স্মৃতিতে অমর আমাদের আব্বা এডভোকেট বদিউল আলম

হুরে জান্নাত | রবিবার , ১৩ মার্চ, ২০২২ at ৬:৪১ পূর্বাহ্ণ

প্রতিদিন চোখে ভেসে উঠে একটি ফ্রেমে বাঁধানো একজন সহজ সরল লোকের ছবি, এই ছবিই আমাদের পরিচয় – আমাদের আব্বা মরহুম এডভোকেট বদিউল আলম। ১৯ বছর গত হয়ে গিয়েছে উনাকে আমরা হারিয়েছি, কিন্তু স্মৃতিতে তিনি চির অম্লান।
আব্বা-আম্মা দুজনেই পৃথিবী ছেড়ে চির বিদায় নিয়েছেন, কিন্তু রেখে গেছেন এমন কিছু আদর্শ, এমন কিছু শিক্ষা, যা হয়ে আছে ও হয়ে থাকবে অনেকের প্রেরণার উৎস। তাদের সুশৃঙ্খল যাপিত জীবন শিক্ষা দেয় সত্যিকারের মানবিকতা, মহানুভবতা, সততা, উদারতা এবং সরলতা।
চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশের ফতেহনগর গ্রামে একটি অতি সাধারণ একান্নবর্তী পরিবারে আব্বার জন্ম ১৯২৬ সালে। ৬ মাস বয়সে বাবাকে হারিয়ে আব্বা বড় হন চাচা জ্যাঠাদের তত্ত্বাবধানে। আব্বার চাচা-জ্যাঠারা নিজেরা খেঁটে ও খাঁটিয়ে সংসার চালাতেন এবং মোটামোটি সচ্ছল অবস্থানে ছিলেন। জমিদার-জোতদার পরিবারের মত প্রাচুর্য্যের জীবন ছিল না তাঁদের। আব্বার পরম প্রিয় জ্যাঠাতো ভাই মরহুম নজীর উদ্দিন আহমেদ ছিলেন আমাদের পরিবারের বাবা-চাচা সবার অভিভাবক। তিনি তখন চট্টগ্রাম পৌরসভায় কাজ করতেন। একটু বড় হবার পর তিনিই প্রথম আব্বাকে গ্রাম থেকে শহরে নিয়ে আসেন, প্রাইমারী বৃত্তি পরীক্ষা দেয়ার জন্য। জ্যাঠার প্রবল আগ্রহ ও উৎসাহে শুরু হয় আব্বার সুন্দর ভবিষ্যত গড়ার প্রচেষ্টা। জীবন যুদ্ধের এই লড়াইয়ে আরও সহযোগিতার হাত বাড়ালেন আব্বার আপন ভাই ও অন্যান্য জ্যাঠাতো ভাইয়েরাও।
স্বনামধন্য রাজনৈতিক নেতা ও বৃটিশ বিরোধী স্বাধিকার আন্দোলনের অন্যতম প্রাণ পুরুষ মরহুম মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর প্রতিষ্ঠিত কদম মোবারক এতিমখানার পাশেই ভাড়া নিয়ে থাকতেন জ্যাঠা। জ্যাঠার সাথে এক রুমে থেকে আব্বা চট্টগ্রাম সরকারী কলেজে যাওয়া আসা করতেন। জ্যাঠার সাহচর্যে থেকে আব্বা পাস করলেন আই.এ এবং বি.এ।
১৯৪৬ সালে বি.এ পাস করার পর আব্বা কয়েক বছর চাকুরী ও ব্যবসায় নিয়োজিত ছিলেন, কিন্তু তিনি খুব একটা সন্তুষ্ট ছিলেন না। আমাদের নানা মরহুম গোলাম রহমান তৎকালীন সময়ে জজ হিসাবে কর্মরত ছিলেন। নানার অনুপ্রেরণায়, আব্বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এল.এল.বি পড়ার জন্য ভর্তি হলেন। নানার পরামর্শে ওনার তত্ত্বাবধানে নিজের পরিবারকে রেখে, আব্বা আইন বিষয়ে পড়াশুনা শুরু করলেন। জীবন যুদ্ধের সেই আরেক সংগ্রাম- কোথায় ঘর, কোথায় পরিবার কোথায় তিনি – সব ত্যাগ করে আব্বা পুনরায় পড়া শুরু করলেন। শুভাকাঙ্ক্ষীদের সহযোগিতা ও অক্লান্ত পরিশ্রমে আব্বা ১৯৫৪ সালে এল.এল.বি পাস করেন এবং জুনিয়র হিসেবে মরহুম এডভোকেট আব্দুল লতিফের তত্ত্বাবধানে চট্টগ্রাম বারে এডভোকেট হিসাবে যোগদান করেন।
৫০ দশকের শেষের দিকে আব্বা জ্যাঠা নজীর উদ্দীন সহ শহরের জামালখানে সাড়ে চার গন্ডা জমি ক্রয় করলেন, নিজের অতি অল্প আয় ও স্বজনদের সাহায্য সহযোগিতায় সেই জায়গায় একটা বেড়ার ঘর তৈরী করে নিজের পরিবারকে গ্রাম থেকে নিয়ে এসে শহরে থাকার ব্যবস্থা করলেন।
আইন ব্যবসার শুরুতে উনার ‘নুন আনতে পান্তা ফুরিয়েছে। সীমিত রোজগারের কারণে আইনজীবীদের পোশাক একটি কালো গাউন ও একটি কোর্ট কেনার সামর্থ্য আব্বার ছিল না। বড় মামা মরহুম আক্তার কামাল (পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সাবেক সদস্য) নানা ভাবে এই সময়ে সাহায্য করেছিলেন। মেজ মামা মরহুম আক্তার জামাল চৌধুরী (নৌ বাহিনীর কর্মকর্তা) উপহার দিয়েছিলেন কাল কোট। ছোট মামা মরহুম আক্তার জালাল চৌধুরী দিয়েছিলেন কালো গাউন। ধীরে ধীরে আইন ব্যবসার প্রসারতা লাভ করতে লাগল, এই সময় জ্যাঠা সহ আব্বা জামাল খানের ক্রয়কৃত জায়গায় পাকা দালান নির্মাণের কাজ শুরু করেন এবং কয়েক বছরের প্রচেষ্টায় তিন তলা ভবন নির্মাণ সম্পন্ন করেন। আব্বার জীবনের প্রতিটি নতুন পদক্ষেপে নিঃস্বার্থভাবে যারা সব সময় পাশে ছিলেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালবাসা, সর্বোপরি কৃতজ্ঞতা জানাতে আব্বা কখনও কার্পণ্য করেননি। শত ব্যস্ততার মাঝেও আব্বা প্রায় প্রতি সপ্তাহে নিজ গ্রামে ছুটে যেতেন। নিজের ভাইদের পরিবার, জ্যাঠাদের পরিবার ও গ্রামবাসীদের সাথে সময় কাটানো ছিল আব্বার একমাত্র বিনোদন। গ্রামবাসীদের সুখে দু:খে, ভাল-মন্দে, বিপদ -আপদে সব সময় তাদের পাশে ছিলেন এবং অবারিত ছিল তাঁর সাহায্যের হাত। ফতেহনগর গ্রামটি ছিল মায়া-মমতায় ঘেরা একটা পরিবারের মত যেখানে সবার অনুভূতি, আবেগ, মিলেমিশে একই সূত্রে গাথা ছিল। সকলের আদরের ছোট বউ হিসাবে আমার আম্মাও সকলের কাছ থেকে অর্জন করেছিলেন শ্রদ্ধা, স্নেহ ও ভালবাসা। পৈত্রিক ভিটার দাবী ছেড়ে দিয়ে আব্বা আমাদের জ্যাঠাতো ভাইদের সহযোগিতায় পুরনো ভিটার অদূরে গিয়ে জমি (ভিটা) কিনলেন। পরবর্তীতে সেখানে নির্মাণ করলেন একটি বাড়ী এবং শখ করে তার নাম দিলেন ‘ইনআম’। গ্রামবাসীদের প্রতি আব্বা আম্মার অকৃত্রিম ভালবাসা আমাদেরকে ছোটবেলা থেকেই সমভাবে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেছে। কত দশক কেটে গেল বিলাতে আছি, কিন্তু প্রতিবছর দেশভ্রমণ অসম্পূর্ণ মনে হতো যদি কিছুটা সময় গ্রামে কাটিয়ে না আসতাম। একই বাক্য প্রযোজ্য আমার ছোট ভাই-বোনদের জন্য, যারা দেশ-বিদেশে বসবাস করছে। চির নিন্দ্রায় শায়িত আমাদের প্রিয় মুরুব্বীদের পাশে দাড়িয়ে যখন দুই হাত তুলে মুনাজাত করি, তখন অন্তরে খুব প্রশান্ত বোধ করি।
