আমাদের গর্ব, অনুপ্রেরণা ও এগিয়ে চলার অন্যতম শক্তি হচ্ছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। তাই যতটুকু সম্ভব স্বাধীনতার ইতিহাস সবার জানা দরকার। আমাদের বীরত্বগাথা এই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জেনেছে দেশ হতে দেশান্তরে। কিন্তু অনেক বীর সাহসী ও দেশপ্রেমীর ইতিহাস অজানা রয়েছে গেছে আজো। আত্মত্যাগের কথা জাতি ও নতুন প্রজন্ম জানতে পারেনি অতীতের সময় ও অসময়ের কারণে। আর এই অজানা ইতিহাসের একটি বীর শহীদদের আরেক নাম শহীদ বুদ্ধিজীবী এম.এ. কাদের। খুব কম মানুষের সৌভাগ্য হয়েছে শহীদ এম. এ কাদেরকে জানার। আজ ৩রা মে এইদিনে আমরা বিনম্র শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি মহান এই মুক্তিযোদ্ধাকে। ১৯৭১ সালের ৩ মে এম. এ. কাদের কে পাকিস্তানী সৈন্যরা গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার পর পরিবারের কাছে ফিরে আসেনি। এম.এ.কাদের রাউজান থানার মোহাম্মদপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করে। শিক্ষা জীবন শেষ করে ব্যাংকিং পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করার মানসে চট্টগ্রামে LLOYDS ব্যাংকে অফিসার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি ইউনাইটেড ব্যাংকের কায়দে আযম রোড (বর্তমানে শেখ মুজিব রোড) প্রতিষ্ঠাতা শাখা ব্যবস্থাপক হিসাবে যোগদান করেন। পরবর্তীতে তিনি ঐ ব্যাংকের লালদীঘি শাখা সহ অন্যান্য শাখার ব্যবস্থাপক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৬৬ সালে এম. এ কাদেরকে আরও বড় দায়িত্ব দিয়ে ইউনাইটেড ব্যাংক লিমিটেডে করাচির প্রধান কার্যালয়ে বদলি করা হয়। ১৯৬৮ সালে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে ইউনাইটেড ব্যাংক লিমিটেড এর বৃহত্তর ঢাকা ও ময়মনসিংহের আঞ্চলিক প্রধানের সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন।
পশ্চিম পাকিস্তানের কর্মসূত্রে এবং ব্যাংকের বিভিন্ন কার্যক্রমে তিনি বাঙালি ও পশ্চিম পাকিস্তানীদের মধ্যে অনেক বৈষম্য দেখতে পান। বিভিন্ন সময়ে তিনি এই জন্য প্রতিবাদ করতেন। এক পর্যায়ে ব্যাংকের বাঙালি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সাথে বৈষম্য মূলক আচরণের কারণে ইউবিএল উচ্চ প্রদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে চরম দ্বন্দ্ব হয়। এবং তিনি প্রতিবাদ হিসাবে ইউনাইটেড ব্যাংক লিমিটেড হতে নিজে ইস্তফা দেন।
১৯৬৯ সাথে তিনি দেশে ফিরে এসে বৃহত্তর বাণিজ্যিক ব্যাংক স্ট্যাডার্ড ব্যাংক লিমিটেড এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং বৃহত্তর চট্টগ্রাম বিভাগের (চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা, সিলেট ও পাবর্ত্য চট্টগ্রাম) প্রধান হিসাবে যোগদান করেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের হাতে গোনা কয়েকজন খ্যতিনামা ব্যাংকারের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। ব্যাংকের দায়িত্ব ছাড়াও দেশ, সমাজ উন্নয়নে তিনি বিভিন্ন সংগঠন, সংস্থাকে অনুদান ও সহযোগিতা প্রদান করতেন ও বিভিন্ন সংগঠনের সাথে নিযুক্ত ছিলেন। উল্লেখ্য তিনি এ আন্তর্জাতিক সেবা সংগঠক লায়ন্স ক্লাব অব চিটাগাং এর ট্রেজারার ও চট্টগ্রাম ক্লাবের লিমিটেড এর সদস্যও ছিলেন। এলাকায় তরুণদের নিয়ে উৎসাহ উদ্দীপনায় মধ্যে সংগঠনকল্পে সহযোগিতা ছিল উল্লেখ্য। এম. এ কাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদের বড় সমর্থক ছিলেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণে পূর্ব পাকিস্তানে থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের সেন্ট্রাল ব্যাংকে টাকা না পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেলেন। এম এ কাদের প্রথম ব্যাংকার ছিলেন, যিনি বঙ্গবন্ধুর আহবানের তাঁর তত্ত্বাবধানে ব্যাংকের টাকা পশ্চিম পাকিস্তানে সেন্ট্রাল ব্যাংকে পাঠানো বন্ধ করেন। যা তৎকালীন জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে তিনি রাউজানে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের স্বপক্ষে ভূমিকা রাখেন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে স্বাধীনতার আন্দোলনে চট্টগ্রাম অর্থ তহবিল সংগ্রহ কমিটির তিনি একজন সদস্য ছিলেন। ১৯৭১ সালে ২৫শে মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা একটি বার্তা বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর স্বাধীনতার পরবর্তী বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রি সভার প্রভাবশালী মন্ত্রী মতিউর রহমান টেলিফোনে এম.এ কাদেরকে জানালে তিনি তা তৎকালীন অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট অফিসে পৌঁছে দিতে সক্ষম হন। মুক্তিযোদ্ধো ১নং সেক্টর কমান্ডার সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর (অব) রফিকুল ইসলাম (বীর উত্তম) লিখিত মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবান গ্রন্থ ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’ এই ঘটনা লিপিবদ্ধ আছে। স্বাধীনতাযুদ্ধে এম.এ কাদেরের অবদানের কথা ১৪ খণ্ড স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিল পত্রে উল্লেখ আছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য ডঃ এ আর মল্লিক তাঁর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণে শহীদ এম. এ কাদের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে কার্যক্রম লিপিবদ্ধ করেছেন। দৈনিক ইত্তেফাকের প্রাক্তন সম্পাদক রাহাত খান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার রচিত লেখায় শহীদ এম. এ. কাদেরের মুক্তিযুদ্ধ অবদানের কথা উল্লেখ করেছেন। শহীদ এম. এ কাদের তাঁর জীবদ্দশায় অনেক লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছিলেন। সাধারণ মানুষের প্রতি তাঁর ভালবাসা ছিল অপরিসীম। এলাকার সাধারণ মানুষের প্রতি ভালবাসা, মমত্ববোধ কথা এখনও স্মরণ রেখেছেন।
শহীদ জায়া মিসেস সালেহা কাদের ক্ষোভ অভিমানে অনেক সুযোগ থাকা সত্ত্বেও শহীদ পরিবার হিসেবে রাষ্ট্রের কাছ থেকে কোন আর্থিক আনুকূল্য গ্রহণ করেননি, অনেক দুঃখ-কষ্টকে বরণ করে তিনি তার ছেলে মেয়েকে সু-শিক্ষিত করেছেন। শহীদ এম.এ কাদেরের একমাত্র সন্তান প্রকৌশলী ক্যাপ্টেন রফিকুল কাদের একজন মেরিন প্রকৌশলী এবং যুক্তরাজ্যের হাল ইউনিভার্সিটি থেকে এম.বি.এ ডিগ্রি প্রাপ্ত। তিনি বর্তমানে বহুজাতিক এবং বিশ্ব বিখ্যাত তেল কোম্পানি এঙন মবিল লিমিটেড উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে সিংঙ্গাপুরে কর্মরত আছেন। অন্য দুজন কন্যা সন্তান বিবাহিত। শাহেদা নাসরিন এবং সাহেনা নাজনীন তারা স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। যদিও রাষ্ট্রের কাছ থেকে সেভাবে তারা কোন সম্মাননা স্বীকৃতি পাননি। স্বাধীনতার যুদ্ধের প্রথম প্রহরে ১৯৭১ সালের মার্চ মাস থেকে মে মাস পর্যন্ত চট্টগ্রামের অনেক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়। এদের মধ্যে অন্যতম কুন্ডেশ্বরী ঔষধালয় ও কলেজের প্রতিষ্ঠাতা দানবীর অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহ, চট্টগ্রাম বন্দরের প্রধান প্রকৌশলী শহীদ শামসুজ্জামান, নির্বাহী প্রকৌশলী শহীদ নূর হোসেন, চট্টগ্রাম পুলিশের এসপি শহীদ শামসুল হক সহ সকল শহীদ দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে শহীদের প্রিয়জন স্বজন হারানোর মত শহীদ এম.এ কাদেরের পরিবার ও বহুকষ্ট বুকে নিয়ে আগামী সুখি, সমৃদ্ধ অসাম্প্রদায়িক ও মানবতার বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন যে দেশে মুক্তিযোদ্ধা শহীদদের যথাযোগ্য সম্মান দিতে না পারলেও অপমান যেন না করা হয়। এ লেখায় ও দৈনিক আজাদীর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করবো, শহীদ বুদ্ধিজীবী এম. এ কাদের এর পরিবারকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করে জাতিকে সম্মানিত করুন।
লেখক : ব্যাংকার ও তরুণ সংগঠক