একজন শিক্ষক শিক্ষকতার মতো মহৎ পেশায় আত্মনিবেদনের মাধ্যমে মানুষ গড়ার কারিগরের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি যদি সমাজ বিনির্মাণের জন্য আরো বাড়তি সামাজিক–সাংস্কৃতিক দায়িত্ব পালন করে থাকেন, তখন তাঁদেরকে নিঃসন্দেহে বলা যায় স্মরণীয়–বরণীয় মহৎপ্রাণ ব্যক্তিত্ব। এরকম এক মহৎপ্রাণ ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রাক্তন চেয়ারম্যান, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মানবতাবাদী সংগঠক, শিক্ষা ও সমাজ–সদ্ধর্ম বিকাশমূলক অনেক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা, লেখক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বহু পুরস্কার–সম্মাননা–উপাধিপ্রাপ্ত একুশে পুরস্কারপ্রাপ্ত দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ পদার্থবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া।
আমি চট্টগ্রাম বিষয়ে ও চট্টগ্রামের মনীষীদের নিয়ে নিয়মিত লিখছি। তিনি আমার লেখার বিষয়ে অন্যতম প্রেরণাদায়ক প্রিয় একজন মানুষ। চট্টগ্রাম একাডেমিতে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে জ্যোতির্ময় বঙ্গবন্ধু শীর্ষক ১৫ দিনের অনুষ্ঠানে একটি অংশে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়েছিলেন তিনি। দরাজ কণ্ঠে আবেগীয় ভাষায় সেদিন বক্তব্য রেখেছিলেন। অত্যন্ত মেধাবী ও সজ্জন ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি ছিলেন আমাদের সকলের শ্রদ্ধেয় ও প্রিয়জন। জাতির মেরুদণ্ড গঠনে ভূমিকা রাখার প্রত্যয়ে সারাজীবন পথ চলেছেন।
তিনি রাউজান উপজেলার আবুরখীল গ্রামের জনপ্রতিনিধি কৈলাশ চন্দ্র বড়ুয়া ও সুগৃহিনী মমতাময়ী মল্লিকা রাণী বড়ুয়ার ঘর আলোকিত করে ১৯৪৫ এর ১১ ফেব্রুয়ারি বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া জন্মগ্রহণ করেন।
আবুরখীল অমিতাভ সরকারি প্রাইমারী স্কুলে তাঁর প্রাথমিক লেখাপড়ার হাতে কড়ি। ১৯৫১ সালে জীবনের পথকে আলোকিত করার প্রত্যয়ে এ স্কুলে ভর্তি হন। আবুরখীল অমিতাভ উচ্চ বিদ্যালয় হতে স্কুলের প্রথম ছাত্র হিসেবে ১৯৬০ সালে ঢাকা বোর্ডের অধীনে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ হতে প্রথম বিভাগে পাস করেন। পড়াশুনার প্রতি গভীর আগ্রহের কারণে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী কলেজ ‘চট্টগ্রাম কলেজে’ ১৯৬০ সালে আইএসসি পড়ার জন্য ভর্তি হন। মায়ের প্রেরণায় প্রবল ধৈর্যের সাথে চট্টগ্রাম কলেজ হতে ১৯৬২ সালে দ্বিতীয় বিভাগে আইএসসি পাস করেন। ১৯৬৫ সালে পদার্থবিদ্যায় ১০ম স্থান নিয়ে বিএসসি অনার্স পাস করেন একই কলেজ হতে। এরপর শিক্ষার উদ্দেশ্যে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিদ্যায় মাস্টার্সে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন সময়ে তিনি খ্যাতিমান পরমাণু বিজ্ঞানী এম. ওয়াজেদ মিয়ার সান্নিধ্যে আসেন এবং গবেষণাধর্মী কাজে মনোনিবেশ করেন। প্রফেসর এম. ওয়াজেদ মিয়ার স্নেহধন্য ও বাৎসল্যপূর্ণ সান্নিধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে বিশেষ স্থান অধিকার করে নেন।
১৯৬৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে কৃতিত্বের সাথে প্রথম শ্রেণিতে তৃতীয় স্থান নিয়ে এমএসসি পাস করেন। বাংলাদেশের বৌদ্ধদের মধ্যে বিকিরণ বড়ুয়াই প্রথম ছাত্র যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে পদার্থবিদ্যা বিভাগে প্রথম শ্রেণি অর্জন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে এমএসসি পাস করার পর কক্সবাজার কলেজে পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬০ সালে পশ্চিম গুজরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রাউজানে তাঁর শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৬৫ সালে রাউজান থানার আবুরখীল হাইস্কুলেও শিক্ষকতা করেছেন। কক্সবাজার কলেজে ১৯৬৭ এর ১ জুলাই হতে দায়িত্ব নেয়ার পর পদার্থবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্বও তিনি পালন করেছেন।
কক্সবাজার কলেজে অধ্যাপনার পর ১৯৬৮ এর ১ আগস্ট তাঁর সহধর্মিণী প্রফেসর প্রীতিকণা বড়ুয়া প্রাণিবিদ্যা বিভাগে এবং বিকিরণ বড়ুয়া পদার্থবিদ্যা বিভাগে রাঙ্গুনিয়া কলেজে যোগ দেন। পরবর্তীতে পাবলিক কমিশনের মাধ্যমে ১৯৬৯ এর ২৭ এপ্রিল বরিশালের সরকারি ব্রজমোহন কলেজে এবং মাত্র তিন মাস পর বদলি হয়ে চট্টগ্রাম কলেজে পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক পদে যোগ দেন। ১৯৮০ সালে পদোন্নতি পেয়ে চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে এবং পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালে পুনরায় চট্টগ্রাম কলেজে পদার্থবিদ্যা বিভাগে যোগ দেন।
