বিংশ শতাব্দীতে যেসব সমাজতান্ত্রিক নেতা বিশ্ব রাজনীতিতে প্রবলভাবে আলোচিত ছিলেন, ফিদেল ক্যাস্ট্রো তাদের অগ্রগণ্য। তিনি ছিলেন ২০ শতকের কিংবদন্তী। ১৯৫৯ সালে ৩২ বছর বয়সী জি ফিদেল ক্যাস্ট্রোর নেতৃত্বে একটি বিদ্রোহী দল কিউবার জন সমর্থনহীন একনায়ক ফুল গেন্সিও বাতিস্তাকে উৎখাত করে। ফুল গেন্সিও ব্যতিস্তার একনায়কতন্ত্রে অতিষ্ঠ হাজার হাজার কিউবান এ সময় ক্যাস্ট্রোর নেতৃত্বাধীন বিপ্লবীদের অভিনন্দন জানান। ক্যাস্ট্রোকে কিউবার প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করা হয়। জনগণের প্রতি মমত্ববোধ থেকে কিউবাকে বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করেন ক্যাস্ট্রো। এই মহান নেতা ১৯২৬ সালের ১৩ আগষ্ট জন্মগ্রহণ করেন।
কিউবার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়ে সফল হওয়ার পর ফিদেল ক্যাস্ট্রো ৪৯ বছর দেশটির ক্ষমতায় ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সমাজতান্ত্রিক কিউবা প্রতিষ্ঠাকারী ফিদেল ক্যাস্ট্রো বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকারীদের চোখে বীর হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হন। যুক্তরাষ্ট্রের নাকের ডগায় বসে প্রায় অর্ধ শতাব্দী সমাজতান্ত্রিক শাসন ধরে রাখেন ক্যাস্ট্রো। তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করতে অনেক চেষ্টা হয়েছে। প্রাণহানির চেষ্টাও হয়েছে। তাঁর ৪৯ বছরের ক্ষমতায় ১১ মার্কিন প্রেসিডেন্ট হোয়াইট হাউসে শপথ নিয়েছেন। ফিদেল ক্যাস্ট্রোকে সড়াতে পারেননি কেউ। সমর্থকদের কাছে তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন।
১৯৫২ সালে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফুলগেন্সিও বাতিস্তা কিউবার ক্ষমতা দখল করেন। বাতিস্তার সরকার ছিল যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত। এই সরকার ছিল জনসমর্থনহীন এবং একনায়ক। ফুলগোন্সিও বাতিস্তার নির্মম একনায়কতন্ত্রে কিউবার জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। এই অবস্থায় ফিদেল ক্যাস্ট্রো তরুণ বয়সে ফুলগেন্সিও বাতিস্তার সরকারের বিরুদ্ধে গেরিলা বাহিনী গঠন করেন। একারণে ক্যাস্ট্রোর ২ বছর কারাদণ্ড হয়। এরপর তিনি স্বেচ্ছা নির্বাসনে যান। ১৯৫৬ সালের ২ ডিসেম্বর ক্যাস্ট্রো তাঁর দল নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সূচনা করেন। কিউবার জনগণ ক্যাস্ট্রোর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও বাতিস্তা সরকারের নির্যাতনের অবসান ঘটানোর প্রতিশ্রুতির উপর বিশ্বাস স্থাপন করেন। ২৫ মাস অজস্র প্রতিকুলতার মুখে তারা গেরিলা যুদ্ধ করে বাতিস্তাকে উৎখাত করেন। এভাবে ১৯৫৯ সালে ক্যাস্ট্রোর গেরিলা বাহিনী যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত বাতিস্তার দুর্নীতিগ্রস্ত একনায়কতন্ত্রের স্থলে কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠা করে যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করে। আমেরিকা ফুলগেন্সিও বাতিস্তা সরকারকে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করেছিল। বাতিস্তা সরকার উৎখাত হলে আমেরিকা কিউবার সঙ্গে কুটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। ক্যাস্ট্রো ৪৯ বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্যারিশমা ও ইস্পাত কঠিন ইচ্ছা শক্তি নিয়ে কিউবা শাসন করেন। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ক্যাস্ট্রোকে বিপজ্জনক ব্যক্তি হিসাবে তুলে ধরেন। কিন্তু তিনি বিশ্ব জুড়ে অনেক বামপন্থি বিশেষত লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীদের প্রশংসাভাজন হন।
১৯৫৯ সালের বিপ্লবের পূর্বে আমেরিকা কিউবার উপর আধিপত্য বিস্তার করে আসছিল। বিপ্লব কিউবার উপর আমেরিকার দীর্ঘদিনের আধিপত্যের অবসান ঘটিয়েছিল। ক্যাস্ট্রো ক্ষমতায় থাকাকালে আমেরিকায় ১১ জন প্রেসিডেন্ট শাসনকাল পার করেন। তাদের প্রত্যেকেই তার উপর চাপ প্রয়োগ করে যান। কিউবা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৬০ সালে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কিউবার সম্পর্কের আরও আবনতি ঘটে। ক্যাস্ট্রো সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সম্পর্ক দ্রুত জোরদার করেন। এভাবে ক্যাস্ট্রো বৈরী মার্কিন নীতির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেন। এই নীতিতে বাণিজ্যিক অবরোধ আরোপ করে তাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করার চেষ্টা করা হয়। এই অবরোধ ১৯৬২ সালে শুরু হয়ে ক্যাস্ট্রোর জীবনব্যাপি বলবৎ থাকে। ১৯৬২ সালে কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র সংকট দেখা দিলে বিশ্বে পরমানু যুদ্ধ বাঁধার আশাঙ্কা দেখা দেয়। রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের ৯০ মাইল দূরে কিউবা দ্বীপে পরমাণু অস্ত্র সজ্জিত ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করতে চাইলে সংকট দেখা দেয়। অবশেষে রাশিয়া ক্ষেপণাস্ত্রগুলো কিউবার ভূখণ্ড থেকে দূরে মোতায়েনে রাজি হলে বিশ্বে শান্তি ফিরে আসে। চরম ঠাণ্ডা লড়াইয়ে ক্যাস্ট্রো এক কমিউনিস্ট বীর হিসাবে বিশ্ব মঞ্চে আসিন হন।
কিউবার মার্কিন প্রতিরোধী নীতিতে যুক্তরাষ্ট্র ক্ষুদ্ধ, বিব্রত ও আশঙ্কাগ্রস্ত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবরোধ সত্ত্বেও ক্যাস্ট্রো ক্ষমতায় ঠিকে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র হতাশ হয়। এই অবরোধ কিউবার সরকার বিরোধী বিপ্লব উস্কে দেবে বলে যুক্তরাষ্ট্র আশা করেছিল। ১৯৬০ এর দশকে ক্যাস্ট্রোকে হত্যা করতে সি আই এ ও ক্যাস্ট্রো বিরোধী প্রবাসী কিউবানদের অসংখ্য চেষ্টার মুখেও তিনি বেঁচে থাকেন। ১৯৬১ সালে বে অব পিগসে সি আই এ সমর্থিত প্রবাসী কিউবানদের আক্রমণ এবং অসংখ্য হত্যার চেষ্টা তিনি প্রতিহত করেন।
১৯৬১ সালের মে দিবসের প্যারেডে তিনি এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। ভাষণের অংশ বিশেষ পাঠ করা যাক, ‘আজ আমরা শোষণের সেই দিনগুলো পেছনে ফেলে এসেছি। যখন শাসন ব্যবস্থা দারিদ্রের জন্য ছিল না। ছিল না শ্রমিক, চাষী অথবা সেসব অবহেলিত মানুষের জন্য যারা আমাদেরই অংশ। সেসব শোষকরা কিছুই করেনি স্বদেশের নিরন্ন দরিদ্র, বঞ্চিত মানুষগুলোর জন্য যারা এই কিউবার সন্তান। আজ আর শ্রমজীবী মানুষকে কিছু বোবা নির্বাহী বিচার ব্যবস্থার সামনে হাঁটু গেড়ে করুণা ভিক্ষা করতে হয় না। শ্রমজীবী মানুষ আজ বিশ্বাস করে এটি সেই রাষ্ট্র যা একটি আদর্শ সামানে রেখে পরিচালিত হয়। সেই লক্ষ্যটি হলো শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের কল্যাণ।
এই সেই মাতৃভূমি আমাদের, যেখানে আমরা রক্তের বিনিময়ে অর্জন করেছি নিজেদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের স্বাধীনতা। আমরা শিখেছি নিজেদের শ্রমে ভাগ্য গড়তে। এই মাতৃভূমি হবে আমাদের অনাগত প্রজন্মের সবার কল্যাণের জন্য কেবল মুষ্টিমেয়র জন্য নয়। এ কেমন নৈতিকতা। কোন কারণে, কোন অধিকারে তারা কালো মানুষকে ঠেলে দেয় নির্দয় শ্রমের যান্ত্রিক চাকার নিচে। যা কেবল ধনীদের স্বার্থ সংরক্ষণ করে। আজ পরিবর্তনের হওয়া বলছে এমন এক জাতি নির্মাণের কথা। যেখানে সবাই সবার জন্য। সম্পদ, সুযোগ ও আনন্দে সবার সমান অধিকার।’
বালাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ফিদেল ক্যাস্টো এবং তাঁর দল অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে তিনি আন্তর্জাতিকভাবে সমর্থন ও সহযোগিতা করেছেন। বাংলাদেশের জনগণ তা চিরদিন কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে তাঁকে ‘মুক্তিযুদ্ধে মৈত্রী’ সম্মাননায় ভূষিত করে। এই কিংবদন্তী নেতা ২০১৬ সালের ২৫ নভেম্বর মারা যান। ক্যাস্ট্রোর ইচ্ছানুযায়ী তাঁকে দাহ করা হয়। ফিদেল ক্যাস্ট্রো বিশ্বের নিপীড়িত, নির্যাতিত, মুক্তিকামী মানুষের মুক্তির লড়াইয়ে বেঁচে থাকবেন।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।