বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তি পৃথিবীর ইতিহাসের মানুষের একটি বড় অর্জন এবং গৌরবের। এই অঞ্চল বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর দ্বারা শাসিত হয়েছে। অন্যান্য বিষয়গুলো আলোচিত না হলেও আলোচিত হয় বৃটিশদের দুইশ বছরের পরাধীনতার ইতিহাস, অনেক চড়াই উৎরাই পার হয়ে ১৯৪৭ সালে পাওয়া স্বাধীনতা সেটাও ছিল পাকিস্তানীদের স্বাধীনতা সেটাও ছিল পাকিস্তানীদের শোষণের ইতিবৃত্ত। প্রায় বাইশ বছরের জাতিতাত্ত্বিক স্বাধীনতা ছিল পরাধীনতার মতই। তবে বিপ্লবী সূর্যসেন, প্রীতিলতাসহ নাম জানা অজানা অসংখ্য দেশ প্রেমিক বিভিন্নভাবে অবদান রেখেছেন সেই বৃটিশ থেকে দেশকে মুক্ত করতে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল থেকে শুরু করে অনেকে দেশের মানুষকে উজ্জীবিত করার জন্য গান-কবিতা রচনা করেছেন, যেগুলো ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রেও অবদান রেখেছে।
টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণকারী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ত্যাগ তিতিক্ষা আজ স্মরণ করতে হয়। দেশ বিভাগের পর ১৯৫২ সালে যখন দুই পাকিস্তানের ভাষা বাংলা হবে বলে ঘোষণা করা হয় তখন এদেশের জনগণ জীবনের তোয়াক্কা না করে রাস্তায় নেমে পড়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠা করার জন্য। ২১শে ফেব্রুয়ারি রাস্তায় শহীদ হন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার। আহত হন বেশ কিছু।
দেশের সুবর্ণজয়ন্তী পালনকালে যাঁদের শ্রদ্ধারসাথে স্মরণ করতে হয়, তাঁরা হলেন এ দেশের ৩০ লক্ষ শহীদ। এছাড়া শ্রদ্ধা জানাতে হয় দু লক্ষ মা-বোন যারা পাকিস্তানী সৈনিকদের হাতে নিঃগৃহীত হয়েছেন। এখানে আরো স্মরণ করা দরকার যাঁরা ষাটের দশকে বিভিন্ন আন্দোলনে তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। ‘৫৮ সালে আইয়ুব খান কর্তৃক সামরিক শাসন জারীর পর অনেককে কারাগারে পাঠানো হয়। এছাড়া ‘৬২ ভাষা আন্দোলন, ‘৬৬ এর ছয় দফা দাবী জনগণের কাছে পৌঁছে গিয়ে এবং ‘৬৮ ও ‘৬৯ এ গণ আন্দোলনে অনেকে পুলিশের নির্যাতনের পাশাপাশি কারান্তরীণ হতে হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জীবনের সব চেয়ে গুরুত্ব সময় প্রায় ১৪ বছর কারাগারে থাকতে হয়েছে শুধুমাত্র এদেশের মানুষকে পাকিস্তানী শোষক গোষ্ঠীর হাত থেকে মুক্ত করতে।
১৯৭০ সালে নির্বাচনের পর পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তথা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে (সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হওয়া সত্ত্বেও) সরকার জীবনের সুযোগ না দিয়ে ১৯৭১ সালে ২ শে মার্চ রাতের অন্ধকারে বাঙালিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হাজার হাজার বাঙালি নর-নারীকে হত্যা করেছে। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানী কারাগারে নিয়ে বন্দী করে রাখা হয়। দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় এবং ৭ই মার্চের ভাষণের মাধ্যমে উজ্জীবিত বাঙালি জাতির কাছে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে এদেশের আপামর জনগোষ্ঠী যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং নয় মাস সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ৯৫ হাজার সৈনিককে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে দেশকে শত্রু মুক্ত করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামের একটি দেশের জন্ম হয়।
