আমাদের পরম সৌভাগ্য যে আমাদের কালে আমরা সিদ্দিক আহমেদ এর মতো একজন সিদ্ধি পুরুষের নৈকট্য লাভ করেছিলাম। যিনি ছিলেন আপাদমস্তক সাধন প্রকৃতির মানুষ। ষাটের দশকেই তিনি এক নিভৃত পল্লীতে অবস্থান করেই বিশ্বসাহিত্যের রস আস্বাদন করতেন। শুধু তা নয় তখন তিনি কবি বিপ্লব বিজয় বিশ্বাসের সম্পাদিত অনুবাদ পত্রিকা ‘মৃগয়াতে’ বিশ্ব সাহিত্যের গতি প্রকৃতি নিয়ে লিখতেন অসাধারণ সব বিশ্ল্লেষণ মূলক প্রবন্ধ-নিবন্ধ। কিন্তু ‘মৃগয়া’র পরিসর ছোট হওয়াতে তা ব্যাপক মানুষের কাছে তখন পৌঁছেনি। কিন্তু তিনি নিজেকে প্রচারের জন্য এসব লিখেন নি। শুধুমাত্র তার লব্ধ জ্ঞানের শেয়ার করতে চেয়েছিলেন। নানা কারণে তিনি উপযুক্ত মাধ্যম খুঁজে পাননি। ষাটের দশকের শেষের দিকে তিনি ঢাকা পাড়ি জমিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বহু বিখ্যাত পণ্ডিত ও বিদগ্ধজনের সান্নিধ্যে এসে নিজেকে আরো শানিত করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রাক প্রস্তুতিকালীন সময়ে তিনি ঢাকায় অবস্থান করে তা কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেন। উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের প্রাক্কালে সোরওয়ার্দী উদ্যানে। সে সময় খন্ডকালীন কাজ করেছেন ‘দৈনিক সংবাদ’ ও ‘সাপ্তাহিক একতায়’। যুক্তছিলেন খেলাঘর কেন্দ্রীয় কমিটিতে। প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও সাংবাদিক সত্যেন সেন ও রনেশ দাশগুপ্তের মতো বড় মাপের মানুষের সাথে গড়ে উঠে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক। কিন্তু যুদ্ধের দামামা শুরু হলে তিনি ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে ফিরে আসেন। গ্রামে থেকে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে কাজ করেন। পাশাপাশি অসুস্থ মায়ের সেবাযত্ন করেন। মূলত: তিনি অসুস্থ মায়ের ডাকে তার সেবাযত্ন ও নিবিড় পরিচর্যার জন্য ঢাকা থেকে ফিরে আসেন। নিজ হাতে মায়ের শরীরে ইনজেকশান পুশ করতেন।
গ্রামীণ জীবনে অবস্থান করলেও তিনি চট্টগ্রামের তৎকালীন শিল্পসাহিত্য ও সংস্কৃতির খোঁজখবর রাখতেন। কিন্তু তিনি কোনদিন কারো সাথে যোগাযোগ করেননি বা রাখেন নি। সত্তুর আশি দশকে চট্টগ্রামে এক অজানা অচেনা মানুষ হিসেবে বিচরণ করেন। কিন্তু পঠন-পাঠন চালিয়ে যান বিরামহীনভাবে।
মূলত নানা নাটকীয়তার মাঝে দৈনিক আজাদীতে যোগদান করার পর তিনি সবার কাছে উন্মোচিত হলেন। সে অধ্যায় কম বেশি সবার জানা। তিনি আজাদীতে যোগদানের সাত-আট বছর পূর্ব থেকে পরিচিতি হবার সুবাদে তাঁর সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠে আমার। আমরা একসাথে পাশাপাশি থাকতাম। খুব কাছ থেকে দেখেছি ব্যক্তি সিদ্দিক আহমেদ এর যাপিত জীবন। মন খুলে বলতেন তার জীবনের ঘটে যাওয়া নানা কথা। আবার অনেক কিছু গোপন করে যেতেন। যেমন প্রখ্যাত সাংবাদিক ও সাহিত্যিক সত্যেন সেন মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত চলে যাবার সময় তাঁকে যে একটি পাণ্ডুলিপি দিয়ে গিয়েছিলেন সেটা তিনি কাউকে বলেননি। আমাকেও বলেননি। শুধু বলেছে আমার কাছে সত্যেন সেনের একটি আমানত আছে। কি আমানত সেটা বলেননি। তিনি মৃত্যুর কয়েক বছর