কবি শঙ্খ ঘোষ স্বতন্ত্র ভাব ও ভাষায় চলতেন। তিনি লিখেছিলেন ছন্দে, ‘একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি/তোমার জন্যে গলির কোণে/ভাবি আমার মুখ দেখাব/মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।’ আমাদের শহরগুলোর অবস্থা এমনই, মুখ ঢেকে যাচ্ছে প্রায় সবখানে। বিজ্ঞাপনী সামগ্রী যেখানে সেখানে, যেমন তেমন লেখা নানাস্থানে, যত্রতত্র অযথা আকিঁবুকি। স্মার্ট সিটি হিসেবে গড়ে উঠার প্রচেষ্টায় এ বড় বেমানান।
গ্রাফিতি একটি শিল্প ধরণ হিসেবে পরিচিত। গ্রাফিতি হচ্ছে দেয়ালে বা যেকোনো সারফেসে আঁকা কোনো চিত্র। সিম্পল কন্টেন্ট থাকবে, সিম্পল আঁকা থাকবে, কিন্তু পেছনের বোধটা থাকবে খুব গভীর। সহজ ভাষায় এটাকেই বলা যায় গ্রাফিতি।
গ্রাফিতি অনেক বছর ধরে হয়ে আসছে। ধরে নেয়া হয় যে, এটি গুহার দেয়ালে প্রথম অঙ্কন করা হয়েছিলো পশুর হাড় দিয়ে খোদাই করে। তখন থেকে পরিবর্তন হয়ে মানুষের বাড়ির অথবা কোনো প্রতিষ্ঠানের দেয়ালে দেয়ালে, যেখানে মানুষের নজরে আসে এমন জায়গায় গ্রাফিতি আঁকা শুরু হয়। প্রাচীন গ্রিক ও রোমানদের সময়কাল থেকে মূলত এই গ্রাফিতির প্রচলন ভালো করে শুরু। গ্রাফিতির নিদর্শন এখনো আছে প্রাচীন গ্রিক শহর এফিসাস বা বর্তমান তুরস্কে।
দেয়ালে কিংবা নানা জায়গায় এ ধরনের আঁকাআঁকি নান্দনিক হতে পারে। বিশ্বের অনেক দেশে সুন্দরভাবে তা দৃশ্যমান। যেমন বিবিসি সূত্রে জানা যায়, ইংল্যান্ডের সেন্টার বার্মিংহাম থেকে হাঁটাপথে কিছুদূর এগোলেই চোখে পরবে প্রতিটি দেয়াল অসাধারণ হয়ে উঠেছে শিল্পীর তুলির ছোঁয়ায়। দিগবেথ এলাকার প্রতিটি ইটের গায়ে রয়েছে বিভিন্ন দেশের শিল্পীর আঁকা ছবি। কিছু কিছু ব্যবসায়ী তাদের দেয়ালে আঁকতে দিতে রাজি হয়েছেন, তাই অনেক শিল্পীও আগ্রহ পান সেখানে আঁকতে। এখানকার যে শক্তিশালী একটা সংস্কৃতি রয়েছে সেটা টের পাওয়া যায় শিল্পকর্মের প্রতিটি পরতে পরতে।
অপরদিকে গ্রাফিতির পাশাপাশি বিজ্ঞাপনও ভেসে উঠছে আধুনিক শহর জুড়ে। সাইনবোর্ড, পোস্টার, ফেস্টুনে। এই বিজ্ঞাপন হচ্ছে, ব্যবসায়িক ও বিপণনের উদ্দেশে কোনো পণ্য–সেবা সম্পর্কে তথ্য তার ভোক্তার কাছে পৌঁছানো। চীনের ইনান শহর থেকে খ্রিস্টপূর্ব সাতশত বছর আগে বিজ্ঞাপনের শুরু। লিউ ফ্যামিলি নিডেল শপ ব্রোঞ্জের প্লেটে খুদাই করে বিজ্ঞাপন প্রচার করে সর্বপ্রথম। ওই বিজ্ঞাপনের ভাষা বর্তমান সময়ের বিজ্ঞাপনের ভাষার সাথে মিল রয়েছে। ১৪ শতকের পর ছাপা খানার আবিষ্কারের পর বিজ্ঞাপনে আসে প্রচারগত বিপুল বিস্তার। সাহিত্য, বইপত্র, গবেষণার কাজে কাগজ ও ছাপাখানার ব্যবহার বৃদ্ধি ঘটে সবিস্তারে। কাগজের ব্যবহারে বিজ্ঞাপনেও গতি আসে, গ্রাহকের কাছে পৌঁছানোও অনেকটা সহজ হয়। পোস্টার দিয়ে বিজ্ঞাপনের সূত্রপাত তখন থেকেই। এখন সেই বিজ্ঞাপনী প্রচারণা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সময়ে এটা প্রচার প্রসারের অন্যতম অবলম্বন।