দেশ স্বাধীন হবার মাত্র দুইদিন আগে পাকিস্তানী বাহিনী দোসররা এ দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য ইত্যাদি ধ্বংস করার লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর দেশের মেধাসম্পন্ন ব্যক্তিদের নির্বিচারে হত্যা করে। দেশ স্বাধীন হবার পর একটি গোষ্ঠী দেশে চক্রান্ত শুরু করে। তাদের সাথে যুক্ত হয় এ দেশের স্বাধীনতার বিরোধীতাকারী রাজাকার, আলবদর, আল শামস ও পাকিস্তানীদের দোসর মুসলিম লীগের নেতা-কর্মীরা।
ধ্বংসাবশেষ সম্পন্ন দেশকে অগ্রগতির দিকে নিয়ে যাবার লক্ষ্যে জাতির পিতা যখন বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন তখন একটি চক্রান্তকারী গোষ্ঠী এবং পাকিস্তানীদের দালাল যারা ১৯৭১ সালে পরাজিত হয়ে তারা ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট জাতির পিতাসহ তাঁর পরিবারের প্রায় ২১ জন সদস্যকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এছাড়া জাতির পিতার অত্যন্ত আস্থাভাজন জাতীয় চারনেতাকে তারা হত্যা করে ঢাকার কারাগারে এ পর্যায়ে আমি তাঁদের সবাইর আত্মার শান্তি কামনা করছি এবং তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
জাতির পিতার হত্যাকারীরা এ দেশের পরাজিত শক্তি মুসলিম লীগের নেতা ও জামায়াতের নেতাদের এদেশের মন্ত্রী সভায় স্থান দিয়ে জাতিকে কলংকিত করেছে।
জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে বাংলাদেশের বৃহত্তম দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপর তিনি তার দলকে সুসংগঠিত করার জন্য সকল বাধা বিপত্তিকে ডিঙিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যান। ৮০ দশকে দেশে জগদ্বনা পাথরের মত ক্ষমতায় বসে থাকা এরশাদ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। ‘৯৬ এ ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার বেশ কিছু উন্নয়নমূলক কাজের উদ্যোগ গ্রহণ করে যা পরবর্তী সরকার ঐসব কাজে বিভিন্নভাবে বাধার সৃষ্টি করে।
এরপর ফখরুদ্দিন মঈনুদ্দীন সরকার অন্যায়ভাবে দেশের ক্ষমতা নিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে জেলে প্রেরণ করে। এদেশের আপামর জনগণের চাপের মুখে দীর্ঘদিন কারাভোগের পর শেখ হাসিনা জনগণকে সাথে নিয়ে নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। দেশে শেখ হাসিনা যখন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সারা বাংলাদেশ ঘুরে বেরিয়েছিলেন, পাকিস্তানী হানাদারদের দোসররা প্রায় ২১ বার তাঁকে হত্যার চেষ্টা চালায়।
২০০৮ সালে সরকার গঠনের পর থেকে দেশে একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকায় দেশে আজ উন্নয়নের জোয়ার বইছে। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু সরকারের দেয়া প্রথম বাজেট ছিল মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকা আজ সেটা দাঁড়িয়েছে সোয়া পাঁচ লক্ষ কোটি টাকায়। পাকিস্তান আমলে মানুষের গড় যেখানে আয়ু ছিল ৫৭ বছর আজ তা দাঁড়িয়েছে ৭৩-৭৪ বছরে। স্বাধীনতার পর মানুষের মাথা পিছু আয় ছিল ৮০ ডলার তখন মানুষ ছিল প্রায় সাড়ে সাত কোটি। আজ ১৭ কোটি মানুষের দেশে মানুষের মাথা পিছু আয় হয়েছে ২৫০০ মার্কিন ডলার। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে কোন কোন রাষ্ট্র বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ বলত। আজ সেই দেশের রিজার্ভ হচ্ছে প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার। যে দেশে কোনদিন বিদ্যুতের চিন্তা মাথায় আনতে পারেনি রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করে দেশের অর্থনীতির ভিতের প্রমাণ দিয়েছে। অতি সম্প্রতি এ ধরনের আরো একটি কেন্দ্র স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশ স্যাটেলাইট স্থাপন করেও বিশ্বের কাছে একটি নজীর স্থাপন করেছে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেন স্থাপনের মাধ্যমে দেশের যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। চট্টগ্রাম