স্বাধীনতা তুমি!

সালমা বিনতে শফিক | সোমবার , ৩ এপ্রিল, ২০২৩ at ৫:৪২ পূর্বাহ্ণ

মহাসমারোহে উদযাপিত হয়ে গেল বাংলাদেশ নামের অকুতোভয় রাষ্ট্রটির তিপ্পান্নতম জাতীয় দিবস ও প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। যথারীতি চলছে প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির হিসেব, সাফল্য ও ব্যর্থতার চুলচেরা বিশ্লেষণ। তবে রেললাইন বহে সমান্তরালের মতো পূর্ণমাত্রায় অটুট আছে জাতীয় বিভক্তি, যদিও তাতে নীতি আদর্শ নয়, নিতান্ত আর্থিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতালিপ্সাই প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে যায়। সকলেই আমরা সাফল্যের অংশীদার হতে চাই, ব্যর্থতার দায় অন্যের ওপর চাপিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হয়ে যাই অনায়াসে।

একটি ফুলকে বাঁচানোর জন্য যুদ্ধ করেছিল আমাদের অগ্রজরা। না, এখন যারা ধবধবে পোশাক গায়ে চড়িয়ে মঞ্চ কাঁপিয়ে বেড়ান, টেলিভিশন টকশোতে বক্তৃতার তুবড়ি ছোটান, কলমের ছোঁয়ায় দিনরাত্রি একাকার করে দেন, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সম্মাননা পদক লাভ করেন, তাঁরা নন, বরং হাঁড় জিরজিরে একপাল বঙ্গসন্তান লুঙ্গি গামছা প্যাঁচানো কৃষক শ্রমিক, ছাত্র, সৈনিকেরাই খেয়ে না খেয়ে, রোদ বৃষ্টি গায়ে মেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সেদিনের সেই জনযুদ্ধে (ভদ্র ঘরের কিছু সন্তান ওই দলে ছিলনা তা নয়, তবে সংখ্যার বিচারে তা সামান্যই বলা যায়)। বিশ্বমোড়লেরা সব শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে। তবুও ফুটেছিল পরম আকাঙ্খার বিজয় ফুল, তিরিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, দু’লক্ষ নারীর সম্মানের বিনিময়ে। আর প্রাণে বেঁচে যাওয়া অসংখ্য তরুণের হাত পা চোখের বিনিময়ে। আজকের ঝলমলে আলোকিত উদযাপনের মঞ্চে কোথায় তারা ?

অমর কথাশিল্পী রিজিয়া রহমানের ৮৮ পৃষ্ঠার ছোট্ট উপন্যাস ‘একটি ফুলের জন্য’; প্রকাশিত হয়েছিল মুক্তধারা প্রকাশনী হতে, ১৯৮৬ সালে। বইটির গায়ে মূল্য লেখা ১০০ টাকা, তবে কিনতে চাইলে সত্তর কি আশি টাকার বেশী খরচা করার প্রয়োজন হয়না। এই দুর্মূল্যের বাজারে এত সুলভে পাওয়া ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র উপন্যাসে কিবা থাকতে পারে!