কিন্তু গ্রাফিতির নামে অযথা উৎপাত, বিজ্ঞাপনচিত্রের দৃষ্টিকটূ উপস্থিতিতো শিল্পসত্তা বিনাশ করে দিতে পারে। নান্দনিকতাকে উজাড় করতে পারে। স্মার্ট সিটিতে এসব জঞ্জাল থাকতে পারে না। স্মার্ট সিটি একটা মিশনের নাম। যে মিশন শহরাঞ্চলে আর্থ–সামাজিক এবং পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সমাজকে সাহায্য করে। তাই প্রতিবেশকে সুন্দর রাখার মিশনটাও চালাতে হবে সবসময়।
উন্নত বিশ্বে গ্রাফিতি কিংবা অযথা–অঅনুমোদিত বিজ্ঞাপন চিত্র অপসারণের সুন্দর ব্যবস্থাপনা আছে। গ্রাফিতি রিমোভাল ইউনিট গড়ে সার্বক্ষণিক নজরদারির ব্যবস্থা আছে। যেখানে যা বেমানান কিংবা অনুমোদনহীন তা এই ইউনিটের মাধ্যমে মুছে ফেলা হয়, অপসারণ করা হয়। লেজার, রং কিংবা অন্যান্য সামগ্রী ব্যবহার করে অপসারণ করা হয় অযথা সব উপস্থিতি। এরপর সেখানে মানানসই কোন কিছু স্থাপন করা হয়, অথবা উক্ত স্থানের সাথে মিল রেখে নতুন চিত্র তৈরি করা হয়।
কয়েকদিন আগে একটি ডকুমেন্টারি দেখছিলাম। অস্ট্রেলিয়ার সিডনী শহরের। গ্রাফিতি রিমোভাল ইউনিটের কার্যক্রম নিয়ে। উক্ত ইউনিট ২৪ ঘন্টাই সক্রিয় থাকে। একটি সুদৃশ্য গাড়িতে এই ইউনিট পরিদর্শনে থাকে। এতে একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত কমকর্তা, কয়েকজন গ্রাফিতি টেকনিশিয়ান, সহায়ক লোকবল থাকেন। তাঁরা যখন যেখানে প্রয়োজন মুভ করেন, কাজে নেমে পড়েন। এর ফলে শহরে বাহ্যিক সুন্দরের একটা রক্ষাকবচ গড়ে উঠে।
আমাদের দেশের শহরেও এমন উদ্যোগ শুরু করা যায়। শুরুতে সীমিত পরিসরে হলেও পরীক্ষামূলকভাবে কাজ করা যায়। দেশে এখন স্থাপত্যকলা, চারুকলা, নগর পরিকল্পনার অনেক বিশেষজ্ঞ ও গ্রাজুয়েট আছেন। তাঁদের সমন্বয়ে বিশেষজ্ঞ ও তদারকি প্যানেল গড়ে তোলা যায়। আর মাঠ পর্যায়ে কাজের জন্য সংবিধিবদ্ধ ইউনিট গড়ে তোলা যায়। এর ফলে আমরা ‘চোখ আরাম পায়’ এমন একটা নগর পেতে পারি।
অযাচিত বিজ্ঞাপনচিত্র, অনুচিত দেয়ালচিত্র–কে থামিয়ে দিতে কার্যকর একটা ব্যবস্থা গড়ে তোলা খুব প্রয়োজন। বিশেষ করে, আমরা এখন স্মাট দেশ হিসেবে আত্নপ্রকাশের মিশনে আছি। এখানে সব সেক্টরে স্মাটনেসের ছোঁয়া অবশ্যই দরকার। নগর সভ্যতার যুগে শহরগুলোকে অবশ্যই আগে আমলে নিতে হবে। স্মাট সিটি–এর মাধ্যমেই স্মাট দেশের আত্মপ্রকাশ সুদৃঢ় হবে। তাই গ্রাফিতি রিমোভাল ইউনিট–এর পথচলা শুরু করা জরুরি বলে মনে হচ্ছে। সেই ইউনিট যে নামেই হোক, যে পরিসরেই হোক–শুরুটা অন্তত হোক।
লেখক: উপ–পরিচালক (তথ্য ও প্রকাশনা), চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)