যদি না সে স্মৃতির ভিত ও কাঠামো মজবুত না হয়। মানুষের জীবনে অনেক অনেক স্মৃতি গাঁথা আছে যা কখনও বিস্মৃতির আবরণে ঢাকা পড়ে না। আমার জীবনে তেমনি দৈনিক আজাদীকে ঘিরে স্মৃতির সে মিনার এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বলছিলাম দৈনিক আজাদীর সাথে আমার কিশোর জীবনের কিছু অবিচ্ছেদ্য ঘটনার কথা। আমি তখন সবে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে উঠেছি। ছোটবেলা থেকে ছড়া, কবিতা, গল্প ইত্যাদি লিখতাম কচি হাতে। সে সময়কার পত্রিকার ছোটদের পাতাগুলো ছিল আমার খুবই প্রিয়। দৈনিক আজাদীর আগামীদের আসর ছিল সবচেয়ে বেশি পছন্দসই। পত্রিকার ছোটদের পাতায় লেখা পাঠাবার ইচ্ছের পাখিরা সবসময় আমার মনে পাখা ঝাপটাতো। ভাবতাম কী সব ছাইপাস লিখছি যে আমার লেখা ওরা ছাপবে।

যাক তারপরও একবুক সাহস নিয়ে যা হবার তাই হবে এই ভাবনায় পত্রিকার ছোটদের পাতায় লেখা পাঠাতে শুরু করলাম। দৈনিক আজাদী, ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক পাকিস্তান (পরে দৈনিক বাংলা) দৈনিক পয়গাম, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক আজাদ ইত্যাদি পত্রিকার ছোটদের পাতায় লেখা পাঠাতে শুরু করলাম। তখন ডাক যোগে লেখা পাঠাতে হতো। সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে অপেক্ষা করতাম আমার লেখা ছাপা হলো কী, না হলো না, ভেঙে পড়তাম না, হঠাৎ যদি কোনো দিন লেখা ছাপা হলোতো আমার আনন্দ আর কে দেখে। ইংরেজ কবি Fairy song কবিতায় সুন্দর ছন্দে বলেছেন “Shed no tear, oh! Shed no tear,” Flower will bloom again in the next year “- কেঁদোনা, ওগো কেঁদোনা, আসছে বছর আবার ফুল ফুটবে।

দৈনিক আজাদীর আগামীদের আসর সভ্য হলাম একসময়। আমার সভ্য নম্বর ৬৯১। ছড়া লিখতে আমি খুব মজা পেতাম, আসর এর পরিচালক ভাইয়া আবুল কাশেম সন্দ্বীপ ছিলেন আমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব। তিনি কারও লেখা বাদ দিতেন না। সংশোধন সাপেক্ষে লেখাগুলো পর্যায়ক্রমে ছাপাতেন। তার এই উদারতার কারণে তিনি সবার শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। একদিন ভাইয়াকে ডাক যোগে চিঠি লিখলাম আমি তাঁর সাথে দেখা করতে চাই, তিনি না করলেন না, বললেন যে কোনো বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টার সময় আজাদী অফিসে এসো। এ খবর পাওয়ার পর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন বৃহস্পতিবার আসবে।

তখন আজাদী অফিস ছিল আন্দরকিল্লায়। অবশেষে সেই মহেন্দ্রক্ষণ বৃহস্পতিবার এলো। ধুরু ধুরু বক্ষে ধীর লয়ে গেলাম আজাদী অফিসে। গেটের পাহারাদার অভিপ্রায় জানতে চাইলো, বললাম ভাইয়ার কাছে যাবো। সে বললো কোন ভাইয়া, কার ভাইয়া, তোমার ভাই কি এখানে চাকরি করে ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি তাকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম আমি আগামীদের আসরের পরিচালক ভাইয়ার সাথে দেখা করতে চাই, উনি আমাকে আসতে বলেছেন। বেচারা কিছুতেই আমার কথা বুঝতে পারছিল না, সে আমাকে ভেতরে যেতে দিবে না। আগামীদের আসর ভাইয়া এসব সে কিছু চেনে না শুধু বলছে এখান থেকে সরে যাও, সাহেব দেখলে বকাবকি করবে সে সময় হঠাৎ সেখানে এলেন হালকা পাতলা গড়নের একজন যুব বয়সের মানুষ, তিনি পাহারাদার এর কাছে জানতে চাইলেন আমি কী চাইছি, সে বললো ছেলেটা নাকি ভাইয়ার সাথে দেখা করতে এসেছে। আমি ভাইয়াকে কখনও দেখিনি, ভাইয়াও আমাকে কখনও দেখেননি, তুমি কি বাবুল? আমি বললাম জ্বী, এসো আমার সাথে, তিনি আমাকে উপরের তলায় তার টেবিলে নিয়ে গেলেন, তিনি বললেন তুমি আমার কাছেই এসেছো, আমিই তোমার ভাইয়া। ভয় মিশ্রিত আনন্দে আমি যেন আকাশের চাঁদকে হাতে পেয়ে আত্মহারা হয়ে পড়লাম। সে মুহূর্তের স্মৃতি আজও মম মন্দিরে উজ্জ্বল হয়ে আছে, থাকবে যতদিন এ আয়ু আছে।