থেকে রেল লাইন কঙবাজারে নিয়ে যাওয়া এবং কঙবাজারের এয়ার পোর্টকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার উদ্যোগ দেশ একটি উন্নত ধাপে নিয়ে যাবে। মায়ানমার থেকে প্রায় দশ লক্ষ রোহিঙ্গাকে এদেশে আশ্রয় প্রদান করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে এবং বিদেশী রাষ্ট্রের কাছে এক সম্মানজনক অবস্থান সৃষ্টি করেছে। দেশের মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার কমিয়ে এবং তাঁর মানবিক কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ প্রধানমন্ত্রী অনেকগুলো পুরস্কার লাভ করেছেন।
দেশের মাটিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিুবর রহমানের বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশে এগিয়ে যাচ্ছে এর মধ্যে গত দশকের মাঝামাঝি সময়ে একটি গোষ্ঠী এদেশে জ্বালাও পোড়াও চালিয়ে দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে। দেশে এক সময় বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল প্রচুর। আজ দেশ বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ। স্বাধীনতার পর দেশে যখন হাজার হাজার ব্রিজ ভাঙা ছিল তখন বঙ্গবন্ধু সেই ব্রিজ নতুন করে চালু করার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল করেছিল। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা পিতার স্বপ্ন এদেশের প্রত্যেকটি মানুষকে স্বাবলম্বী করে তোলার লক্ষ্যে প্রত্যেকটি জেলায় কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছেন। বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি লোক আজ বিদেশে কাজ করছে এবং হাজার হাজার কোটি টাকার রেমিটেন্স দেশকে উন্নত করার কাজে লাগছে। বিশ্বব্যাংক যখন পদ্মা সেতুর জন্য অর্থ যোগান দিতে অস্বীকার করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় বত্রিশ হাজার কোটি টাকা দিয়ে তা প্রতিষ্ঠার উদ্যেঅগ নেন। সেই সেতু দিয়ে যেতে লাগলে তা ভেঙে পড়বে বলেও অনেক নেতা উপহাস করেছেন, আজ তা বাস্তবে রূপান্তরিত এবং আগামী বছর যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে। হত্যাকারীদের এবং স্বাধীনতা বিরোধীদের বিচার সম্পন্ন করে দেশের মর্যাদাকে এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে তিনি পর্যায়ক্রমে দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন করোনাকালীন বর্তমান সরকার জীবন এবং জীবিকাকে এক সঙ্গে চালিয়ে নেবার ব্যবস্থা করে বিশ্বের কাছে নজির স্থাপন করেছে। করোনাকালীন প্রধানমন্ত্রীর দেয়া উপহার গরীব জনগোষ্ঠীর কাছে প্রশংসা যেমন পেয়েছে তেমনি বিভিন্ন পেশার মানুষ ও শিল্পক্ষেত্রে প্রণোদনা প্রদান করে দেশের অগ্রগতির ধারাকে বজায় রেখেছে বর্তমান সরকার।
দেশ স্বাধীন হয়ে আজ পঞ্চাশ বছর। স্বাধীনতা প্রাপ্ত একটি দেশকে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে জাতির পিতার স্বপ্ন পূরণের চেষ্টার পাশাপাশি এসবকে নস্যাৎ করার উদ্যোগও বন্ধ রাখেনি পাকিস্তানীদের দোসররা। বিদেশের মাটিতেও বসে বিভিন্ন ধরনের অপপ্রচার তারা লিপ্ত। একটি দেশের জন্য ৫০ বছর খুব বেশি সময় নয়। আবার কমও নয়। শহীদদের রক্তের ঋণ শোধ করতে হলে আমাদের অবশ্যই একটি দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন করতে হবে। মাদকমুক্ত দেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যুব সমাজের জন্য গাইড করতে হবে। আজকের যুবক আগামী দিনের কর্ণধার। করোনা আমাদের সমাজকে, শিক্ষাকে অনেক পিছিয়েছে। এগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে একত্রে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে। এটাই হোক সুবর্ণ জয়ন্তীর অঙ্গীকার।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক