আজ ১২ই জানুয়ারি বাংলার এক মহান দার্শনিক, সমাজ সংস্কারক, স্বদেশপ্রেমী ও সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দের ১৫৯ তম জন্মদিন। প্রখ্যাত ফরাসী নাট্যকার, উপন্যাসিক, নোবেলবিজয়ী রোম্যাঁ রোলাঁ একবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ভারতীয় সভ্যতা, সংস্কৃতি ও শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে জানার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উনাকে বলেছিলেন “যদি ভারতকে জানতে চান, তবে বিবেকানন্দের রচনাবলি পড়েন। তাঁর মধ্যে যা কিছু আছে সবই ইতিবাচক; নেতিবাচক কিছুই নেই “। তাঁর এ ইতিবাচক চিন্তার কারণে তিনি সকলের হৃদয়ে বিশেষ আসনে বিরাজমান। সত্যিই স্বামীজি অনুভব করেছিলেন, দেশের ভবিষ্যৎ জনগণের উপর নির্ভর করে। তিনি চেয়েছেন মানুষের আত্মশক্তির বিকাশ তথা ব্যক্তির অন্তর্নিহিত শক্তির উদ্বোধন। তিনি মনে করতেন মানুষ তার পরিপূর্ণ শক্তির সদ্ব্যবহার করলে সে পূর্ণত্বের দিকে যাবে। প্রত্যেক ব্যক্তির আত্মায় রয়েছে অফুরন্ত শক্তি।
স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৮৭ সালের জানুয়ারি মাসে সন্ন্যাস গ্রহণের পর ১৮৮৭ থেকে ১৮৯৩ পর্যন্ত ভারত পরিক্রমার সময়ই অনুধাবন করেন, মূলত শিক্ষার মাধ্যমে তৎকালীন অন্ধকারময়, আত্মবিশ্বাসহীন জাতিকে জাগ্রত করতে হবে। তখনকার মানুষের দুঃখ, দুর্দশা, অনাহার, কুসংস্কার এসব দেখে অত্যন্ত ব্যথিত হয়েছিলেন তিনি। মানুষের দুর্দশার মূল কারণ হিসেবে শিক্ষার অভাবকেই তিনি দেখতে পেয়েছিলেন। এরপর থেকেই তিনি মুক্তির উপায় হিসেবে শিক্ষার মাধ্যমে তাদের হারানো আত্মবিশ্বাস ও গৌরব ফিরিয়ে দেওয়ার কাজ শুরু করেছিলেন। এক্ষেত্রে তিনি সচরাচর যে শিক্ষাব্যবস্থায় কেরাণী তৈরি করে সেধরনের ব্যবস্থার বিপরীতে ছিলেন বরং তিনি শিক্ষার মাধ্যমে প্রকৃত মানুষ তৈরির পক্ষে ছিলেন। যেটাকে তিনি বলতেন গধহ সধশরহম বফঁপধঃরড়হ – মানুষ গড়ার শিক্ষা। তাঁর মতে, “বুদ্ধিতে যা গ্রহণ করলাম, বাস্তব প্রয়োজনে জীবনে তা কাজে লাগাবার নামই শিক্ষা’। তখনকার দিনের ইংরেজদের চাপিয়ে দেওয়া কেরাণী তৈরির শিক্ষাব্যবস্থার তিনি ভয়ানক বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন। সেদিনের সে শিক্ষার ধারায় শিক্ষার প্রয়োগটা বাস্তব জীবনে করতে অপারগ ছিল মানুষ। যার কারণে ইংরেজদের গোলামে পরিণত হচ্ছিল তখনকার শিক্ষিত সমাজ।
বিবেকানন্দের মতে, “মাথায় কতকগুলি ভাব ঢুকাইয়া সারাজীবন হজম হইল না, অসম্বন্ধভাবে মাথায় ঘুরিতে লাগিল, ইহাকে শিক্ষা বলে না। যাহা জনসাধারণকে জীবনসংগ্রামের উপকরণ জোগাইতে সহায়তা করে না, তাহাদের মধ্যে চরিত্রবল, লোকহিতৈষণা এবং সিংহের মত সাহস উদ্বুদ্ধ করিতে সহায়তা করে না, তাহা কি শিক্ষা নামের যোগ্য?” বরং শিক্ষা এমন হতে হবে যা বিভিন্ন ভাবগুলিকে এমনভাবে হজম করতে শিখাবে, যাতে মানুষের জীবন গঠিত হয়, যাতে আত্মবিশ্বাসী মানুষ তৈরি হয়, চরিত্র গঠিত হয়। আমরা বর্তমান প্রেক্ষাপটেও দেখছি শিক্ষা প্রকৃত শিক্ষিত মানুষ তৈরি করতে আমরা কতটুকু ব্যর্থ। সমাজে দেখা যায় শিক্ষিত মানুষরাই আজ বড় বড় পুকুরচুরি করে, তাদের চরিত্রের দৃঢ়তা নাই। সুইসব্যাংকে কিন্তু গরীবের টাকা থাকে না। স্বামীজীর সোজা বক্তব্য ছিল “জনসাধারণকে শিক্ষিত করা এবং তাহাদিগকে উন্নত করাই জাতীয় জীবন-গঠনের পন্থা”।