এর মধ্যে চা বিস্কিট চলে এলো, বাবুল খাও, ভাইয়া অত্যন্ত স্নেহ মিশ্রিত আদেশ করলেন, বাবুল নাম ধরে কেউ ডাকলে খুব ভালো লাগে, এ নামটা আমার মায়ের দেয়া, আমার মাকে আমি দেখিনি, আমার জন্মের এক বছর না যেতেই আমি মাতৃহারা হই। এ নামে আমাকে আরও অনেকে সম্বোধন করতেন, বিশিষ্ট লেখিকা ও সমাজ সেবিকা মরহুমা ফাহমিদা আমিন ও মরহুমা অধ্যাপক সালমা চৌধুরী সহ আমার মুরব্বী স্থানীয় অনেকে আমাকে এ নামেই ডাকতেন।

চা বিস্কিট এর পালা শেষ, ভাইয়া একগাদা লেখার স্তূপ আমার সামনে এগিয়ে দিয়ে বললেন এখান থেকে কালকের সংখ্যার লেখাগুলো বাছাই করে দাও। এসময় হঠাৎ টেবিলের পাশে এসে দাঁড়ালেন এক মহান সৌম্যদীপ্ত মুখে হাসি মাখা আজাদী সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ স্যার। আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলেন কাশেম তোমার সহকারী নাকি? তখনই আমার জানতে বাকী রইলো না ইনিই সেই আবুল কাশেম সন্দ্বীপ। নামটা আমি আগেই কোনো একভাবে জেনে নিয়েছিলাম। ফাঁকে ফাঁকে আমি লেখাগুলো উল্টে পাল্টে দেখছিলাম। ভাইয়া সবসময় হাসি খুশীতে খোস মেজাজে থাকতেন, কথা বলতেন নিম্নস্বরে।

আমি কিছু ছড়া বাছাই করে ভাইয়াকে দিলাম, গল্পগুলো আমি দেখবো ভাইয়া বললেন। হাঁটি হাঁটি পায়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে তাই আমাকে বাসায় ফিরতে হবে বলায় তিনি বললেন ঠিক আছে তুমি এসো। আমাদের ছাত্র বেলায় সন্ধ্যার আগেই বাসায় ফিরতে হতো। একবুক আনন্দ আর উল্লাসে ঘাটফরহাদবেগ বাসায় চলে এলাম। ঐদিন থেকে দৈনিক আজাদীর সাথে আমার এক নিবিড় সম্পর্কের সূত্রপাত।

এরই মধ্যে শ্রদ্ধেয় বেলাল মোহাম্মদ ভাই এর সাথে আমায় পরিচয় করিয়ে দেন কাশেম ভাই (ভাইয়া)। বেলাল ভাই নিয়মিত আজাদী অফিসে আসতেন। অল্প দিনে তার স্নেহের ছায়াতলে স্থান পেয়ে আমার জীবনের আরেকটি অধ্যায় এর যাত্রা শুরু হলো। ১৯৬৬ সনে আমার মাথায় সংগঠন গড়ার ভূত চাপলো। কিছু সিনিয়র ভাই ও সমবয়সী বন্ধুদের নিয়ে রহমতগঞ্জ এলাকায় প্রতিষ্ঠা করলাম নবীন মেলা নামে একটি সামাজিক সংগঠন যার বয়স এখন ৫৮ বছর।

