এ সমাজে কিছু কিছু মানুষ জন্মায় সমাজকে আলোকিত করার জন্য সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে ছায়া হয়ে দাঁড়াবার জন্য। প্রায় সবারই একটা ধারণা ‘বিত্তবানের ঘরে জন্মালেই চিত্তের এই প্রসারতা দেখানো সম্ভব।’ এ ধারণাটি মিথ্যে করে সমাজের পরতে পরতে তিনি সেবা দিয়ে গেছেন। ছোটবেলা থেকে বড় হওয়ার জন্য ছায়া মায়া তিনি পাননি। তিনি নিজে এতিমখানায় বড় হয়েছেন (এতিমখানায় লেখাপড়া করেছেন সংগ্রাম করে)। তাই তাঁর একটা মায়াবী দৃষ্টি ছিল গরিব–দুঃখী, অসহায়, এতিম অর্থাৎ সব ধরনের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য সৃষ্টিগুলো।
হ্যাঁ বলছিলাম মেট্রোপল স্কলারশিপ পরিষদের চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম মহানগর গাউসিয়া কমিটির প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য সচিব, বুড়িশ্চর জিয়াউল উলুম মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি, চট্টগ্রামের জমিয়তুল ফালাহ জাতীয় মসজিদে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শাহাদাতে কারবালা মাহফিল পরিচালনা কমিটির জেনারেল সেক্রেটারি আলহাজ্ব এস এম আবদুল লতিফের কথা। যিনি মাহফিল চলাকালীন গত ২৮ জুলাই ৬.৫৫ মিনিটে ইম্পেরিয়াল হসপিটালে ইন্তেকাল করেন।
আমি জনাব এস এম আবদুল লতিফকে চিনি ১৯৮৯ সাল থেকে। তখন মাত্র চট্টগ্রাম কলেজ প্রাক্তন ছাত্র–ছাত্রী পরিষদ গঠন হয়েছে। প্রয়াত সাংবাদিক ও লেখক জনাব সাখাওয়াত হোসেন মজনুর সাথে এই প্রতিষ্ঠানটি গঠনের জন্য আরো চারজন মহৎ ও সৃজনশীল ব্যক্তিত্ব সঙ্গে ছিলেন তাঁরা হলেন ডা. মাহফুজুর রহমান, ডা. ওহিদুল আলম, জনাব মহিউদ্দিন, শাহ আলম নিপু এবং জনাব খোরশেদ আলম। ধীরে ধীরে সম্পৃক্ত হলেন অধ্যাপক আসহাবউদ্দিন আহমদ, কবি অহিদুল এবং আরো অনেকে। পরে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রকাশিত পত্রিকা ‘দৈনিক আজাদী’র প্রয়াত সম্পাদক প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদকে প্রথম সভাপতি করা হয়। শুরু হয় প্রথম পুনর্মিলনীর কাজ। কিন্তু অফিস নেই, বসবার কোনো জায়গা নেই। উদারচিত্তে আন্তরিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এলেন জনাব এস এম আবদুল লতিফ। সেই থেকে শুরু তাঁর মেট্রোপল চেম্বারে প্রাক্তন ছাত্র–ছাত্রীদের পদচারণা, পুনর্মিলনীর জন্য নাম নিবন্ধন করা, ছোট বড় কমিটির সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের রিহার্সেল, অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি সভা, আড্ডা, হাসি গান। সব মিলিয়ে মেট্রোপল চেম্বার হয়ে উঠেছিল আনন্দ ভুবন। একটি একটি করে আমরা উপরে নিচে সব ক’টি কক্ষই ব্যবহার করেছি। এমনকি উনার নিজস্ব অফিস কক্ষ, টিএন্ডটি ফোনও তিনি ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছিলেন। তখন মোবাইলের প্রচলন ছিল না। এই দরাজদিল মানুষটির উপর আবদার খাটাতে খাটাতে হয়তো তাঁর উপর আমরা অনেক অত্যাচারও করেছি। কিন্তু তিনি কখনো বিরক্ত হননি, রাগ করেননি। এ এক বিস্ময়। বলতে গেলে ‘চট্টগ্রাম কলেজ প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী পরিষদ’টির বিকাশ এবং বেড়ে উঠা এই মেট্রোপোলেই।
তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন গরিব ও মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের জন্য মেট্রোপোল স্কলারশিপ। ব্যক্তিগত পর্যায়ে এতোগুলো বৃত্তিপ্রদান আমি আর দেখিনি। একেবারে প্রাথমিক পর্যায় থেকে কলেজ লেভেল পর্যন্ত। তাঁর এই মহৎ কার্যক্রমে আমার স্বামী কলামিস্ট, গবেষক সাখাওয়াত হোসেন মজনু (প্রয়াত) এবং আমি সরাসরি সম্পৃক্ত থাকতে পেরে ধন্য হয়েছি।
পূর্ব বাকলিয়াতে একটা স্কুল আছে ‘সার্ক একাডেমি’। এই স্কুলটির সভাপতি ছিলেন তিনি। স্কুলটির বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রীই সুবিধাবঞ্চিত। তাই তার নজরদারিও ছিল প্রচুর। তিনি নিজ উদ্যোগে বস্ত্র বিতরণ করেছেন, পরিচালকদের সাথে সম্মিলিতভাবে কম্বল বিতরণ করেছেন সকল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের। করোনাকালীন ও রমজানে আর্থিক অনুদান দিয়েছেন।
তিনি ভালোবেসে পুকুরের মাছ, মৌসুমী ফল, আম, কাঁঠাল, শীত মৌসুমে চালের গুঁড়ো, গুড় ও নারিকেল অনেকের বাসায় পাঠিয়ে দিতেন। আমাদের পরম সৌভাগ্য আমরা ও তার অন্তর্ভুক্ত ছিলাম। ‘মেট্রোপোল বৃত্তিপ্রাপ্ত’ সকল শিক্ষার্থীদের অভিভাবকসহ বৃত্তি প্রদান করতেন এবং মেট্রোপোলে উপস্থিত সকলকে মধ্যাহ্ন ভোজ খাওয়াতেন প্রতি বছর। তিনি সকল দিকেই অনন্য এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ভালোবাসা, সহমর্মিতা ও সহযোগিতা সব মিলিয়ে আমরা সবাই তাঁর কাছে ঋণী। ভাবছি এ ঋণ শোধ করবো কিভাবে? না, করবো না। এ ঋণ অপরিশোধ্য থাকলেই ভালো।
তিনি এতিমখানায় বড় হলেও সততা, নিষ্ঠা ও পরিশ্রমের ফলে এক সময় বিত্তবান হয়ে উঠে সেই সাথে প্রসারিত হয় চিত্ত উদারতা বাড়ে হৃদয়ের, হয়ে উঠেন ধর্মপরায়ণ ও দানবীর। প্রকাশ্যে, অপ্রকাশ্যে তিনি আর্থিক সাহায্য করতে থাকেন দু:স্থ অসহায় মানুষদের। তিনি একজন ভালো উপদেষ্টাও ছিলেন। সুশীল সমাজেরও কেউ যদি কোনো সমস্যা বা বিপাকে পড়তেন তবে তিনি বুদ্ধি, পরামর্শ ও সঠিক নির্দেশনা দিয়ে তা সমাধান করার চেষ্টা করতেন। চট্টগ্রামবাসীর অনেকেই তার উপর নির্ভরশীল ছিলেন। মনে হচ্ছে পুরো চট্টগ্রামই হারালেন একজন বর্ষীয়ান অভিভাবক ও পরামর্শক। সকালে এতিমখানা ও সংশ্লিষ্ট সকলকে নিয়ে নাস্তা খাওয়া ছিল তার নিত্য রুটিন। তারাও হারালো ছায়া, মায়া একজন দরদী মানুষ। জমিয়তুল ফালাহ হতে শাহাদাতে কারবালার অনুষ্ঠানের সাথে প্রতি বছরই সরাসরি সম্পৃক্ত থাকতেন। এবারও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু সরাসরি উপস্থিত থাকতে পারেননি। ২৮ জুলাই সন্ধ্যায় নগরীর ইম্পেরিয়াল হসপিটালে ইন্তেকাল করেন। আশুরার দিন পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। তাঁর চলে যাওয়ায় সৃষ্টি হলো বিরাট এক শূন্যতা। তিনি রেখে গেছেন স্ত্রী, ছেলেমেয়ে ও অসংখ্য গুণগ্রাহী। তাঁর তিনটি মেয়ে ডাক্তার, বড় ছেলে অস্ট্রেলিয়াতে অন্যরা যে যার অবস্থানে স্বমহিমায় উজ্জ্বল ও প্রতিষ্ঠিত। তারাও অভিভাবকশূন্য হয়ে গেল।
মহান আল্লাহ তাঁর পরিবার ও সকলকে এই শোক সইবার শক্তি দিন এবং মরহুম এস এম আবদুল লতিফকে জান্নাতুল ফেরদৌসের মেহমান হিসেবে কবুল করে নিন।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক