আজ আমরা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে রয়েছি। এমন একটি যুগ যেখানে ডিজিটাল বাংলাদেশ স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরিত হতে চলেছে। এই রূপান্তরে নারী থাকবে শক্তিশালী রূপকার হয়ে, নির্মাতা হয়ে,যার অংশগ্রহণ ছাড়া উন্নয়ন,সফলতা অনিশ্চিত। ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নিশ্চিতকরণে অন্তর্ভূক্তিমূলক এবং জেন্ডার স্মার্ট প্রকল্প বাস্তবায়নের দিকে আলোকপাত করা প্রয়োজন। কোথায় নেই নারী? বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল এবং গণিত শাখায় নারী যেমন নেতৃত্ব দিচ্ছে অন্যদিকে তেমনি স্মার্ট অবকাঠামো, নগর পরিকল্পনা ও সম্পদ ব্যবস্থাপনায় অনন্য ভূমিকা রাখছে। স্মার্ট অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রণয়ন এবং শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সবার জন্য আর্থিক সুরক্ষা ও ক্ষমতায়নের পথ উন্মুক্ত করতে নারী অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নারীর ভূমিকা হবে অনস্বীকার্য এবং তারই ধারাবাহিকতায় রচিত হবে স্মার্ট বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা : লন্ডনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর) প্রতিবছর বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি নিয়ে প্রক্ষেপণ করে, যা ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক লিগ টেবিল’ নামে পরিচিত। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক লিগ টেবিল ২০২৩ অনুসারে, চলতি মূল্যে ২০৩৭ সালে বাংলাদেশের জিডিপির আকার হবে ১,৬২৮ বিলিয়ন ডলার (দেড় ট্রিলিয়নের বেশি), অর্থাৎ বাংলাদেশ ২০২২ সালের ৩৪তম অবস্থান থেকে ১৪ ধাপ এগিয়ে ২০৩৭ সালে ২০তম বৃহত্তম অর্থনীতি হবে। এই সিইবিআরের মতে, বাংলাদেশ ২০২৭ সালের মধ্যে ২৬তম বৃহত্তম অর্থনীতি হবে। উল্লেখ্য, ২০২৩ এর রিপোর্ট অনুসারে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত (১ম), বাংলাদেশ (২য়), পাকিস্তান(৩য়), শ্রীলঙ্কা (৪র্থ), নেপাল (৫ম), মালদ্বীপ (৬ষ্ঠ), এবং ভুটান ( ৭ম) অবস্থানে রয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে ইউএস (১ম), চীন (২য়), এবং জাপান (৩য়) স্থানে আছে।
বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নে স্মার্ট পদক্ষেপ : নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ এস্তার দুফলো ২০১২ সালে তাঁর গবেষণা কর্মে বলেছেন, নারীর ক্ষমতায়ন প্রকাশিত হয় নারীর নিজস্ব মতামত প্রকাশ,রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ, কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ, নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সক্রিয় ভূমিকার মধ্য দিয়ে। নারীরা অর্থনৈতিক অগ্রগতির অন্যতম শক্তিশালী চালিকাশক্তি। নারীর ক্ষমতায়নের সঙ্গে যুক্ত আছে দেশে প্রবৃদ্ধির হার কী হবে, সর্বজনীন মানবাধিকার কতটা গভীর হবে এবং পরিশীলিত মার্জিত প্রজন্ম তৈরিতে আমরা কতটা সফল হতে পেরেছি বা পারব। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) প্রকাশিত গ্লোবাল জেন্ডার গেপ ইনডেক্স ২০২৩ সালের রিপোর্ট মতে, লিঙ্গ সমতা সূচকের ১৭তম সংস্করণে বিশ্বের ১৪৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৬৫তম।২০২২ সালে ছিল ৭১তম। অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন্ত এই চার মাপকাঠির ভিত্তিতে বাংলাদেশের স্কোর ০.৭২২; যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। যা গত বছর ছিল ০.৭১৪।দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের পরে রয়েছে ভুটান (০.৬৮২), শ্রীলঙ্কা (০.৬৬৩), নেপাল (০.৬৫৯), মালদ্বীপ (০.৬৪৯), ভারত (০.৬৪৩), পাকিস্তান (০.৫৭৫) এবং আফগানিস্তান (০.৪০৫)।
স্মার্ট বাংলাদেশ লক্ষ্য বাস্তবায়নে ইতোমধ্যে সারা দেশে প্রায় ৫০০০ ডিজিটাল সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যেখানে অর্ধেকেরও বেশি নারী কর্মী নিয়োজিত রয়েছে। বাংলাদেশের পোশাক খাতে কর্মরত শ্রমিকের ৮০ শতাংশের বেশি নারী মোবাইলের মাধ্যমে তাদের মাসিক বেতন পেয়ে থাকেন। বর্তমান সরকার ‘ইনফো লেডি’ নামক একটি প্রযুক্তি ভিত্তিক প্রকল্প চালু করেছে যার মাধ্যমে সারাদেশের প্রায় ১০.২৫ মিলিয়ন গ্রামীণ নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব হয়েছে। তাছাড়া, নারীদের সহিংসতা ও যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও সুরক্ষার জন্য ‘জয়’ ১০৯ নামে একটি মোবাইল অ্যাপ চালু করা হয়েছে।
স্মার্ট বাংলাদেশের সুবাতাসের ছোঁয়ায় নারী আজ আত্ম সুরক্ষায় সক্ষম। নারীদের আত্মউন্নয়নে চট্টগ্রাম সহ সারা দেশে মোটর বাইকের (স্কুটি) প্রশিক্ষণ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। এ নব নব উদ্যোগে নারীরা যেমন স্বাবলম্বী হচ্ছে, চিন্তায় উন্নত হচ্ছে, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করছে। নারী এখন প্রযুক্তির আওতায় ঘরে বসেই অনলাইন ব্যবসা করছে, পাশাপাশি ক্লাসও করছে। একটি দেশের আর্থিক উন্নয়ন যেমন দরিদ্রতা দূর করে, শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে নারীর চলার পথ উন্মুক্ত করে তেমনি নারীও নিজের মতামত প্রকাশ ও স্বাবলম্বী হওয়ার প্রত্যাশায় বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মে নিযুক্ত হয়ে দেশের আর্থিক উন্নয়নে ভুমিকা রাখে। একে বলা হয় জেন্ডার ইকুয়ালিটি এন্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট নেক্সাস।
