স্মরণ : রণাঙ্গনের সাহসী সৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কুদ্দুছ

জাহাঙ্গীর আলম শামীম | বৃহস্পতিবার , ৬ এপ্রিল, ২০২৩ at ৫:৪১ পূর্বাহ্ণ

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকেরা তথা বাঙালিরা নির্দয় শোষণ, ক্ষুধা, বঞ্চনা, নিরক্ষরতা, সাম্প্রদায়িকতা, স্বৈরাচার, দারিদ্র্য ও মৃত্যুর বিরুদ্ধে নিরলস সংগ্রাম চালিয়ে আসছে। সাম্রাজ্যবাদী শোষকেরা বাঙালিদের প্রিয় ভূমিকে একটা নিকৃষ্টতম উপনিবেশে পরিণত করতে থাকে। বঞ্চিত বাঙালিরা শোষণের চাকায় পিষ্ট হয়ে মৃত্যুবরণ করতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানীরা যখন দারিদ্র্য ও ক্ষুধায় নিমজ্জিত তখন তদানীন্তন পাকিস্তানী শাসক চক্র বাঙালিদের কষ্টার্জিত তিন হাজার কোটি টাকা লুট করে পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নের জন্য নিয়ে যায়। আর বাঙালিরা যখন ন্যায় বিচারের জন্য আবেদন জানিয়েছে তখন তাদের ভাগ্যে জুটেছে নিষ্পেষণ আর করুণ মৃত্যু। আর এসব নির্মম জুলুমবাজির কারণে বাঙালিদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেলে শুরু হয় দুর্বার প্রতিরোধ আন্দোলন যা অবশেষে স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ নেয়। আর এ মুক্তির আন্দোলনে বাঙালিদের জন্যে অমৃত সুধার মতো আর্শীবাদ হয়ে আসেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালিদের কাছে এক ম্যাজিক নেতা। কারণ শতকোটি বাঙালিকে ম্যাজিকের মতো একতাবদ্ধ করা বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কোনো বাঙালি নেতা পারেননি। তাঁর চুম্বকীয় ম্যাজিক নেতৃত্বের দ্বারা ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের সকল পেশার জনগণ তথা বাঙালি সংগ্রামী জনগণ স্বাধীনতার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের বিশ্বখ্যাত ভাষণের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ প্রকৃত অর্থেই মুক্তির সংগ্রাম তথা স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হতে থাকে। আর ২৫ মার্চ যখন বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয় তখন বঙ্গবন্ধু সংগ্রামী বাঙালিদেরকে স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়ে যান। আর এরই প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন সামরিক ও বেসামরিক বাহিনী গঠিত হয়। এসব বাহিনীর মধ্যে নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী, নৌকমান্ডো, মুজিব বাহিনী, কাদেরিয়া বাহিনী, হেমায়েত বাহিনী, লতিফ বাহিনী, .পি.আর, আফসার ব্যাটালিয়ন, হালিম বাহিনী, আকবর বাহিনী, বাতেন বাহিনী, কুদ্দুছ বাহিনী, গফুর বাহিনী, ন্যাপসিপিবিছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনী অন্যতম। এসব বাহিনীর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হাজার হাজার যোদ্ধারা মুক্তিযুদ্ধে অতীব গুরুত্ব ভূমিকা পালন করে। তেমনি একজন চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা তৎকালীন পাকিস্তান নৌবাহিনীর বর্ষীয়ান নৌ অফিসার সমুদ্র সৈনিক মোহাম্মদ আব্দুল কুদ্দুছ। যার যুদ্ধকালীন ভূমিকা অন্যান্য বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মত আমাদের অবশ্যই জানা দরকার। যেহেতু বীর মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান তাই তাদের অবদান কিংবা ভূমিকা প্রত্যেক দেশপ্রেমিক নাগরিকের জেনে রাখা এবং তাদের ত্যাগের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানানো উচিত নতুবা আমরা অকৃতজ্ঞ বাঙালি হিসেবে পরিচিত হবো। আর এ কারণে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর কন্যা জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনাও বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং তাঁদের পরিবারকে যথেষ্ট মূল্যায়ন করে যাচ্ছেন এবং যথারীতি সবার খোঁজও নিচ্ছেন। ৭১ রণাঙ্গনের এই সাহসী সমুদ্র সৈনিক রাউজানের বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আব্দুল কুদ্দুছ, মাস্টার অ্যাট আর্মস (অব.) বাংলাদেশ নৌবাহিনী, ১৯৩২ সালের ১০ অক্টোবর তৎকালীন বৃটিশ শাসনামলে চট্টগ্রাম মহকুমা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মৃত মুন্সী খুরশিদ মিয়া আর মাতার নাম মৃত এম.এস. আবেদা খাতুন। ১৯৫১ সালে উচ্চ শিক্ষা সম্পন্ন করার পর তৎকালীন পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান নৌবাহিনীর কুমিল্লা রিক্রুটিং অফিসে কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে দেশের স্বাধীনতার জন্যে দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে পাকিস্তান পক্ষ ত্যাগ করে ৯নং সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ৯নং সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর এম.এ জলিল আর ভারতীয় অধিনায়ক ছিলেন ভারতের নৌবাহিনীর এরিয়া কমান্ডার এম.এন সামন্ত। উল্লেখ্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আবদুল কুদ্দুছ মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল আতাউল গনি ওসমানীর সরাসরি নিয়ন্ত্রণে বিশেষ কমান্ডো বাহিনীতেও দায়িত্ব সফলভাবে পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে তিনি খাগড়াছড়ির সীমান্তবর্তী রামগড় থেকে ভারতের আগরতলা, দুর্গাচৌধুরী পাড়া, পশ্চিমবঙ্গের কল্যাণী ক্যাম্প এবং হলদিয়ার মেদিনীপুর ক্যাম্পে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেন। তাছাড়া যুদ্ধচলাকালীন তিনি নৌ কামান্ডোদের বিশেষ ক্যাম্প ইউনিট চি টু এইচ (চি টু হলদিয়া) এর সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার (চীফ পেটি অফিসার) পদে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি ইউনিট সহকারে ক্যাম্প থেকে নৌবাহিনীর রণতরি গানবোট ‘পলাশের’ মাধ্যমে ১৯৭১ সালে নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে বঙ্গোপসাগরের মোংলা চ্যানেলে এক সার্থক অপারেশনে অংশ নিয়ে সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বিশ্ব সম্প্রদায়ের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসতে সক্ষম হন ( সূত্র: দৈনিক কালের কন্ঠ, ১০ মার্চ ২০১৫; বীর মুক্তিযোদ্ধা লে. (অব.) বি.এন.এ হাই এর কলামে)। তাঁর ইউনিটের গুরুত্বপূর্ণ ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অপারেশনটি ছিল বঙ্গোপসাগরের মোংলা চ্যানেলের প্রবেশমুখে ৮নং ফেয়ার ওয়ে বয়ার এর কাছে শক্তিশালী মাইন (বোমা) বিস্ফোরণের সাহায্যে পাকিস্তান নৌবাহিনীর কনভার্টেড গানবোট পি.এন.এস তোফায়েলসহ ছয়টি ছোটবড় দেশিবিদেশী জাহাজ ডুবিয়ে মোংলা চ্যানেলের প্রবেশ মুখ বন্ধ করা। এ সময় তিনি এবং তাঁর ইউনিটের সঙ্গীরা জীবনবাজি রেখে মোংলা চ্যানেলের প্রবেশ মুখে ‘ফেয়ার ওয়ে বয়া’ ১ থেকে ৮ পর্যন্ত বিস্তৃত চ্যানেলে আটটি ১ হাজার ১০০ পাউন্ড ওজনের টর্পেডো আকৃতির মাইন (বোমা) সমুদ্র গর্ভে স্থাপনে অন্যতম ভূমিকা পালন করেন। যে কারণে পাকিস্তান সরকার আন্তর্জাতিকভাবে মোংলা বন্দরকে বন্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। আর এভাবে একটি স্বাধীন দেশের বিজয় ত্বরান্বিত করতে অন্যান্য বীর সেনাদের মতো এ সমুদ্র সৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আব্দুল কুদ্দুছও সাহসী ভূমিকা পালন করেন। দেশ স্বাধীন হলে এ বর্ষীয়ান নৌ কর্মকর্তা বাংলাদেশ নৌবাহিনী থেকে অবসরে গিয়ে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনীয়াস্থ ই.সি.আই.এল (ভবানী মিল) এর প্রধান পরিদর্শক এবং পরবর্তীতে চট্টগ্রাম শহরের নাসিরাবাদস্থ তৎকালীন ক্রিসেন্ট সোপ ফ্যাক্টরীতে সিনিয়র কর্মকর্তা পদে দায়িত্ব পালনকালে মরণব্যাধি ক্যান্সারের কাছে হার মেনে ১৯৭৯ সালের ৭ এপ্রিল ইন্তেকাল করেন। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী রাউজান উপজেলার রাউজান পৌরসভার পশ্চিম রাউজান গ্রামের ৯নং ওয়ার্ডে তাঁর নিজবাড়ি সংলগ্ন ফকির তকিয়া জামে মসজিদের কবরস্থানে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান এ বীর মুক্তিযোদ্ধাকে দাফন করা হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতীয় তালিকায় ২০৫৩৪ নং ক্রমিকে তাঁর নাম অন্তর্ভুক্ত আছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে এ বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম চির উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।

লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও ফার্মাসিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধভেবে দেখতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধকাল আজকাল