একটি ফুলের জন্য’ কয়েকজন যুদ্ধাহত তরুণ মুক্তিযোদ্ধার বেঁচে থাকার লড়াইয়ের গল্প, আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্মোপলব্ধির এক করুন উপাখ্যান। সম্মুখযুদ্ধে তরুণ কৃষক আলফুর একটি হাত উড়ে যায়। বাড়ি ফিরে দেখে ঘর নেই, নেই পরিজন। শহরগামী জনস্রোতে মিশে গিয়ে নোঙর ফেলে রেললাইনের ধারের বস্তিতে। মহাজনের রিকশার চাকা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে টেনে নিয়ে যায় জীবন নৌকাটিকে। সুখের কথাসহযোদ্ধা শিক্ষিত যুবকেরা তাকে অসম্মান করেনা। এই দলে ফরহাদ ছাড়া অন্য সকলেই শারীরিক পঙ্গুত্বের শিকার। সে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, খোলা আকাশের নিচে হাঁটতেও পারে। কিন্তু প্রাণভরে শ্বাস নিতে পারে না। এত দাম দিয়ে কেনা স্বদেশের নতুন জনসমুদ্রে নিজেকে বড় বেমানান মনে হয় তার। ‘একান্ত নিজস্ব সুখের বৃত্তে বন্দী হয়ে সত্যমিথ্যা বিচারের জ্ঞান হারিয়ে’ ফেলা আপন মানুষগুলোকে তার অচেনা লাগে। বিবেকের ছুরির আঁচড়ে ক্রমাগত বিদ্ধ হয় ফরহাদ। বাদবাকি সহযোদ্ধারা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে নামমাত্র সরকারী ভাতায় কোনরকমে খেয়ে পরে বেঁচে থাকে আর মৃত্যুর প্রহর গোনে। বিজয় দিবসে বঙ্গভবন থেকে দাওয়াত আসে ওদের। অসুস্থ বিবর্ণ স্বপ্নহীন মানুষগুলো দিনটাকে অর্থহীন চোখে তাকিয়ে বিদ্রুপের হাসি হাসে।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সরকারগুলো মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহার করেছে কখনও তুরুপের তাস হিসেবে, কখনওবা বিজ্ঞাপন হিসেবে। ‘ডাইরেক্ট মুক্তিযোদ্ধার ডিসপ্লে’ তে গ্লামারাস হয় অনুষ্ঠান, ‘সবার ইন্টারেস্ট বেনিফিটেড হয়’। মুক্তিযোদ্ধাদের আনুষ্ঠানিক সম্মাননা দেওয়া নিয়ে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো, যদিও ছাব্বিশে মার্চ আর ষোলই ডিসেম্বরের আগে পরে কেউ তাঁদের খোঁজ রাখারও প্রয়োজন বোধ কওে না। এক দিনের জন্য নতুন জামা জুতো পরিয়ে রঙ্গমঞ্চে উপস্থাপন বা ডিসপ্লে করায় মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান ও স্বাচ্ছন্দ্য বিন্দুমাত্র বৃদ্ধি না পেলেও সম্বর্ধনা দানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মর্যাদা ও জনপ্রিয়তা যে ঊর্ধ্বমুখী হয়, তাতে কোন সন্দেহ নেই। যুদ্ধের বিভৎসতায় অঙ্গ হারানো যুবকদের অনেকে মূক ও বধির হয়ে যায় স্বাধীন দেশের নাগরিকদের প্রতারণার মহড়া দেখে দেখে। পুনর্বাসন কেন্দ্রের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার অকাট্য স্বগতোক্তি– “ডায়াসে উঠে কবিসাহিত্যিকরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কত বক্তৃতা করে। মানবতার কথা বলে। সংগ্রামের কথা শোনায়। তারা কোনদিন কেউ এখানে আসে না, বিস্মৃতির ধুলায় আমাদের ঢাকা দিয়েছে সবাইবিশ্বাসটাকে রাখব কোন বিশ্বস্ত হাতে!”

তিন তিনটি প্রজন্ম অর্ধ শতক ধরে দেখে আসছে আমাদের স্বাধীনতার মানে জাঁকজমকের মধ্য দিয়ে সপ্তাহব্যাপী কোথাওবা মাসব্যাপী বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা। আজকাল আবার পতাকার রঙে রঙ মিলিয়ে পোশাক কেনাও অনেকটা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়েছে। মার্চ ডিসেম্বর এলেই বিপণী বিতানগুলো তাই সেজে থাকে লাল সবুজে। বিশেষ বিশেষ দিনে ফুলে ফুলে ভরে ওঠে স্মৃতিসৌধের বেদি। গণমাধ্যমে ছবি আসেবহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা। ক্রমেই যেন সত্য থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছি আমরা।

একরাতে আলফুর স্বপ্নে দেখা দেয় শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা। একের পর এক তারা অভিযোগ করে যায় বেঁচে যাওয়া সহযোদ্ধাদের– “আমরা তোমাদের জন্য স্বাধীনতার ফুল নিয়ে এসেছিলাম। তোমরা সে ফুল নিয়ে জুয়া খেলে চলেছআমাদের রক্তের দাগের ওপর এখন লোভের পতাকা উড়ছেমানুষকে সত্য ভোলাবার জন্যই তোমরা কর স্মৃতিসৌধের মিথ্যা আড়ম্বর”। আজ আর কারও স্বপ্নে দেখা দেয়না হারিয়ে যাওয়া শহীদেরা। তাঁদের নিয়ে ভাবে এমন মানুষ কোথায়? আমরা যে একান্ত নিজস্ব সুখের বৃত্তে বন্দী হয়ে সত্যমিথ্যা বিচারের জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি। আমাদের যাদের কাজের ক্ষমতা চিন্তাধারা একটা অসাড় ব্যর্থতায় বন্দী হয়ে আছে, তারা কি পঙ্গু নই? রিজিয়া রহমানের ভাষায়– “যে সমাজ যে জাতির বিবেক স্বার্থপরতায় অন্ধ, ব্যর্থতায় অক্ষম, নির্বাক নিশ্চুপ সে জাতিই পঙ্গু”। এখন এদেশে মানুষের চেয়ে মিনারের দাম বেশী। আমরা সকলেই নাটকীয়তায় জীবনের সার্থকতা খুঁজে নেবার প্রানান্তকর চেষ্টায় নিয়োজিত।

