ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী
গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় যেকোন জাতিরাষ্ট্রের সংবিধান সুরক্ষার প্রধান নিয়ামক হচ্ছে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। সভ্যতার সোপান নির্মাণে যে বিষয়টি সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল; তাহলো জনগণের সামগ্রিক নাগরিক অধিকার প্রয়োগের ভিত্তিকে সুসংহত করা। এই মৌলিক অনুষঙ্গকে ধারণ করেই জনগণের ক্ষমতায়নকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে গণতন্ত্রের বিজয় অব্যাহতভাবে সুনিশ্চিত রয়েছে। এটি সর্বজনবিদিত যে গণতন্ত্র ও উন্নয়ন একে অপরের সম্পূরক ও পরিপূরক। জনগণের বাকস্বাধীনতা–অবাধ মুক্তচিন্তা ও অবারিত জীবন প্রবাহের সকল স্তরে পবিত্র সংবিধান সম্মত অধিকার ভোগের নিশ্চয়তা স্বাভাবিক সমাজ ব্যবস্থাকে সচল রাখে। পবিত্র সংবিধানে জনগণকে দেশের প্রকৃত মালিকানা ও প্রত্যেক নাগরিককে সমান অধিকার ভোগের অধিকার অর্পিত। তৃণমূল থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নয়নের ধারাবাহিক গতিধারা গণতন্ত্রের মূল্যবোধেই পরিশীলিত। এর অন্যথা হলে অন্যায়–অবিচার–শোষণ–শাসন–নির্মমতা–সহিংসতা–অসাম্প্রদায়িকতা–অমানবিকতা ইত্যাদি বৈরী মনোভাব সামাজকে কদর্য পথে পরিচালিত করে। এর থেকে উত্তরণের জন্যই সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাবলীল ধারায় উন্নত জীবনের মানদন্ডে অধিকতর উচুমার্গে পৌঁছুনোর উদ্যোগগুলো প্রশস্ত করার প্রক্রিয়াই সর্বত্র বিরাজিত।
আধুনিক শিক্ষা–জ্ঞান–বিজ্ঞান–তথ্যপ্রযুক্তি–ধর্মদর্শন ও পরিপূর্ণ জীবনাদর্শের মূলে রয়েছে সমাস্টিক বিচার ব্যবস্থার ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান। অপরাধীকে শাস্তি প্রদান শুধু অপরাধকে নিয়ন্ত্রণ করে না; অন্য কেউ যাতে এধরনের অপরাধে যুক্ত না হয় সে শিক্ষা–বার্তায় জনগণকে সতর্কিত করে। ধর্ম–বর্ণ–লিঙ্গ–বয়স–দলমত নির্বিশেষে আইনি কাঠামোর প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে প্রত্যেক নাগরিক তার প্রতি রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত দায়িত্বপালন অপরিহার্য। বিচারহীনতার সংস্কৃতি শুধু ব্যক্তি–প্রতিষ্ঠান বা দেশকে নয়; পুরো বিশ্বকে কলুষিত করার প্রত্যক্ষ–পরোক্ষ উপাদন হিসেবে বিবেচ্য।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত মতবাদ ব্যাখ্যা করেছেন। এ কারণে রাষ্ট্রের উৎপত্তির ব্যাপারে বেশ কয়েকটি মতবাদের জন্ম হয়েছে। রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত বিভিন্ন মতবাদের মধ্যে ঐশ্বরিক–বল প্রয়োগ–পিতৃতান্ত্রিক–সামাজিক চুক্তি–ঐতিহাসিক মতবাদ প্রভৃতি প্রণিধানযোগ্য। ঐশ্বরিক সৃষ্টি মতবাদ রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত মতবাদগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন। এ মতবাদের মূল কথা হলো– বিধাতাই রাষ্ট্রের সৃষ্টিকর্তা। রাজা বা শাসক, সৃষ্টি কর্তার প্রতিনিধি হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। শাসক রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ নয়। শাসকের মনোনয়ন কিংবা বিনাশ জনগণের ইচ্ছা–অনিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল নয়। তবে শাসক ঈশ্বরের কাছে দায়বদ্ধ। রাষ্ট্রের উৎপত্তির ক্ষেত্রে ‘বল প্রয়োগ’ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। মিশরীয়, ব্যাবলনীয়, চৈনিক, রোমান কিংবা মায়া সভ্যতার ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে স্পষ্টই বুঝা যায়, এসব সভ্যতার সৃষ্টিতে কাজ করছে ‘শক্তি প্রয়োগ’ নীতি। শুধু রাষ্ট্রের উদ্ভব নয়; রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব রক্ষার ক্ষেত্রেও বল প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা আছে। যুদ্ধ–বিগ্রহের মাধ্যমে বিশ্বে অনেক রাষ্ট্রেরই জন্ম হয়েছে। বাংলাদেশসহ আফ্রিকা–এশিয়া–ল্যাটিন আমেরিকার অসংখ্য উন্নয়নশীল রাষ্ট্র যুদ্ধ–বিগ্রহ তথা স্বাধীনতা যুদ্ধের অপরিসীম ত্যাগের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করেছে। বর্তমানে দেশে দেশে যুদ্ধ ও সামরিক শক্তি বৃদ্ধি এ মতবাদকে বৈরী অনুভবে অনিবার্যতা দান করছে। তাই বল প্রয়োগ নৈতিক বিচারে সমর্থন–যোগ্য না হলেও, রাষ্ট্র সৃষ্টির ব্যাপারে এ মতবাদের ইতিবাচক অবদানের কথা স্বীকার না করার উপায় নেই।