একদা গ্রামের সেই নিরক্ষর মায়ের দুর্দান্ত ডানপিঠে সন্তান কালের পরিক্রমায় একজন ধর্মপরায়ণ, মুক্ত চিন্তা-ভাবনার মানুষ হিসাবে সাফল্যের শিখরে পৌঁছান। আব্বার প্রতিটি কাজ ছিল সময়ের সাথে সুনিয়ন্ত্রিত। রোজ সকালে আজানের ধ্বনিতে জেগে ওঠা, সময়মত নামায পড়া, কোরআন তেলাওয়াত করা, চেম্বারে বসা, কোর্টে যাওয়া – প্রতিদিনের এসব কাজ ছিল ঘড়ির কাটায় মাপা। দিনের বিভিন্ন সময়ে আব্বার বিভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ড দেখে তাঁর কাছের মানুষেরা বলতে পারতেন ঘড়িতে কয়টা বাজে। অনর্থক অলসভাবে সময় কাটানো আব্বা একেবারেই পছন্দ করতেন না। শেষ বিচারের দিনে আল্লাহর কাছে সময়ের জবাবদিহিতার কাজটা আব্বা সহজ করে নিয়েছেন এই দুনিয়ায়।
আত্মীয়, অনাত্মীয়, ধর্ম, বর্ণ, ভেদাভেদ ভুলে আব্বা সকল মানুষের মূল্যায়ন করেছেন স্রষ্টার সৃষ্টি মানুষ হিসাবে। আব্বার মৃত্যুর পর শিষ্য এডভোকেট জিয়া হাবীব লিখেছেন “এডভোকেট বদিউল আলম এত বড় এক ব্যক্তিত্ব, দেশের বরেণ্য নাগরিক, চিন্তাবিদ হওয়া সত্ত্বেও তাঁর মাঝে কোন দাম্ভিকতা দেখিনি”। বাড়ির কাজের লোক ড্রাইভার বা সুবিধাবঞ্চিত অসহায় যে কোন মানুষের প্রতি আব্বা ছিলেন কোমল ও সহানুভূতিশীল। উজাড় করে বাড়িয়ে দিতেন সাহায্যের হাত। তাদের প্রতি কোনো প্রকার দুর্ব্যবহার আব্বার অসন্তুষ্টি ও পেরেশানীর কারণ ছিল।
আমাদের শৈশবে অনেক পরিবারের ছেলে মেয়েদের মধ্যে দেখেছি বাবা ভীতি কিন্তু আমরা ছিলাম ব্যতিক্রম। আমাদের সাথে আব্বা আম্মার সম্পর্ক ছিল মধুর। আব্বা আমাদের সম্মোধন করতেন ‘আব্বু’ বা ‘মা’ বলে। প্রায় সময় রাতের খাবার টেবিলে আব্বা আম্মা আমাদেরকে নিয়ে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন, পড়াশুনার প্রতি দুজনেরই ছিল অক্লান্ত আগ্রহ। তাদের নিরন্তর অনুপ্রেরণা আমাদের সবাইকে পড়াশুনা মুখী হতে সাহায্য করেছে। প্রত্যেকে নিজ নিজ দায়িত্বে লেখাপড়া করে যার যার যোগ্যতা অনুযায়ী ফলাফল লাভ করেছে। তবে এ ব্যাপারে কখনই চাপ সৃষ্টি করা হত না। ছোট বেলা থেকেই আব্বা আম্মা আমাদেরকে আল্লাহর বিধানের প্রতি মনোযোগী হওয়া, আদব কায়দা মেনে চলা, শালীনতা বজায় রেখে চলা, আত্মীয় স্বজনদের প্রতি সদ্ভাব বজায় রাখা ইত্যাদি সহ আরও অনেক বিষয়ে সবসময় শিক্ষা দিয়েছেন। মোট কথা আমাদেরকে সুশৃঙ্খলভাবে গড়ে তোলার জন্য একটা সুন্দর, সুস্থ, সাবলীল পরিবেশ তাঁরা সবসময় নিশ্চিত করেছেন। আমরা ভাইবোনেরা পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকি না কেন, তাদের এই শিক্ষা তাদের আদর্শ, মূল্যবোধ আমাদের পথচলার আলোক বর্তিকা হয়ে থাকবে।
সৃষ্টির চিরন্তন বিধান ‘কুল্লু নাফসি জা-ইকাতুল মাউত’ জন্মিলে মরিতে হইবে, আব্বা আম্মা আজ আমাদের মধ্যে নেই তাদের অতি কষ্টে গড়া স্মৃতি বিজড়িত ‘শায়ের’ ভবনটি দাড়িয়ে আছে কত ঐতিহ্য নিয়ে, কালের সাক্ষী হয়ে। আরও আছে আব্বা আম্মার লাগানো হরেক রকমের ফল ফুলের গাছ। আব্বা ও তাঁর ভাই আমাদের বাজির (শ্রদ্ধেয় নুরুল আমিন) জীবনের শেষ দিন কেটেছে এই বাড়ীতেই। প্রতিদিন কতলোকের আনাগোনায় মুখরিত থাকত বাড়ীটি, আত্মীয় স্বজনদের বিয়ে সহ কত সামাজিক অনুষ্ঠানের সাক্ষী এই “শায়েব ৭৬১ বহদ্দারহাট সিডিএ এভিন্যু”।
আব্বা-আম্মা যেন ছিলেন বিশাল বটবৃক্ষ, যার পবিত্র শীতল ছায়াতে আশ্রয় পেয়েছিল অগণিত আত্মীয়-অনাত্মীয়। তাদের যেকোন প্রয়োজনে আব্বা-আম্মা ছিলেন নির্ভলশীলতার খুঁটি। জীবন সায়াহ্নে এসে আব্বা কৃতজ্ঞ চিত্তে আল্লাহর দেওয়া সব নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করে তাঁর বইতে লিখেছেন ‘আমরা যতটুকু আশা করিনি বিধাতা তার চেয়েও বেশী দিয়েছেন বলে আমাদের বিশ্বাস”। অশ্রুসিক্ত নয়নে আম্মাও সবসময় বলতেন “আল্লাহর কাছে শুকরিয়ার শেষ নাই”।
আমরা নিরন্তর আব্বা-আম্মার আদর্শে অনুপ্রাণিত। তাদের জীবনের প্রতিদিনের রোজনামচা আমাদেরকে করে উজ্জীবিত। তাদের অনুসৃত পথ ধরে চলার মাঝে আমরা খুঁজে পাই শান্তি, কল্যাণ, মানবিকতা ও তৃপ্তি। আমাদের আমৃত্যু গর্ব – আমরা তাদের সন্তান। আব্বা-আম্মার সন্তানদের মধ্যে নাতী-নাতনী সহ তাঁদের বংশধর ও আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে তাঁদের আদর্শ সমুন্নত রাখার তৌফিক আল্লাহ দিক।
মহান আল্লাহর দরবারে কায়মনো বাক্যে প্রার্থনা করি “রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানী ছাগিরা”। “হে আমার প্রতিপালক, আমার পিতা-মাতার প্রতি দয়া কর, যেমন তারা দয়া মমতা সহকারে, আমাকে শৈশবে প্রতিপালন করেছিলেন”।
চট্টগ্রামের মত রক্ষণশীল, সামাজিক পারিপার্শ্বিকতায় আমাকে সে সময় উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করা খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। দিনশেষে আব্বার নিজের সফলতা, ছেলে-মেয়েদের সফলতা, Oxford Cambridge থেকে উচ্চশিক্ষিত হওয়া নাতীদের সফলতা – অর্থাৎ তিন প্রজন্মের সাফল্যের দুর্লভ সুযোগ দেখে যাওয়ার সৌভাগ্য আব্বার হয়েছিল। এজন্যে সদা সর্বদায় আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করেছেন।
লেখক : অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক, লন্ডন স্কুল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধইন্টারনেট: ব্যবহার, অপব্যবহার, অতিব্যবহার ও আসক্তি