রাজনৈতিক দলগুলোর জনসমর্থন ও ক্ষমতা প্রদর্শনে মিটিং মিছিলের জন্য ভাড়া খাটে বস্তির ছেলেমেয়ে বুড়োঅন্তত চার দশক আগে রচিত লেখকের এই অভিমত আজও মিথ্যে হয়ে যায়নি। প্রয়োজনে তারা প্রতিপক্ষের দিকে ইট পাটকেল ছোঁড়ে, আহত হয়, নিহতও হয় কেউ কেউ। ওদের কথা লেখা হয়না ইতিহাসে। গণমাধ্যমে কেবল প্রবৃদ্ধির ঊর্ধ্ব সুচক আর মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির খবর। বিবেকবান মানুষের আত্মজিজ্ঞাসা– “একজন দু’জন ভাল থাকা মানেই কি দেশের সবাই ভাল থাকা”? উন্নয়নের ভেলায় ভাসতে থাকা ভাগ্যবান ক’জনকে নিয়েইতো বাংলাদেশ নয়। কিছু মানুষ বিলাস ব্যসনে মত্ত থাকবে, মিথ্যের বেসাতি করে শতকোটি উপার্জন করে গড় আয়ের হিসেব ওলটপালট করে দিয়ে দেশটাকে বিশ্ব আসরে ধনী দেশের কাতারে নিয়ে যাবে ু এমন স্বপ্ন কি কেউ দেখেছিল সেদিন ? কিন্তু তাই যেন হয়ে গেল। ফরহাদ কে তার সহকর্মী বলছে, “চোখের ওপর দেখছেন তো মানুষ কেমন পাগল হয়ে উঠেছে, কে কেমন ভাবে গুছিয়ে নেবে সেই ধান্ধায়। যেন সব বিদেশ থেকে এসেছে। লুটেপুটে খেয়ে নিজের দেশে ফিরে যাবে”।

শুধু কি তাই ! চোখের পলকে রঙ ও পোশাক বদলে ফেলার মতো করিৎকর্মা লোকের অভাব নেই স্বাধীন বাংলাদেশে। এক মুক্তিযোদ্ধার “হাবু মামা পঁচাত্তর সনের আগ পর্যন্ত মুজিব কোটটা একদিনের জন্যও শরীর থেকে খোলেননি। তারও আগে সবসময় জিন্নাহ টুপি পরে থাকতেন। এখন সব সময় খাকী রঙের সাফারি স্যুট আর হাল্কা রঙের সানগ্লাস পরে থাকেন।” সেই হাবু মামা হয়তো আবারও মুজিব কোট গায়ে চাপিয়ে মিশে গিয়েছেন নতুন স্রোতে। চারপাশে এখন অনেকগুলো হাবু মামার মুখ দেখা যায়, ‘যারা মন্ত্রিদের তল্পিবাহক হবার জন্য প্রাণ দিয়ে ফেলে’।

কেন এমন হল? কেন স্বপ্ন ভেঙে গেল? দেশপ্রেমের অভাব? যুদ্ধজয়ী তবে জীবন যুদ্ধে পরাজিত ফরহাদের উপলব্ধি– “দেশপ্রেম মাটি নয়, নদী নৌকা কাশফুল খেজুরগাছ নয়। দেশপ্রেম হচ্ছে আত্মসম্মান। আত্মসম্মানের গৌরববোধ। একটি জাতি হিসেবে সম্ভ্রমবোধ”। সেই আত্মসম্মানের গৌরববোধ আমাদের মাঝে অক্ষুন্ন আছে কি না, তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। নগর অধিপতিগণ আতশবাজি আলোকসজ্জায় শহর সাজান, জলাবদ্ধতা, উন্মুক্ত আবর্জনার ভাগাড় আর আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়ানো বিষাক্ত সীসা নিয়ে উদ্বিগ্ন হননা। শিরদাঁড়া বাঁকা হয়ে যাওয়া জনতা জয়োধ্বনি দিয়ে যায় তাদেরই নামে।

এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছিলাম ‘স্বাধীনতা’ নামের ফুল কে। দলিত লাঞ্ছিত সেই ফুলটিকে কে সারিয়ে তুলবে? জনসেবার জন্য মরিয়া জনপ্রতিনিধিগণ? ক্রমাগত ঘৃণার চাষ করে যাওয়া রাজনীতিবিদগণ? জনতার কি কোন দায়ই নেই? কথায় কথায় জয়ধ্বনি না দিয়ে, সুযোগ বুঝে পোশাক ও রঙ না পাল্টিয়ে, বক্তৃতা বিবৃতির তুবড়ি না ছুটিয়ে আমরা সমাজের মানুষগুলো কি যে যার কাজটা ঠিক মতো করতে পারিনা? আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের সন্তানদের শ্বাস নেওয়ার জন্য জন্য একটি বাসযোগ্য ভালোবাসার দেশ গঠন করতে হবে আমাদেরই। ওদের আমরা শেখাবস্বাধীনতা কেবল উল্লাস আর উদযাপনের নয়, উপলব্ধিরও। এই উপলব্ধি মর্যাদার সহমর্মিতার ভালোবাসার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ-এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধচলচ্চিত্রকার রাজা সেনের হাত ধরে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের যাত্রা