বাংলাদেশ সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে আইসিটিতে নারীর অংশগ্রহণ ৩০ শতাংশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা প্রণয়ন করেছে। ২০২৩–২৪ অর্থবছরের বাজেটে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি–২০১১ অনুসরণে বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে নারীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়ন, জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণ, নারীর জন্য স্মার্ট কর্মজগত এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নারীর অংশগ্রহণ জোরদার করার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে।
কর্মপরিবেশ উন্নয়ন এবং প্রশিক্ষণ ও সচেতনতামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রভাবে কর্মক্ষেত্রে নারী শ্রমশক্তির অংশগ্রহণের হার ২০১০ সালের ৩৬ শতাংশ হতে বর্তমানে ৪২.৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে জেন্ডার সম্পৃক্ত মোট বরাদ্দের পরিমাণ ২ লক্ষ ৬১ হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে নারীরা অগ্রসর হলেও নারীর সার্বিক অগ্রগতি ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে আমাদের আরো সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাল্যবিবাহের হারে বাংলাদেশ এখনো শীর্ষে। বাংলাদেশে ১৮ বছর বয়সের আগেই ৫১ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। বাংলাদেশে এখনো নারীর প্রতি নানা বৈষম্য,অবিচার,শ্রীহানি পরিলক্ষিত হচ্ছে। তা নির্মূলের একমাত্র হাতিয়ার হবে শিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষার পাশাপাশি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় নারীদের অধিকতর অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে।
‘অ্যান আনসার্টেন গ্লোরি, ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইটস কনট্রাডিকশন্স’ (২০১৩) প্রবন্ধে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, “বাংলাদেশের বেগবান নারী–আন্দোলন, সক্রিয় এনজিও–কার্যক্রম ও বেইজিং–পরবর্তী বিশ্ব–নারী–উন্নয়ন এজেন্ডার প্রভাবে নব্বইয়ের দশক থেকে বাংলাদেশ সরকারের নারী উন্নয়ন নীতি ও তা বাস্তবায়নের কার্যকর কৌশলের লক্ষ্যে যে ইতিবাচক পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করেছে, তার মাধ্যমে বাংলার নারীজীবনে এক নীরব বিপ্লবের সূচনা ঘটে, যাকে বিশ্বব্যাংক আখ্যা দিয়েছে ‘হুইসপার টু ভয়েসেস’ (২০০৮)।”
বিশ্বব্যাংকের মতে, যেসব দেশে শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণের হার বেশি, সেসব দেশের অর্থনীতির আরও শক্তিশালী হওয়ার প্রবণতা রয়েছে। এর কারণ হলো যখন নারীদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ প্রদান করা হয় তখন তারা অর্থনীতিতে আরও সম্পূর্ণভাবে অবদান রাখতে পারে, যা উৎপাদনশীলতা, উদ্ভাবন , দারিদ্র্য হ্রাস এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উন্নীত করতে পারে।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফলে একদিকে শিল্পের আকার বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে নারীর অংশগ্রহণ কমছে। এর দুটি কারণ আছে। প্রথমত, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ফলে অনেক যন্ত্রপাতি আবিষ্কৃত হচ্ছে। ইন্ডাস্ট্রির আকার বাড়ছে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি ছাড়াই যাকে বলা হয় জবলেস গ্রোথ। এ ক্ষেত্রে শ্রমবাজারে নারীর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বেশি। দ্বিতীয়ত, শিল্পকারখানা আধুনিকায়নের ফলে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে, যা নারীদের পক্ষে রাতারাতি আয়ত্ত সম্ভবপর নয় । প্রযুক্তি গত দক্ষতা অর্জনে চাই অধিক বিনিয়োগ, চাই কাজ করার সুযোগ।
স্মার্ট বাংলাদেশ (স্মার্ট নাগরিক,স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সরকার ও স্মার্ট সমাজ) এ চারটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রকে চিহ্নিত করে অগ্রসর হচ্ছে যেখানে স্মার্ট নাগরিক ও স্মার্ট সরকার এর মাধ্যমে সব সেবা এবং মাধ্যম ডিজিটালে রূপান্তরিত হবে। আর স্মার্ট সমাজ ও স্মার্ট অর্থনীতি প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করবে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন এবং ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ। তবে দেশ তখনই স্মার্ট হবে যদি দেশ জেন্ডার স্মার্ট হয়, চিন্তা আর মনন স্মার্ট হয়। আসন্ন নারী দিবস ২০২৪ এর প্রতিপাদ্য বিষয় (নারীর সমঅধিকার, সমসুযোগ,এগিয়ে নিতে হোক বিনিয়োগ) আরো আরো সুনিশ্চিত করবে নারীর পথচলা। পিছে পড়ে থাকার দিন শেষ। সকল বৈষম্য থেকে মুক্তি পেতে নারীকে তার পরিমাপযোগ্য মাইলফলক তৈরি করে গ্লাস সিলিং ভাঙার চেষ্টা করতে হবে। সমতা আসবেই।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও গবেষক