স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে গণমাধ্যমের দায়িত্বশীল ভূমিকা

রাশেদ রউফ | মঙ্গলবার , ২১ মে, ২০২৪ at ৮:৪১ পূর্বাহ্ণ

স্মার্ট বাংলাদেশ ও গণমাধ্যম। এ বিষয়ে নগরে এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হলো গত শনিবার। বাংলাদেশ টেলিভিশনচট্টগ্রাম আয়োজিত এ সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন তথ্য ও সমপ্রচার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোঃ হুমায়ুন কবির খোন্দকার। ‘স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ ও গণমাধ্যম’ বিষয়ে ৩০ মিনিটের প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার প্রফেসর ড. তৌফিক সাঈদ। বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সভা কক্ষে অনুষ্ঠিত এ সেমিনারে আলোচক ছিলেন কবি প্রাবন্ধিক সাংবাদিক আবুল মোমেন, কবি কথাসাহিত্যিক সাংবাদিক বিশ্বজিৎ চৌধুরী। নির্ধারিত আলোচক হিসেবে আমার বক্তব্যও উপস্থাপন করার সুযোগ হয়েছিলো। সেমিনারের সভাপতি বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের ম্যানেজার নূর আনোয়ার হোসেন সেমিনারের শুরুতে সূচনা বক্তব্য দেন। প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. ঈমাম হোসাইনের সঞ্চালনায় সেমিনারে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকবৃন্দ ও বিটিভি’র কর্মকর্তা ও কর্মচারী উপস্থিত ছিলেন।

সিনিয়র তথ্য সচিব মোঃ হুমায়ুন কবির খোন্দকার তাঁর বক্তব্যে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে সরকারের পদক্ষেপ ও সুচিন্তিত পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনসংখ্যার মধ্যে শতকরা ৬৮ ভাগ হলো কর্মক্ষম জনসংখ্যা। আবার এদের মধ্যে অধিকাংশ হলো যুবক। তথ্য প্রযুক্তির বিভিন্ন দিক রয়েছে যেগুলো যুবকরা খুব সহজে বুঝতে পারে কিন্তু আমাদের পক্ষে অনেক সময়ের ব্যাপার। তাই তরুণরাই স্মার্ট বাংলাদেশের অভিযাত্রার সূর্য সারথি। তিনি বলেন, জ্ঞান ও প্রযুক্তির সমন্বয়ে নিজেকে তৈরি করতে পারলেই স্মার্ট বাংলাদেশের যোগ্য নাগরিক হওয়া সম্ভব। এ লক্ষ্যে মানুষকে উৎসাহিত করতে তিনি গণমাধ্যমকে বেশি বেশি ‘সাকসেস স্টোরি’ তৈরির ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

আসলে এই ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্নেরই প্রতিফলন। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ থেকে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’এ উত্তরণ তাঁর মেধা, সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও অগ্রচিন্তার ফসল। তিনি বলেছেন, স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১ প্রতিষ্ঠার জন্য এখন থেকে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্স’ ‘স্মার্ট বাংলাদেশ টাস্কফোর্স’ হিসেবে কাজ করবে। স্মার্ট বাংলাদেশের চারটি স্তম্ভ ঠিক করা হয়েছে। এগুলো হলোস্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট সোসাইটি, স্মার্ট ইকোনমি ও স্মার্ট গভর্নমেন্ট। এ চারটি স্তম্ভের আলোকে স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য বাস্তবায়নে কানেক্টিভিটি (অবকাঠামো উন্নয়ন), মানব সম্পদ উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ, ফ্রিল্যান্সারদের উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ এবং ইভেন্ট ও প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার আয়োজনে সরকার কাজ করে যাচ্ছে বলে তিনি জানান।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের সফলতার ধারাবাহিকতায় ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য বাংলাদেশের অর্থনীতি, শিল্প, পর্যটন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, আর্থিক খাত, ইত্যাদির দক্ষতা বৃদ্ধি ও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে উন্নত বিশ্বের সমপর্যায়ে নেওয়ার লক্ষ্যে ৫ মন্ত্রী, ১ প্রতিমন্ত্রীসহ ৩০ সদস্য বিশিষ্ট স্মার্ট বাংলাদেশ টাস্কফোর্স গঠন করে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে।

বিটিভি চট্টগ্রামের সেমিনারে সিনিয়র তথ্য সচিব মোঃ হুমায়ুন কবির খোন্দকার প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন ও পরিকল্পনার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।