আমি একজন শিক্ষক হওয়ায় স্বামীজীর শিক্ষকের সংজ্ঞাটা আমাকে বিশেষভাবে আলোড়িত করে। স্বামীজীর মতে, যে শিক্ষক ছাত্রের চোখ দিয়ে দেখেন, ছাত্রের কান দিয়ে শোনেন, নিজের হৃদয় ছাত্রের হৃদয়ে স্থাপিত করে নিজেকে ছাত্রের স্তরে নামিয়ে আনেন তিনিই আদর্শ শিক্ষক। অনুধাবন করে দেখলাম স্বামীজীর বলা এ কথাটা কতটুকু সত্য। ক্লাসে ছাত্রদের পড়াতে গিয়ে এ সূত্র কাজে লাগানোতে পড়িয়ে নিজে এক ধরনের তৃপ্তি অনুভব করতাম, যখন দেখতাম দুর্বল ছাত্রটি জটিল জিনিসটা বুঝে আনন্দ লাভ করতো। সবসময়ই যে এরকম হতো তা না, কিন্তু মাঝে মাঝে এ আনন্দটা আমি পেতাম। আমি মনেকরি ছাত্রদের একেবারে হৃদয়ে গিয়ে তার ভিতর কঠিন সব লেখাপড়া যে চর্চার মাধ্যমে একসময় যে বোধগম্য হবে, সে বার্তা দেওয়ায় আমাদের কাজ। প্রথমতঃ তাকে এ বিশ্বাসটুকু জাগাতে হবে তুমি পারবে। স্বামীজীর মতে, মানুষকে সর্বদা তার দুর্বলতার বিষয় ভাবতে বলা, তার দুর্বলতার প্রতীকার নয়। তার শক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়াই প্রতিকারের উপায়। তার মধ্যে যে শক্তি আগে থেকেই বর্তমান, তার বিষয় স্মরণ করিয়ে দাও।
প্রবন্ধের শুরুতেই বলেছিলাম, স্বামী বিবেকানন্দের জীবনদর্শন ছিল পুরোপুরিভাবে ইতিবাচক ও আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান। তিনি মানুষকে শুধু ইতিবাচক শিক্ষা দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। কারণ তিনি মনে করতেন, নেতিবাচক চিন্তাগুলি মানুষকে দুর্বল করে দেয়। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন, যদি ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের সবসময় দোষারোপ না করে উৎসাহিত করা হয়, তবে তারা এক সময় উন্নতি করবে, আত্মবিকাশ ঘটিয়ে আত্মবিশ্বাসী হবে। বিশ্বের ইতিহাস হল কয়েকটি আত্মবিশ্বাস সম্পন্ন মানুষের ইতিহাস। নিজের উপর বিশ্বাস থাকলেই অন্তরের দেবত্ব জাগরিত হয় ও মনের পশুত্ব দূরীভূত হয়। তিনি আরও মনে করতেন সমসাময়িক শিক্ষা ব্যবস্থা যে মানুষকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করে না, বা মানুষের মধ্যে আত্মনির্ভরতা ও আত্মমর্যাদাবোধ সর্বোপরি আত্মবিশ্বাসী হতে সাহায্য করে না, তা কোন কার্যকর শিক্ষা ব্যবস্থায় নয়। বিবেকানন্দের মতে, শিক্ষা তথ্যের সমষ্টি মাত্র নয় আরও বেশি কিছু। তিনি শিক্ষাকে মানুষ তৈরি করার, জীবন দানের, চরিত্র গঠন ও মহান চিন্তার সমষ্টি মনে করতেন। স্বামীজী একখানি পত্রে লিখেছিলেন, ‘যে জাতির মধ্যে জনসাধারণের ভিতর বিদ্যাবুদ্ধির যত পরিমাণে প্রচারিত, সে জাতি তত পরিমাণে উন্নত। আমাদের দেশের যে সর্বনাশ হইয়াছে, তাহার মূল কারণ ঐটি রাজশাসন ও দম্ভবলে দেশের সমগ্র বিদ্যাবুদ্ধি এক মুষ্টিমেয় লোকের মধ্যে আবদ্ধ করা। যদি পুনরায় আমাদিগকে উঠিতে হয়, তাহা হইলে ঐ পথ ধরিয়া অর্থাৎ সাধারণ জনগণের মধ্যে বিদ্যার প্রচার করিয়া।’ এ থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, স্বামীজী জাতি, ধর্ম, বর্ণ, সমপ্রদায় নির্বিশেষে সকল জনগণের জন্য এমন ধরনের শিক্ষা চেয়েছিলেন যা কোন কিছু মহৎ বা কল্যাণকর সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়। যে শিক্ষার মধ্যে থাকবে মনের বলিষ্ঠতা গঠন ও আত্মার উদ্বোধনের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান। এই শিক্ষাই হল মানুষ গড়ার শিক্ষা। মানুষ এইভাবে গড়ে উঠলে তার মধ্যে সমাজচেতনা দানা বাঁধতে বাধ্য। যা সমাজ ও জাতিকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিবে। তাই স্বামীজীর মতে প্রকৃত শিক্ষার উদ্দেশ্য হল দূর মানুষ তথা শিক্ষিত জাতি গড়া।আলোকিত হোক সমাজ, দূর হোক অন্ধকার -এটাই প্রত্যাশা। আজ এ মহান মনীষীর জন্মদিনে জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক : বিভাগীয় প্রধান, গণিত বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)।