সামাজিক চুক্তি মতবাদ একটি কাল্পনিক মতবাদ। এ মতবাদের মূলকথা হলো– প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ পরম শান্তিতে বসবাস করত। তারা প্রাকৃতিক আইন মেনে চলত। কিন্তু কালক্রমে সমাজে সম্পত্তির ধারণা বিস্তার লাভ করায় প্রাকৃতিক আইন নিয়ে মতভেদের কারণে সমাজ জীবনে বিশৃঙ্খলা ও যুদ্ধাবস্থা দেখা দেয়। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য মানুষ সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র ও শাসক কর্তৃপক্ষ সৃষ্টি করে। টমাস হবস, জন লক ও জ্যাঁ জ্যাঁক রুশো সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে এ মতবাদ সমৃদ্ধ করেন। বিবর্তনবাদকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত মতবাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ, যুক্তিযুক্ত ও সর্বজন গ্রাহ্য বলে বর্ণনা করেছেন। সুতরাং রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত মতবাদগুলোর মধ্যে ঐতিহাসিক বা বিবর্তনমূলক মতবাদই বৈজ্ঞানিক ও যৌক্তিক হিসেবে বিবেচ্য।
বিভিন্ন অর্থবহ মতানুসারে রাষ্ট্রের উৎপত্তির পিছনে যে বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ ছিল তার মধ্যে অন্যতম হলো স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা। বিচার বিভাগ যেকোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। ব্যক্তিস্বাধীনতা কার্যকর, অপরাধির শাস্তিবিধান ও পবিত্র সংবিধান সমুন্নতকরণে বিচারবিভাগ মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজের নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সংরক্ষণ এবং এর বিকাশ বিস্তার আধুনিক সমাজ প্রতিষ্ঠার মাপকাঠি। সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতা এবং জনপ্রিয়তার উত্থান–পতন নির্ভর করে বিচারবিভাগের কর্মক্ষমতা–কার্যকারিতার ওপর। বিচার বিভাগের উৎকর্ষতা–দক্ষতা ও প্রকৃতির উন্নয়ন তথা শ্রীবৃদ্ধি সাধনের জন্য এর স্বাধীনতা ন্যায়সঙ্গত। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে সেই অবস্থাকে বুঝায় যখন বিচার বিভাগ তার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে শাসন বিভাগ, আইনবিভাগ বিভিন্ন প্রকার চাপ সৃষ্টিকারী–কায়েমী শক্তি ইত্যাদির নিয়ন্ত্রণ–হুমকি–প্রভাবমুক্ত থাকে এবং কেবলমাত্র সংবিধান, প্রচলিত আইন, মূল্যবোধ, বিবেক, জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও পেশাদারিত্ব দ্বারা পরিচালিত হয়। বিচারবিভাগের স্বাধীনতা একজন বিচারককে তাঁর রায় প্রদানের ক্ষেত্রে এবং সত্যানুসন্ধান–ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠায় সব রকমের সামাজিক–রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তি ও সরকার নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত রাখে। অধ্যাপক গার্নারের মতে, বিচারকগণ যদি প্রজ্ঞা–সাধুতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতার অভাবে পীড়িত হন তাহলে বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হবে।
পক্ষান্তরে বিচারকদের দায়িত্ব হচ্ছে বিচারপ্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা এবং নিরপেক্ষতা বজায় রাখা। সংবিধানের ১১৬ক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এই সংবিধানের বিধানাবলি সাপেক্ষে বিচার–কর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ এবং ম্যাজিস্ট্রেটগণ বিচারকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন।’ সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনে ন্যায়বিচার সম্পাদন বিচার বিভাগের মৌলিক কাজ। এক্ষেত্রে বিচারকগণ দোষী ব্যক্তির শাস্তিবিধান করতে গিয়ে অসাবধানতাবশত কোনক্রমেই যেন নির্দোষ ব্যক্তি শাস্তি না পায় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখেন। বাস্তব ঘটনাবলী সংক্রান্ত তথ্য–নথিপত্র–সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহ ও বিশ্লেষণে যে কোন মামলাতেই বিচারকগণ এ কর্তব্য সুষ্ঠুভাবে পালন করেন যাতে অপরাধের মাত্রা নির্ণয় করে প্রকৃত অপরাধীকে শনাক্ত করা ও দন্ড প্রদান সহজ হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিশ্বপরিমন্ডলে অনন্য মর্যাদায় সমাসীন বাংলাদেশ সরকারের শোষণ–বঞ্চনামুক্ত ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় আইনের শাসন–মৌলিক মানবাধিকার ও সুবিচার সুনিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও আধুনিক বিচার ব্যবস্থা গঠন অত্যন্ত প্রশংসনীয়। আইনের শাসন নিশ্চিতকল্পে বিচারকার্যের গতিশীলতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে বিচারকের সংখ্যা বাড়ানোসহ নানা উদ্যোগের ফলশ্রুতিতে বর্তমানে উপেক্ষিত ও অধিকার–বঞ্চিত মানুষের একমাত্র ভরসাস্থল বিচারবিভাগ।
দুঃখজনক হলেও সত্য দীর্ঘ সময় ধরে দেশের স্বাধীন বিচারব্যবস্থা নিয়ে কতিপয় উন্নত দেশ–তাদের প্রতিনিধির অযাচিত–অনভিপ্রেত আলোচনা–সমালোচনা–মন্তব্য–বার্তা–হস্তক্ষেপ অতিশয় দৃশ্যমান। মিথ্যা–ভিত্তিহীন–বানোয়াট কল্পকাহিনীর মোড়কে অহেতুক বিভ্রান্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে উন্নত বিশ্বের কথিত রাজনৈতিক বিশিষ্ট ব্যক্তিরা দেশের স্বাধীন বিচারব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। আইনের কোন ব্যত্যয় কিংবা সরকারের পক্ষ থেকে কোন ধরনের অবৈধ–অনৈতিক প্রভাব বিস্তারের সুযোগ না থাকা সত্ত্বেও সম্প্রতি দেশের উচুমার্গের এক ব্যক্তিত্বের মামলা নিয়ে এসব বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অপাংক্তেয় পদক্ষেপ নানামুখী বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। প্রাসঙ্গিকতায় এটুকু বলা যায়, স্বাধীন দেশের পবিত্র সংবিধানসম্মত বিচার ব্যবস্থার প্রচলিত ধারায় সকল জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সরকার প্রধানসহ দেশের সমগ্র জনগণের প্রতি উল্লেখ্য মনোভাব অশ্রদ্ধা–অসম্মান–আস্থাহীনতার অনাকাঙ্ক্ষিত প্রয়াস।
এটি গভীর অনুভূত যে, বিশ্ব শান্তি সুরক্ষায় সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ বা জাতিসংঘের উন্মেষ ঘটলেও কথিত আধুনিক–উন্নত পরাশক্তি সমূহের আধিপত্য বিস্তারে কদর্য অভিপ্রায়ের বহির্প্রকাশ বন্ধ হয়নি। বৈষম্যের নির্মম প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলার যে উদাত্ত মানবতাবাদী চিন্তা–চেতনা থেকে ভারসাম্যহীন বিশ্বকে একটি সঙ্গত পর্যায়ে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা কার্যকর করার সকল উদ্যোগ কালক্রমে ব্যর্থতায় পর্যবসিত। গণতন্ত্র–মানবতার রক্ষাকবচদের মুখোশ উম্মোচনে সমগ্র ধরিত্রীর দরিদ্রতা–মানবিকতা চরম অসহায় পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে। শত কোটি মানুষের প্রাণ বিসর্জন বা মানবেতর জীবনযাপনের প্রতি ন্যূনতম ভ্রুক্ষেপ না করে ঘৃণ্য অপকৌশল অবলম্বনে অনৈতিক সুবিধা অর্জনে এসব দেশ–তাদের প্রতিনিধিদের অভিন্ন চক্রান্তমূলক দূরভীসন্ধির বিস্তার এক প্রকার স্বাভাবিক ধারায় প্রবাহিত। দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তির পক্ষে মার্কিন সিনেটরদের কল্পনাপ্রসূত পত্রপ্রদান অতিসম্প্রতি উচ্চ আদালতে স্থায়ী জামিন ব্যবস্থায় সম্পূর্ণ অযৌক্তিক–অমূলক–অসার প্রমাণিত হয়েছে। এসব বৈশ্বিক চক্রান্ত মোকাবেলায় বিশ্বের সকল নিপীড়িত–নির্যাতিত ও বৈষম্যের শিকারে পর্যুদস্ত দেশ–সরকার ও জনগণের ঐক্যবদ্ধতার কোনো বিকল্প নেই। মোদ্দাকথা এদের হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থে সকল ধরনের অগ্রহণযোগ্য নষ্টামি প্রতিরোধে বিশ্বের সকল সচেতন–বিবেকবান–গণতান্ত্রিক ও মানবতাবাদি ব্যক্তি–প্রতিষ্ঠানের জোরালো কন্ঠস্বর অধিকতর সোচ্চার করা অত্যন্ত জরুরি।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়