আমরা জানি আমরা ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছি। শিল্পবিপ্লবের ফলেই বিশ্ব অর্থনীতির সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলে থাকেন, বর্তমান বিশ্বও টিকে আছে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতির ওপর। এখন পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে মোট তিনটি শিল্পবিপ্লব ঘটেছে। যদিও আমরা মনে করি, সৃষ্টির শুরু থেকেই এই বিপ্লব শুরু। এ শিল্পবিপ্লবগুলো বদলে দিয়েছে সারা বিশ্বের গতিপথ, বিশ্ব অর্থনীতির গতিধারা। প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও নিত্য নতুন আবিষ্কারের ফলে বিশ্ব এগিয়ে গেছে। বিদ্যুৎ আবিষ্কারের ফলে একেবারেই পাল্টে যায় মানুষের জীবনের চিত্র। বলা যায়, মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণ করে বিদ্যুৎ। কায়িক পরিশ্রমের জায়গা দখল করে নেয় বিদ্যুৎচালিত যন্ত্রপাতি। ধীরে ধীরে কমতে থাকে শারীরিক শ্রমের দিন। এরপর মানুষের হাতে এলো ইন্টারনেট। শুরু হয় ইন্টারনেটভিত্তিক নতুন অধ্যায়। ফলে তথ্যপ্রযুক্তির সহজ ও দ্রুত বিনিময় শুরু হয় সারা বিশ্বে। ম্যানুয়াল জগতের পাশাপাশি জায়গা করে নেয় ভার্চুয়াল জগৎ। এবার আমরা আরো একটি বিপ্লবের মুখোমুখি, যার নাম চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। এটি আসছে ভার্চুয়াল জগতেরই আরও বিস্তৃত পরিসর নিয়ে। যেখানে মানুষের আয়ত্তে আসছে ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ইন্টারনেট অব থিংস বা যন্ত্রের ইন্টারনেট’, যা সম্পূর্ণ রূপেই মানবসম্পদের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে! এ নিয়েই এখন তোলপাড় চলছে সারা পৃথিবীজুড়ে।

স্মার্ট বাংলাদেশ প্রক্রিয়ার চ্যালেঞ্জগুলো বিবেচনায় এনে জনমত তৈরি করে জনসাধারণকে স্মার্ট করে তোলাও অন্যতম কাজ হতে পারে গণমাধ্যমের। কেননা, স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণে, বিশেষত স্মার্ট নাগরিক তৈরিতে গণমাধ্যমের দায়িত্বশীল ভূমিকা জরুরি। জনগণ যদি মনমানসিকতায় স্মার্ট না হয়, তাহলে স্মার্ট দেশ প্রতিষ্ঠিত হবে না। তাই সাধারণ মানুষকে প্রগতিশীল ধ্যানধারণায় উদ্বুদ্ধ করা, বিজ্ঞানচেতনায় ধাবিত করা, কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতা থেকে মুক্ত রাখা, অসাম্প্রদায়িক ভাবধারায় উজ্জীবিত করা, সর্বোপরি পরিশীলিত রুচিবান শিক্ষিত সমাজ গঠনে অসামান্য গণমাধ্যম অবদান রাখতে পারে।

স্মার্ট বাংলাদেশে সাংবাদিকতায় যেমন ব্যাপক পরিবর্তন আসবে, তেমনি চ্যালেঞ্জও তৈরি হবে। ডিজিটালাইজেশন সাংবাদিকতার কারণে কাগজকলমের ব্যবহার কমেছে। ধীরে ধীরে আমরা পেপারলেস সিস্টেমের দিকে এগোচ্ছি। তাই বর্তমানে সবক্ষেত্রে ডিজিটাল যন্ত্রের ব্যবহার ও ডিজিটাল দক্ষতা অর্জন সাংবাদিকতার জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। নানা তথ্যউপাত্তের মাধ্যমে ডিজিটাল মিডিয়া দিন দিন সমৃদ্ধ হচ্ছে। প্রচলিত মিডিয়ার চেয়ে বহুগুণ বেশি তথ্যউপাত্ত উপহার পাচ্ছেন আমাদের পাঠকরা। বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘তথ্যউপাত্ত পাঠক ও দর্শকের কাছে অডিও, ভিডিও কিংবা প্রিন্ট ভার্সনে গ্রহণযোগ্য করে উপস্থাপনের বিষয়টিও স্মার্ট যুগের সাংবাদিকতার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।’ তাই বলতে পারি, তথ্য প্রযুক্তির নতুন নতুন উদ্ভাবনার ফলে সাংবাদিকতায় নতুন মাত্রা যুক্ত হবে। এই তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়েই সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করতে হবে।

মিডিয়া এখন বিস্তৃত আয়না। পৃথিবীর সব দৃশ্য এতে দৃশ্যমান। এখন কাজ যত সহজ ও দ্রুততর হচ্ছে, তেমনি গতিশীল হচ্ছে সাংবাদিকতা। স্বাধীন সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধ বা মুক্ত তথ্য প্রবাহ থেকে মানুষকে বঞ্চিত রাখা এখন আর সম্ভব হচ্ছে না। তথ্য প্রযুক্তির দ্রুত ও অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রার কারণে গণমাধ্যম এখন অনিবার্য ভরসাস্থল হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে মানুষের কাছে। আমাদের সাংবাদিকতার মূলধারাটি সবসময় আপামর জনসাধারণের পাশে থেকেছে এবং তাতে জনগণের বিজয়ের পাশাপাশি সাংবাদিকতার পথের অনেক বাধাও অপসারিত হয়েছে। প্রিন্ট মিডিয়ার আধুনিকায়ন ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বিপুল বিস্তারের পাশাপাশি মানুষ পাচ্ছে অনলাইন তথা নতুন সাংবাদিকতাকে। আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে সংবাদ মাধ্যম ও সাংবাদিকদের শক্তি অনেক বেশি সংহত হয়েছে এবং অনেক বেশি স্বাধীনতা অর্জন করছে। ভবিষ্যতে এ ধারা অব্যাহত থাকবে এবং জনগণ নতুন ধারার সাংবাদিকতার মুখোমুখি হবে। আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গাটা আরো বেশি দৃঢ় ও মজবুত হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী;

ফেলো (নম্বর৪২২), বাংলা একাডেমি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাংলাদেশ বিমান : সেবার মান বাড়িয়ে যাত্রীদের আস্থা অর্জন করতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধজসিম উদ্দিন সিকদার