কলেজে শিক্ষকতাকালীন সময়ে বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়ার ছাত্রছাত্রীদের নিকট ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। চট্টগ্রামের শিক্ষাঙ্গনে একজন প্রবাদপ্রতীম আদর্শ শিক্ষক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। কলেজ পর্যায়ে শিক্ষকতার চাকরির শর্তে ১৯৮৪ এর ১৩ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে সফলতার সাথে দায়িত্ব পালনের পর প্রফেসর বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া ২০১১ এর ৩০ জুন অবসর গ্রহণ করেন।
শিক্ষকতা পেশার পাশাপাশি তিনি সক্রিয়ভাবে রাজনীতির সাথেও জড়িত ছিলেন। সমাজসেবামূলক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণে তিনি অবিরাম কাজ করেছেন।
১৯৬২ সালে সরকারে গণবিরোধী শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন, ১৯৬৯ এর গণ–অভ্যুত্থান, ১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে মাঠে ময়দানে কাজ করেছেন। ১৯৭১ এর যুদ্ধকালীন সময়ে ‘আবুরখীল মুক্তিযোদ্ধা সহায়ক সমিতি’ নামে একটি সমিতি গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে কাজ করেছেন এবং ১৭ এপ্রিল রাউজান হয়ে রামগড় সীমানা দিয়ে ভারতের সাব্রুমে প্রবেশ করেন। সেখানে মুজিব নগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের অধীনে শিক্ষকসহ বুদ্ধিজীবী দ্বারা গঠিত উপদেষ্টা পরিষদে কাজ করেন। ১৯৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রামের তিনি একজন বীর মুক্তিসেনা ও স্বীকৃতি প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক।
১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীনতা লাভ করে এবং তিনি দেশে ফেরত আসেন। দেশে ফিরে তিনি পুনরায় শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন। ১৯৭৪ সাালে ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে ডক্টর ডিগ্রির জন্য ভারত পাঠানো হয়। সেখানে তিনি সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স, কোলকাতা থেকে পোস্ট এম এসসি এসোসিয়েটশীপ ডিপ্লোমা ডিগ্রি লাভ করেন এবং ১৯৮২ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে পদার্থ বিজ্ঞানের উপর পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর অভিসন্দভের নাম ছিল ‘Studies on elastic constants of metal and alloy।’
তিনি চট্টগ্রামের সর্বত্র বিজ্ঞান চর্চার উপর কাজ করেছেন। সে লক্ষ্যে তিনি চট্টগ্রাম বিজ্ঞান পরিষদ গঠন করেন। এ পরিষদের তিনি সভাপতি ছিলেন। ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া পদার্থবিদ্যায় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবই রচনা করেছেন। পদার্থবিদ্যার পাঠ্য পুস্তক ছাড়াও বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া অসংখ্য গ্রন্থ ও প্রবন্ধ লিখেছেন যা বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে।
সমাজ কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে প্রশংসনীয় অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৮৮ সালে চট্টগ্রাম বিভাগীয় সমাজ কল্যাণ ফেডারেশন কর্তৃক ‘শ্রেষ্ঠ সমাজকর্মী পুরস্কার’ এ ভূষিত হন। ১৯৯২ সালে ‘দেশবন্ধু’, ১৯৯০ সালে ভারতের আসামের ডিব্রুগড়স্থ ইন্টারন্যাশনাল ব্রাদারহুড মিশন কর্তৃক ‘ধর্মরত্ন’ উপাধীতে তাঁকে ভূষিত করা হয়। এভাবে তিনি দেশে ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাঁর কর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ‘বঙ্গবীর জেনারেল ওসমানী গোল্ডেন অ্যাওয়ার্ড ২০১৯’ এবং মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা ২০১৯ লাভ করেন। সাহিত্য সেবায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ কোলকাতাস্থ আন্তর্জাতিক জলঙ্গী কবিতা উৎসব কমিটি কর্তৃক ‘জলঙ্গী বিদ্যাসাগর সাহিত্য সম্মাননা ২০১৯’ এ পুরস্কারে ভূষিত করা হয় তাঁকে। শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০২০ সাালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘একুশে পুরস্কার’ প্রদান করা হয়।
প্রফেসর ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া জীবনের শেষ পর্যন্ত তাঁর ব্যক্তিত্ব সত্তাকে ফেলে বিশাল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন। প্রফেসর ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া ১৬ আগস্ট ২০২৩ সালে ইহলোক ত্যাগ করেন।
তিনি বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের পথ পরিদর্শক। তিনি সর্বদা অপরকে সম্মানিত করেছেন এবং নিজেও সম্মানীত হয়েছেন। তিনি আমাদের গৌরব ও অহংকার ছিলেন এবং থাকবেন।
‘সেই ধন্য নরকুলে লোকে যারে নাহি ভুলে
মনের মন্দিরে নিত্য সেবে সর্বজনে’।
তথ্যসূত্র: শিমুল বড়ুয়া সম্পাদিত ‘বিভাসিত বিকিরণ’– প্রফেসর ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়ার হীরক জয়ন্তী ও আজীবন সম্মাননা স্মারকগ্রন্থ: হীরক জয়ন্তী উদযাপন ও আজীবন সম্মাননা পর্ষদ।
লেখক: প্রাবন্ধিক, সম্পাদক– শিল্পশৈলী।