একজন প্রখ্যাত মুসলিম দার্শনিক ‘ইবনে খালদুন’, তিনি মানবজীবনকে তিনটি স্তরে বিশ্লেষণ করেন, যা সভ্যতাকে এখনো পরিগ্রহ করে। তিনি উল্লেখ করেন যে, মানুষ প্রথমে নিজ অবস্থানকে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রভূত ধন সম্পদ অর্জনে আত্মনিয়োগ করে, পরবর্তী স্তরে সে অর্থে বিভিন্ন স্থাপত্য নিদর্শন নির্মাণে নিয়োজিত থাকে, তৃতীয় স্তরে আরাম আয়েশে দিনযাপনের সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তার ধ্বংস অনিবার্য হয়ে ওঠে। যুগে যুগে উক্ত বিন্যাস থেকে বের হয়ে জনমানব কল্যাণে নিয়োজিত হয়ে বিভিন্ন জনপদে কিছু মানুষ অমরত্ব অর্জন করেছেন। তেমনিভাবে উত্তর চট্টগ্রামের রাউজান থানার বরেণ্য ব্যক্তিদের ভিড়ে এক সময়কার অবিভক্ত চিকদাইর ইউনিয়ন পরবর্তীতে নোয়াজিষপুর ইউনিয়নের নামে স্বীকৃত এক ছোট গ্রাম ফতেনগরে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে উত্তর চট্টগ্রামের সভ্যতা সংস্কারকের ভূমিকায় আবির্ভাব ঘটে সৈয়দ আবদুল অদুদ চৌধুরীর। তাঁর জন্ম ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দের ৮ই মার্চ। এবং মৃত্যু ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ শে নভেম্বর। দীর্ঘ ৬৫ বছর জীবনকাল, নানা বৈচিত্র্যপূর্ণ কর্মপ্রবাহ স্বতন্ত্র রূপে তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়। অদুদ চৌধুরীর বংশধারা ছিল সৈয়দজাত, তার পিতার নাম আলহাজ্ব সৈয়দ আহম্মদ চৌধুরী, মাতা ওমদা খাতুন। বিভিন্ন তথ্যসূত্রে প্রকাশ তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও বেশ কিছু ভাষাজ্ঞান তার ব্যবসাকর্ম সম্প্রসারণে সহায়ক হয়। তার মধ্যে উর্দু, হিন্দি, গুজরাটি, মারাঠি, ইংরেজি ভাষা তিনি স্বীয় প্রচেষ্টায় আত্মস্থ করেন। তার প্রাথমিক ব্যবসার হাতেখড়ি হয় তামাক ও সুপারি আড়তদারীর মধ্য দিয়ে, তামাক ব্যবসার সূত্রে তৎকালীন বাণিজ্যিক শহর রেঙ্গুনে যাতায়াত বৃদ্ধি পায়। এতে তার শ্বশুর তৎকালীন অন্যতম ধনী বণিক জনাব ফোরক আহমেদ চৌধুরীর সাহচর্য লাভ করেন। সে সূত্রে ব্যবসার পরিসর আরও প্রসারিত হয় এবং স্থানীয়ভাবে তৎকালীন বাণিজ্যিক কেন্দ্র চাক্তায়ের বিভিন্ন পণ্যের আমদানি রপ্তানির বাণিজ্য শুরু করেন। তাতে ব্যবসায়িক সুনাম ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন বিদেশি বণিক চৌধুরী নির্ভর হয়ে পড়েন। যা তার ব্যবসায়িক উন্নতিতে বিশেষভাবে সহায়ক হয় বলে ধারণা করা হয়।
ঐতিহাসিকভাবে সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে যে ক্ষেত্রগুলো উল্লেখযোগ্য তার মধ্যে শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রসার ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন অতীব গুরুত্বপূর্ণ। জনাব চৌধুরীর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকা সত্ত্বেও তিনি উক্ত গুরুত্ব অনুধাবন করেছিলেন এবং ব্যবসায়িক উন্নতি অর্জনের মাধ্যমে উক্ত জনপদের পিছিয়ে থাকা লোকদের শিক্ষার আলোতে আলোকিত করার লক্ষ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার জন্য নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় তিনি ধর্মীয় ও জাগতিক শিক্ষার প্রসারে তার জন্মস্থানে এবং চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ফতেনগর অদুদিয়া মাদ্রাসা, ফতেনগর অদুদিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়, ফতেনগর অদুদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়, হাটহাজারী সুন্নীয়া অদুদিয়া মাদ্রাসা, চন্দ্রঘোনা তৈয়বিয়া অদুদিয়া মাদ্রাসা, আরো জানা যায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালে তিনি একজন অন্যতম দাতা সদস্য ছিলেন। তিনি তাঁর জন্মস্থানের শিক্ষা প্রসারের পাশাপাশি যোগাযোগ ব্যবস্থা ও চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নে গুরুত্ব অনুধাবন করেছিলেন এবং নিজ অর্থে গহিরা–ফটিকছড়ি দীর্ঘ ৮ কিমি সড়ক, নিজ জমি ক্রয়ে ১৫ টির মত বড় সেতু নির্মাণ করেন এছাড়া নোয়াজিষপুরে ৩১ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল স্থাপনের আর্থিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন। উক্ত প্রেক্ষিত বিংশ শতাব্দির শুরুর দিকের একজন স্বশিক্ষিত বণিক হিসেবে তার জন্মস্থানের টেকশই উন্নয়নের একজন পুরোধা যা বর্তমান সময়ের প্রচুর সম্পদশালীদের নিকট আশা করা বৃথা।
জনাব চৌধূরী ছিলেন একজন মানবিক ও ধর্মভীরু ব্যক্তি। জনশ্রুতি আছে কখনো মসজিদ, মাদ্রাসা ও ব্যক্তিগত সাহায্যের জন্য তার কাছে গেলে তিনি কখনো খালি হাতে কাউকে বিদায় করেননি। উল্লেখ্য যে, একদিন তার চাক্তায়স্থ বাণিজ্যালয়ে রাঙ্গামাটির মারিষ্যা নামক স্থান থেকে এক মাওলানা মাদ্রাসার সাহায্য চাইতে গেলে তার নিকট সেদিন নগদ কোনো টাকা না থাকায় মাওলানাকে সেদিন তার মেহমান করে পরের দিন তার কাঙ্ক্ষিত টাকা দিয়ে তাকে বিদায় দিয়েছিলেন এবং সপ্তাহে বাড়ি গেলে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সাহায্যের জন্য আগত লোকদের সাধ্যমত সাহায্য করতেন এবং তাঁর বাড়ির পাশে প্রতিষ্ঠিত অদুদিয়া মাদ্রাসার ছাত্রদের কোরআন তেলাওয়াত শুনতেন এবং সুরের আবেগে চোখে পানি ফেলতেন, সুন্দর পাঠের জন্য পুরস্কার হিসেবে বেশ কিছু টাকা হাতে দিয়ে দিতেন।
রাব্বুল আলামীন পৃথিবীর পথক্রমে কিছু ব্যতিক্রম নজির পরবর্তীক্রমে রেখে যাওয়ার বিধান রেখেছেন বলে হয়তো একজন পূর্ণ মানুষের নিজস্ব কিছু চাহিদার অভাব বা অপূর্ণতা রেখে দেন। এই বিধি মরহুম অদুদ চৌধুরীকে ছুঁয়েছিল, তার নিজের কোনো সন্তান নেই। তবে নিরলসভাবে স্বীয় অর্থে ও শ্রমে গড়ে তোলা তাঁর স্মৃতিচিহ্ন যুগ যুগ ধরে আলোর দীপ্তি ছড়িয়ে যাচ্ছে এবং মানব কল্যাণে কাজে লাগছে।
তাঁর কার্য ও চিন্তা চেতনা থেকে বর্তমান সময়ে অনেক কিছু আমাদের অনুধাবনের সুযোগ আছে। নিজের খ্যাতির জন্য লোক দেখানো দান বর্তমানে আমাদের সমাজে খুবই লক্ষণীয়। তার দান কার্যের পরিসীমা দেখলে সহজে অনুমেয় যে তিনি জাগতিক কোনো খ্যাতির জন্য উক্ত উন্নয়ন কার্যে সম্পৃক্ত হননি। বর্তমান অন্যতম লক্ষণীয় বিষয় হল সম্পদশালীদের বিলাসিতাপূর্ণ জীবন। তার গড়া প্রতিষ্ঠান ও উন্নয়ন কর্ম থেকে প্রতীয়মান হয যে, তাঁর সাধারণ জীবন যাপন উক্ত ব্যয়বহুল কর্ম সম্পাদনে সহায়ক হয়েছিল। তাঁর কর্মময় জীবন থেকে লক্ষণীয় বিষয় হল প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিত না হয়ে তাঁর সমাজ সংস্কারে টেকশই উন্নয়নের যে চিন্তা চেতনা এবং প্রয়োগ তা বর্তমান সময়ে ব্যক্তিগত ভাবে দূরে থাক রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিকল্পনা থেকে প্রয়োগ এখনো দুরূহ মনে হয়।
প্রকৃতির নিয়মকে বরণের মাধ্যমে অদুদ চৌধুরী ৫৩ বছর আগে পরকালের বাসিন্দা কিন্তু তাঁর সৃষ্টিশীল দান প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম আলো ছাড়িয়ে যাচ্ছে এবং একইসাথে যে সমাজ সংস্কারের আলো জ্বালিয়ে ছিল তা বিভিন্নভাবে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রান্তে সমাজ উন্নয়নে অবদান রাখছে।
তাঁর হাতে গড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে ২৪ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে মহান দানবীরের ৫৩তম মৃত্যু বার্ষিকীতে মহান রাব্বুল আলামীনের নিকট মাগফেরাত ও সভ্যতার সংস্কারে দানবীর অদুদ চৌধুরী’র পুনর্জন্ম হোক আমাদের চেতনার ক্ষেত্রে এই প্রত্যাশায়।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, উত্তর সাতকানিয়া
জাফর আহমদ চৌধুরী কলেজ ।