আগে ঢাকায় উদীচীর এক অনুষ্ঠানে গিয়ে উদীচীর বর্তমান সভাপতি সাংস্কৃতিক বক্তিত্ব কামাল লোহানীর হাতে হস্তান্তর করেছেন। এই আমানত হচ্ছে সত্যেন সেনের হাতে লেখা ‘মহা বিদ্রোহের কাহিনি’র পাণ্ডুলিপি। দীর্ঘ ৪৫ বছর তিনি তা আগলে রেখেছেন পরম যত্নে। এরকম আরো একটি ঘটনা বলা যায়। দৈনিক আজাদীর প্রয়াত সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ মৃত্যুর পূর্বে তাঁকে প্রয়োজনীয় কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র দিয়ে বলেন-আমার মৃত্যুর পর এই কাগজপত্রগুলো কোন কাজে লাগাতে পারো। এই কাগজপত্রগুলোও তিনি দীর্ঘদিন পরম যত্নে আগলে রেখেছেন। তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে তা আমার কাছে হস্তান্তর করে। সেখানে দেখি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ এর ডায়েরী এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ চিঠি ও ছবি। ছবিগুলো সাদাকালো হওয়াতে নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
এই দুটো ঘটনা উল্লেখ করেছি এই জন্য যে, কতোটা চারিত্রিক দৃঢ়তা হলে মানুষ দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর একটি আমানত পরম যত্নে আগলে রাখে উপযুক্ত মানুষকে হস্তান্তর করার জন্য। কতটা সৎ ও সততা থাকলে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ এর গুরুত্বপূর্ণ দলিল দীর্ঘদিন নিজের কাছে রেখে দেন কিছু একটা করবেন বলে। কিন্তু একটি কঠিন রোগ তাকে তাঁর কাঙ্ক্ষিত কর্মকে থামিয়ে দেয়।
মূলত দৈনিক আজাদীর দীর্ঘ পঁচিশ বছর সাংবাদিকতা জীবন হলো তার প্রস্ফূটিত জীবনের উত্থানকাল। তাঁর ভাষ্যমতে তিনি দৈনিক আজাদীতে বিভিন্ন বিষয়ের উপর পাঁচশতাধিক প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন। এছাড়া বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকা ও লিটল ম্যাগাজিনে লিখেছেন প্রচুর। প্রকাশ করেছেন নয়টি গ্রন্থ। অগ্রন্থিত রয়ে গেছে আরো অনেক লেখা। জীবদ্দশায় পেয়েছেন অনেক সম্মান ও সম্মাননা। জনস্মৃতিতে তার বহুমাত্রিক কর্মকান্ড জীবনযাপন, রাজনৈতিক জীবন, শিক্ষকতা, সাংবাদিকতা চাষাবাদ থেকে শুরু করে ফুটবল ও বলিখেলা এবং পরম মাতৃভক্তি ও বন্ধুবাৎসল্যের মতো ঘটনাগুলো ঝিনুকের বুকে মুক্তোর মতো সঞ্চিত থাকবে। মননে, প্রজ্ঞায়-দর্শনে আপাদমস্তক তিনি ছিলেন অজাতশত্রু।
সিদ্দিক আহমেদ এর জীবন সাধনা একদিকে ছিল মাটির মমতা রসে পুষ্ট, অন্যদিকে ছিল জ্ঞানাকাশের আলোকধারায় দেদীপ্যমান। তাঁর সারাটা জীবন ছিল বই পড়ার মাধ্যমে ‘জ্ঞানসূর্য উদয় উৎসব’। লব্ধ জ্ঞানের মাধ্যমে মানুষের সমগ্রতাকে তিনি প্রচণ্ডরকম ভালোবাসতেন। মানুষের অন্তর্নিহিত ভাবনাগুলো তিনি রপ্ত করতে পেরেছিলেন বলেই তিনি সার্বজনীন সিদ্ধিপুরুষ রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন আমাদের মাঝে।
এই মহিমায় সিদ্ধিপুরুষের জীবনাচারণ আমাদের বর্তমান মেকী সমাজের পুরোভাগে এক নজিরবিহীন উপমাযোগ্য উদাহরণ। একজন সিদ্ধিপুরুষের প্রতিকৃতি সিদ্দিক আহমেদ এর মৃত্যু দিবসে তাঁকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধার সাথে।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, প্রকাশক