এদিকে কাশেম ভাই প্রস্তাব দিলেন আগামীদের আসর এর শাখা খুললে কেমন হয় এনিয়ে আলোচনার জন্য তিনি আমি সহ আসরের আরও কিছু ভাইকে নিয়ে তার অফিসের তিন তলায় একটি বৈঠকের আয়োজন করেন। আমি প্রস্তাব করলাম আমাদের গ্রামে যদি চেষ্টা করি তাহলে একটা শাখা খোলা যেতে পারে।

যদিও আমার জন্ম চট্টগ্রাম শহরে তারপর ও স্কুল বন্ধ হলে আমরা গ্রামের বাড়ীতে বেড়াত যেতাম এবং সেই সূত্রে গ্রামে কিছু প্রিয় বন্ধু ছিল। ডাক যোগে চিঠি লিখলাম বন্ধুদের কাছে।পজিটিভ উত্তর পেয়ে আব্বার পারমিশন নিয়ে গ্রামে গেলাম।সবাই মিলে সর্বসম্মতিক্রমে কাকলী নামে আগামীদের আসর এর শাখা প্রতিষ্ঠা করা হলো। গ্রামের ছাত্র সহ সব বয়সী মানুষের কাছ থেকে বিপুল সাড়া পাওয়া গেলো। ইতিমধ্যে কাশেম ভাই ও বেলাল ভাইয়ের কাছে সে তথ্য ডাক যোগে চিঠির মারফত জানানো হলো। বেলাল ভাইয়ের স্মৃতি গাঁথা মূলক বইয়ে এতদসংক্রান্ত বিস্তারিত বর্ণনা লিপিবদ্ধ আছে। সেখানে তিনি আমার কথাও লিখেছেন।

আজ বেলাল ভাই কাশেম ভাই ওপারের বাসিন্দা। তাঁদের স্মৃতি মনে পড়লে অজান্তেই আমার দুচোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠে। কাকলী প্রতিষ্ঠার পর এর উদ্বোধনের জন্য বেলাল ভাই কাশেম ভাইকে আমন্ত্রণ জানানো হলে তাঁরা সানন্দে রাজী হয়ে যান। তারিখটার কথা আমার মনে নেই তবে সালটা যে ১৯৬৮ সাল ছিল তা বেশ মনে আছে।

নির্ধারিত দিনে বিকাল ৪টার সময় কাপ্তাই সড়ক হয়ে তাঁরা গ্রামে এলে সবাই উষ্ণ অভ্যর্থনা দিয়ে বরণ করে নেয়। গ্রামের কিছু ছেলে কাপ্তাই রাস্তা থেকে কর্ণফুলী নদীর তীর পর্যন্ত এগিয়ে আনতে যায়। এখন গ্রামের সাথে যে ভাবে সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে তখন সেটা ছিল না। গাঁয়ের পথে হাঁটা এবং নৌকায় চড়ে নদী পার হওয়া এসব দৃশ্য বেলাল ভাই ও কাশেম ভাই বেশ উপভোগ করেছেন।

এরপর শুরু হলো অনুষ্ঠান। সবশেষে আপ্যায়ন এর মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে। অতিথিরা বিদায় নিতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। আমিও শহরে চলে আসি। কাকলী কিছু কিছু সমাজ সেবা মূলক কর্মসূচী নিয়ে যাত্রা শুরু করে। পড়া লেখার চাপ ও নানা কারণে আমার তেমন একটা গ্রামে যাওয়া হয় উঠেনা।তখন দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছিল। ৬৯ এর গণ আন্দোলন ও তারপর ৭১ সাল মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত কাকলীর সাথে আমার খুব একটা যোগাযোগ ছিলনা। আমার জীবনে দৈনিক আজাদীর আগামীদের আসর স্মৃতি মন্দিরে মাইলফলক হয়ে থাকবে আমৃত্যু। শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করছি মরহুম অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ স্যারকে। বর্তমান সম্পাদক জনাব এম এ মালেকের প্রতি রইলো আমার অনেক অনেক শ্রদ্ধা। আমি তাঁর সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি। মরহুম বেলাল মোহাম্মদ ও মরহুম আবুল কাশেম সন্দ্বীপ ভাই এর আত্নার প্রশান্তি কামনা করে শেষ করছি।

লেখক: সভাপতি, নবীন মেলা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিভূতিভূষণ : প্রকৃতিকে যিনি ধারণ করেছেন মন ও মননে
পরবর্তী নিবন্ধ‘শিশুর শিক্ষা ও শিশুর সাহিত্যকে অভিন্ন করে তুলতে হবে’